×

জাতীয়

যাত্রী নিরাপত্তায় পদে পদে অনিয়ম

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৫ ডিসেম্বর ২০২১, ০৮:৩১ এএম

যাত্রী নিরাপত্তায় পদে পদে অনিয়ম

অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ড, শিশু-নারীসহ ৪১ জনের লাশ উদ্ধার,আহত আরো ২ শতাধিক

যাত্রার শুরু থেকেই ইঞ্জিনে গোলযোগের তথ্য ধরা পড়ে। তবুও বিষয়টিকে পাত্তা না দিয়ে গন্তব্যের উদ্দেশে যেতে থাকে লঞ্চটি। আগুন লাগার পর লঞ্চটিকে দ্রুত তীরে ভেড়ানোর চেষ্টা করা হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। জানা গেছে, লঞ্চটিতে ছিল না পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা। যে কারণে আগুন নেভানো তো দূরের কথা, লাইফ জ্যাকেট বা বয়া নিয়ে পানিতে ঝাঁপও দিতে পারেননি হতভাগ্য যাত্রীরা। প্রায় ১ ঘণ্টা ধরে নদীতে দাউ দাউ করে পুড়তে থাকে এমভি অভিযান-১০। শত শত মানুষের গগনবিদারী আর্তনাদে খান খান হয়ে যায় মধ্যরাতের নিস্তব্ধতা।

দেশের নৌ দুর্ঘটনার ইতিহাসে আগুনে পুড়ে এত যাত্রীর প্রাণহানির ঘটনা এটাই প্রথম। যাত্রী নিরাপত্তায় পদে পদে অনিয়ম আর অবহেলার আরেক সাক্ষী হয়ে থাকল এমভি অভিযান-১০। রাতের যাত্রায় সর্বোচ্চ ৪২০ জন যাত্রী বহনের অনুমতি রয়েছে লঞ্চটির। আর দিনে ৭৬০ জন। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টায় ঢাকার সদরঘাট টার্মিনাল থেকে ছেড়ে যাওয়ার সময় লঞ্চটিতে ৮০০ থেকে ১ হাজার যাত্রী ছিল বলে জানা গেছে। যদিও বিআইডব্লিউটিএর কাছে জমা দেয়া ভয়েজ ডিক্লারেশনে লঞ্চের প্রথম শ্রেণির মাস্টার মো. রিয়াজ ৩১০ জন যাত্রীর কথা উল্লেখ করেছেন।

ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা থেকে বরগুনাগামী এমভি অভিযান-১০ নামে একটি যাত্রীবাহী লঞ্চে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত শিশু ও নারীসহ অন্তত ৪১ জনের নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। আহত হয়েছেন আরো ২ শতাধিক। লঞ্চ থেকে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে অনেকেই নিখোঁজ রয়েছেন- যাদের সঠিক পরিসংখ্যান এখনো পাওয়া যায়নি। তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছে, তাও অনিশ্চিত। এ ঘটনায় ৭ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। এছাড়া জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তিনটি কমিটি করা হয়েছে। মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনা কারণ সম্পর্কে এখনো নিশ্চিত কোনো ভাষ্য পাওয়া যায়নি। তবে বিশ্লেষকরা অভিযান-১০ লঞ্চ কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও নানা অনিয়মের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।

নৌ খাত বিশেষজ্ঞ ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল্লাহ জানান, ভয়েজ ডিক্লারেশনে ভুয়া তথ্য দেয়ার ঘটনা নতুন কিছু নয়। এটি দুর্নীতির প্রতিষ্ঠিত রূপ। বিআইডব্লিউটিএর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও লঞ্চ মালিক পক্ষের সমঝোতায় এমনটি করা হয় এবং এতে দুই পক্ষই লাভবান হয়। কিন্তু মাঝখান থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হন সাধারণ যাত্রীরা। কারণ একটি নৌযানে তার ধারণক্ষমতা অনুযায়ী নিরাপত্তা সামগ্রী নিশ্চিত করতে হয়। অনেক মালিক সেটিও করেন না। এর ওপর যদি ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি যাত্রী তোলা হয়, তবে দুর্ঘটনা ঘটলে যাত্রীরা নিরাপত্তা সামগ্রীও পান না। ফলে প্রাণহানি বেশি হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। এমভি অভিযান-১০ এর ক্ষেত্রেও সেটি ঘটেছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

নৌপরিবহন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, অভিযান-১০ লঞ্চটি ২০১৯ সালে নিবন্ধিত হয়। এর মালিক সূত্রাপুরের বাসিন্দা মো. হাম জামাল নামে এক ব্যবসায়ী। লঞ্চটিতে ১২৫টি লাইফ বয়া, ২২টি লাইফ জ্যাকেট, ফায়ার এক্সটিংগুইশার ২০, বালি ভর্তি বালতি ১৫টি, পাম্প ১টি ও ১টি বালির বক্স থাকার কথা। বয়াগুলো যাত্রীদের হাতের নাগালে ও প্রকাশ্যে রাখার নিয়ম রয়েছে। যেন দুর্ঘটনা ঘটলে সেটি নিয়ে যাত্রীরা পানিতে ঝাঁপিয়ে প্রাণ রক্ষা করতে পারেন। উদ্ধারকাজে অংশ নেয়া ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানান, একটি বয়া ধরে ৬/৭ জন যাত্রী পানিতে ভেসে থাকতে পারে। সে অনুযায়ী, ৩১০ জন যাত্রী থাকলে সবাই পানিতে ঝাঁপ দিলেও বয়ার সংকট হতো না। কিন্তু বেঁচে যাওয়া যাত্রীরা অনেকেই জানিয়েছেন, লঞ্চটি আগুন লাগার পর প্রায় ১ ঘণ্টা পানিতে ভেসে ছিল। যারা সাঁতার জানতেন,তারা পানিতে ঝাঁপ দিয়েছেন। আর অনেকেই বয়ার খোঁজে

এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করেছেন। কেউ পুড়ে মারা গেছেন। কেউ পানিতে ডুবে গেছেন। একপর্যায়ে ঝালকাঠির দিয়াকূল গ্রামের তীরে লঞ্চটি ভেড়ানো হলে দ্রুত নামতে গিয়ে যাত্রীদের অনেকে আহত হন। আগামী দুয়েক দিনে পানিতে ডুবে যাওয়া মৃতদেহ উদ্ধার হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন উদ্ধারকর্মীরা।

জুম্মন নামে লঞ্চের বেঁচে যাওয়া এক যাত্রী জানান, তিনি নিচ তলার ডেকের সামনে দিকে ঘুমিয়ে ছিলেন। হঠাৎ চিৎকার চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙে দেখেন আগুন আর আগুন। তিনি বলেন, সাঁতার জানলেও মাঝ নদীতে কতক্ষণ আর ভেসে থাকা যায়। তাই পানিতে ঝাঁপ দেয়ার জন্য একটি বয়া খুঁজছিলাম। কিন্তু দেখি, কোথাও বয়া নেই। যে কটি ছিল, সেগুলো নিয়ে অনেক আগেই মানুষ পানিতে ঝাঁপ দিয়েছে। এ অবস্থায় লঞ্চের একেবারে সামনে অপেক্ষা করতে থাকি। শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে থাকি। পরে লঞ্চটি তীরের কাছাকাছি গেলে লাফিয়ে পানিতে নেমে প্রাণ বাঁচাই।

যাত্রীদের অনেকে জানিয়েছেন, ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়ার পর থেকেই লঞ্চের ইঞ্জিনে অস্বাভাবিক শব্দ হচ্ছিল। কয়েক বার বেশ জোরে শব্দ হয়। আর প্রচণ্ড কালো ধোঁয়া বের হচ্ছিল। তবে লঞ্চের কর্মীরা বিষয়টি নিয়ে খুব চিন্তিত ছিলেন না। ইঞ্জিন রুমের চালক লঞ্চের মাস্টারকে বিষয়টি জানান। তবে লঞ্চটি বন্ধ করার কোনো নির্দেশনা মাস্টার ডেস্ট থেকে দেয়া হয়নি। যখন লঞ্চটি বরিশাল ঘাট ধরে সুগন্ধা নদীতে প্রবেশ করে, তখন হঠাৎই প্রচণ্ড শব্দ শোনা যায়। রাত ২টার পর থেকে রাত ৩টার মধ্যে পুরো লঞ্চটিতে আগুন ধরে যায়। একপর্যায়ে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেলেও গতির কারণে লঞ্চটি অনেকক্ষণ চলছিল। এ সময়ে বাতাসে আগুন আরো ছড়িয়ে পড়ে। তাছাড়া যাত্রীদের বিছানাপত্র ও মালামালগুলোতে দ্রুত আগুন লেগে যায়। শীতের কারণে ত্রিপল দিয়ে জানালা বন্ধ থাকায় অনেক যাত্রী পানিতে ঝাঁপ দিতে গিয়ে আহত হন।

তিন তলার কেবিন যাত্রী জহিরুল বলেন, আমরা অনেকেই বুঝতে পারছিলাম, কোনো একটা সমস্যা হচ্ছে। লঞ্চের ফ্লোর গরম হয়ে উঠছিল। ইঞ্জিনে প্রচণ্ড শব্দ আর কালো ধোঁয়া দেখছিলাম। তবে স্টাফরা আমাদের সান্ত¡না দিয়ে বলে ‘সমস্যা হবে না’। তবে শেষ পর্যন্ত সমস্যা তো হলোই। আগুন লাগার পর নদীতে লাফ দিয়ে প্রাণে রক্ষা পান এ যাত্রী। দুই পা পুড়ে যাওয়া জহিরুলকে পরে বরিশালের শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসা দেয়া হয়। জহিরুল আরো জনান, সদরঘাট থেকে ছেড়ে যাওয়ার পর এক ইঞ্জিনে চলছিল লঞ্চটি। পরে চাঁদপুর ছাড়ার পর দ্বিতীয় ইঞ্জিনটি চালু করা হয়। এরপর ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ ব্যাপক চিৎকারে ঘুম ভেঙে যায়। দরজা খুলে দেখি আগুন দেখা যাচ্ছে। স্টাফরা তখনো ধৈর্য ধরতে বলে।

বিআইডব্লিউটিএর নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের পরিচালক রফিকুল ইসলাম জানান, অনেক সময় ইঞ্জিন রুমে আগুনের ঘটনা ঘটতে পারে। তাই সেখানে অগ্নিনির্বাপকের ব্যবস্থা থাকে। কিন্তু ইঞ্জিন বিস্ফোরণ বা এ জাতীয় কিছু ঘটে আগুন লেগেছে কিনা তা তদন্তের পর বলা যাবে। লঞ্চে হাজার হাজার লিটার ডিজেল থাকে। ইঞ্জিন রুমের সঙ্গে ছিল খাবারের হোটেল। সেখানে বড় বড় গ্যাস সিলিন্ডার ছিল। এছাড়া আরো দাহ্য বস্তু থাকতে পারে। ফলে আগুন লাগলে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। তিনি বলেন, লঞ্চে জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জাম পর্যাপ্ত থাকার কথা। সেটা কতগুলো ছিল, যাত্রীরা সেগুলো ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছিলেন কিনা, তা তদন্ত করে দেখা হবে।

এদিকে দুর্ঘটনাকবলিত এমভি অভিযান-১০ লঞ্চের মালিক মো. হাম জামাল একটি গণমাধ্যমে দাবি করেছেন, যাত্রীদের মাধ্যমে লঞ্চে আগুন লেগেছে। যার সূত্রপাত দোতলা থেকে হয়েছে। এরপর তিন তলায় ছড়িয়ে পড়ে আগুন। যার কারণে প্রাণহানির ঘটনা বেশি হয়েছে। ইঞ্জিন থেকে আগুন লাগার বিষয় নাকচ করে দিয়ে হাম জামাল বলেছেন, মাসখানেক আগে নতুন ইঞ্জিন লাগানো হয়েছে। এরপর ঢাকা-বরগুনা রুটে মাত্র চারটি ট্রিপ দেয়া হয়েছে। লঞ্চে থাকা অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রপাতির মেয়াদও আগামী জানুয়ারি পর্যন্ত আছে বলে দাবি করেন তিনি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App