×

মুক্তচিন্তা

সুবর্ণজয়ন্তীতে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৪ ডিসেম্বর ২০২১, ০১:২২ এএম

স্বয়ং একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়ে মুক্তিযুদ্ধের ৫০তম বছর বা সুবর্ণজয়ন্তী দেখার সুযোগ পাওয়াটা একটা মস্ত বড় প্রাপ্তি। একাত্তরের রণাঙ্গনের সহযোদ্ধাদের অনেককেই ইতোমধ্যে হারিয়েছি। জাতি ও বাংলাদেশ তার বহুসংখ্যক সেরা দেশপ্রেমিক, দুঃসাহসী মুক্তিযোদ্ধাকে অশ্রæজলে বিদায় দিয়েছেন। যারা সৌভাগ্যক্রমে আজো বেঁচে আছেন তাদের অল্পসংখ্যক বাদে বেশিরভাগই কর্মক্ষমতা হারিয়ে বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়েছেন। নিজেকে যথেষ্ট ভাগ্যবান মনে করি আমিও সেই স্বল্পসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধার একজন, যারা আজো কম-বেশি কর্মক্ষম আছেন। বেঁচে থাকার কারণে স্বচক্ষে পঞ্চাশ বছরের বাংলাদেশটাকে দেখারও সুযোগ ঘটেছে। বস্তুতই পঞ্চাশ বছর আগের বাংলাদেশ আজ আর নেই। অনেক ক্ষেত্রেই অনেক পরিবর্তন ঘটেছে, আরো ঘটতে চলেছে। এই পরিবর্তনগুলোর মধ্যে অনেকগুলো যেমন জাতির জন্য কল্যাণকর, তেমনই আবার বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটেছে, যা এ জাতির জন্য ভয়ংকর ক্ষতিকর। এই অর্থেই মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র অংশের সমাপ্তি ঘটে থাকলেও মুক্তিযুদ্ধ আজো অসমাপ্ত। সকল সচেতন মহলই এই বক্তব্যের সঙ্গে এক মত। বাহাত্তরের বাংলাদেশ ছিল একটি ভঙ্গস্তূপ। পাকিস্তানের এপিপি যখন বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থায় পরিণত হলো তখন হঠাৎ করেই তৎকালীন প্রধান সম্পাদকের অনুরোধ পেলাম সমগ্র উত্তরবঙ্গে আজকের রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের সকল জেলা-মহকুমা ও উল্লেখযোগ্য থানাগুলোয় সরজমিন গিয়ে পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের বাঙালি ও মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর পরিচালিত অত্যাচার-নির্যাতনের খবর সংগ্রহ করে প্রেস টেলিগ্রামে বা স্ সকে পাঠাতে। আমি বলেছিলাম আমি তো এপিপিতেও ছিলাম না বা বা স্ স-এও নেই, তাই এ অঞ্চলে যারা এপিপিতে ছিলেন তাদের কাউকে তিনি বললেন, এপিপি প্রায় সবাই পাকবাহিনীর সহযোগী ছিল- মুক্তিযোদ্ধারা ইতোমধ্যে অনেককে হত্যাও করেছে। তাই এখনো আমরা ডেস্কগুলো ঠিকমতো সাজাতে পারিনি। আপনি দায়িত্বটা নিন কারণ ওই খবরগুলোর আন্তর্জাতিক চাহিদা প্রবল। আপনি আমাদের পরিচিতও বটে, এটা একটা ঝঢ়বপরধষ ধংংরমহসবহঃ হিসেবে গণ্য করুন। তখন মুক্তিযুদ্ধের পুরো ৯ মাসই ছিলাম পশ্চিম নদীয়া জেলার করিমপুরের পাবনা জেলার ন্যাপ কমিউনিস্ট পার্টি ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা প্রশিক্ষণের জন্য তরুণদের রিক্রুট করা ও প্রশিক্ষণে পাঠানোর জন্য স্থাপিত যুব শিবিরের পরিচালক হিসেবে সার্বিক দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত। ফলে দেশের অভ্যন্তরে সংঘটিত বর্বর নির্যাতনের কাহিনীগুলো বিদেশি গণমাধ্যমসমূহ ও অবরুদ্ধ বাংলাদেশ থেকে সীমান্ত পেরিয়ে আসা মানুষদের কাছ থেকে কিন্তু চাক্ষুষ দেখার সুযোগ হয়নি। তাই বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়ে ২/১ দিনের মধ্যেই ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম। বেরোনোর পরে চাক্ষুষ দেখলাম একাত্তরে ধ্বংসস্তূপে পরিণত বাংলাদেশের চেহারা। রাস্তাঘাট ভাঙা। কোথাও কোথাও জরুরি মেরামত চলছে। বঙ্গবন্ধুর সরকার ক্ষমতায় বসলেও আর্থিক অনটন প্রবল। ব্যাংকগুলো থেকে কোটি কোটি টাকা পাচার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ট্রেনের ইঞ্জিন বেশিরভাগই ধ্বংসপ্রাপ্ত। রেলপথগুলো বিধ্বস্ত। ব্রিজগুলো ভাঙা। সরকারের হাতে সীমিত তহবিল থাকায় তার দ্বারা ওই ব্যাপক ধ্বংসপ্রাপ্ত বাংলাদেশকে নতুন করে গড়ে তোলা প্রায় অসম্ভব। প্রতিবেশী মিত্র দেশ ভারত মুক্তিযুদ্ধে ৯ মাস ধরে যে সীমাহীন সহযোগিতা দিয়েছে তা ধারণাতীত। মুক্তিযুদ্ধের পরে তারা বাংলাদেশের বিধ্বস্ত অবকাঠামোসহ সকল কিছুর সংস্কার নির্মাণ ও পুনর্গঠনেরও তাদের অকৃপণ সাহায্য দিয়ে বিপুলভাবে সহযোগিতা করেছে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে। তথ্য সংগ্রহে বেরিয়ে চাক্ষুষ দেখলাম ভগ্নপ্রাপ্ত উত্তরবঙ্গকে। এমনিতেই তো উত্তরবঙ্গ মারাত্মকভাবে চিরকালই অবহেলিত, তার ওপর পাকবাহিনী ও তাদের বাঙালি দোসর জামায়াতে ইসলামী, আলবদর, আলশামস ছাড়াও এই অঞ্চলে বাসরত ব্যাপকসংখ্যক বিহারির একটি বড় অংশ পাকিস্তান ও ইসলাম রক্ষা নামে যে ভয়াবহ ধ্বংসলীলা চালাচ্ছে তা এক কথায় অবিশ্বাস্য রকমের ভয়াবহ। ভারত ছাড়াও তৎকালীন সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের নেতা সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো সদ্যজাত বাংলাদেশকে সাহায্যে অকৃপণভাবে এগিয়ে না এলে কত দিনে যে অবকাঠামোগুলো মেরামত, সংস্কার ও নির্মাণ করা সম্ভব হতো তা ভাবতেও শিউরে উঠতে হয়। সে দৃশ্যগুলো চক্ষে দেখলাম। তার সঠিক বর্ণনা আজ সম্ভব না, তখনো সম্ভব হয়নি অবিশ্বাস্য সেই নির্যাতনের চিত্রগুলোর যে প্রতিবেদন টেলিগ্রামে পাঠিয়েছিলাম সেগুলোতে। সেই ধ্বংসপ্রাপ্ত বাংলাদেশ যেমনটি তখন ছিল, আজকের প্রজন্মের কাছে তা অবশ্যই অবিশ্বাস্য। কিন্তু ইতিহাস তো কথা কয়। সত্য সত্যই, তার জন্য বাড়তি কোনো প্রচারের দরকার হয় না। সে সময়ের বিদেশি গণমাধ্যমসমূহের বাংলাদেশ সংক্রান্ত প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো আজ তার সাক্ষী হিসেবে বিরাজ করছে। আমরা যারা ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে তাবৎ গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম। সেগুলোকে সংগঠিত করেছি বা অবরুদ্ধ বাংলাদেশে বাস করে ঘটনাগুলো প্রত্যক্ষ করেছি। আজ তারা অনেকেই নেই। বই পড়ার আগ্রহও কমে গেছে, তাই নতুন প্রজন্মের কাছে পঞ্চাশ বছর আগের বাংলাদেশটি তাদের অনুভবে আসছে না। আজকের পদ্মা সেতু, যমুনা সেতু, মেঘনা সেতু, সুউচ্চ বহুতল বিশিষ্ট চোখ ধাঁধানো অট্টালিকা, পথ-ঘাট, অসংখ্য স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল সব কিছুই ব্যাপক উন্নয়নের চিত্র বহন করে। আমরা যারা প্রবীণের দলে, যারা সময় গুনছি শেষ যাত্রার তাদের কাছে অবিশ্বাস্যই এই সব উন্নয়ন। আজ আমরা বিস্মৃতপ্রায় ১৯৭২ সালের সেই দিনগুলোর কথায়। একটি সংবিধান রচনা করতে পাকিস্তানের যেখানে ৯ বছর লেগেছিল, বাংলাদেশ সেখানে মাত্র ৯ মাসের মধ্যে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ গণতান্ত্রিক সংবিধান রচনা করে গোটা বিশ্বের প্রশংসা কুড়িয়েছিল। এবারে আমাদের ব্যর্থতার কথাগুলো তুলে ধরি। বাহাত্তরের ওই সংবিধানকে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ও এরশাদ সামরিক আইন বলে শুধুমাত্র ক্ষমতায় চিরস্থায়ী হওয়ার মতলবে সংবিধানের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ্’ লিখে জামায়াতে ইসলামী ও ধর্মাশ্রয়ী সাম্প্রদায়িক দলগুলোকে বৈধতা দিয়ে এবং একটি বিশেষ ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা দিয়ে রাষ্ট্রীয় দলিলকে যেভাবে কলঙ্কিত ও অপবিত্র করে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রকে কার্যত বিদায় দিয়ে গেছেন, আমাদের ব্যর্থতা আজো বাহাত্তরের পবিত্র সংবিধানের সেই অপরিবর্তন দূর করতে পারিনি। কারণ ন্যূনতম চেষ্টাও করিনি। বরং তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে উগ্র জঙ্গিবাদী হেফাজতে ইসলাম তাণ্ডব। তাদের হুমকিতে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে জাস্টিশিয়া নামক ভাস্কর্যকে নারী মূর্তি বলে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে অপসারণ, পাঠ্য পুস্তকের সাম্প্রদায়িকীকরণ ও একে বহুকেন্দ্রিক ক্ষতিকর শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করা। ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার ছিল বাংলার মাধ্যমে এককেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন। সে স্থলে আজ অসংখ্য ইংরেজির মাধ্যমে বিপুলসংখ্যক কিন্ডারগার্টেন প্রতিষ্ঠা করে ধনীর দুলালদের জন্য ভিন্নতর শিক্ষার ব্যবস্থা করে তাদের নিশ্চিত ও উন্নত ভবিষ্যৎ গঠনের বৈষম্যমূলক সুযোগ তৈরি করা হয়েছে। আরবি ভাষার মাধ্যমে শিক্ষার জন্য তৈরি হয়েছে হাজার হাজার মাদ্রাসা। বঙ্গবন্ধু প্রবর্তিত ড. কুদরত-ই-খুদা কমিশনের আজ তা বিস্মৃত। ফলে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় বাড়ছে। বিপুলভাবে বৃদ্ধি পেলেও শিক্ষার মানে ক্রমাগত অবনতি ঘটছে। মাতৃভাষার মাধ্যমে বাধ্যতামূূলক শিক্ষার অঙ্গীকারও আজ বিস্মৃত। শিল্পায়নের চিত্রও আশাব্যঞ্জক নয়। শিল্পায়নের দিকে তাকালে একদিকে যেমন আশাব্যঞ্জক ছবির সন্ধান পাওয়া যায় পোশাক ও ওষুধ প্রস্তুত শিল্পে, তেমনই আবার বিপরীত চিত্র চোখে পড়ে পাটকল, চিনিকল, কাপড়ের কলগুলো লোকসান দেখানোর অজুহাতে বিজাতীয়করণ করে ওই কারখানাগুলোতে কার্যত উৎপাদনহীন এবং শ্রমিকের বেকারত্ব বৃদ্ধি করা হচ্ছে। ব্যক্তিমালিকানায় যাওয়ার পর মালিকরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কারখানা, কলকব্জা, জমিসমেত বিক্রি করে দিয়ে ওই টাকা অধিকতর লাভজনক অন্য ব্যবসায়ে সরকারি নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বিনিয়োগ করছে। ফলে ওই পণ্যগুলো রপ্তানি করে যে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা যেত তাও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বস্তুত জাতীয়করণকৃত কারখানাগুলোতে প্রতিটি সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে যে মাথাভারি প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছিল, ওই প্রশাসন যে পরিমাণ দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল, কারখানাগুলো পুরাতন ও অকেজো হওয়ায় উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছিল, সে কারণেই লোকসানের কবলে পড়ে ছিল ওই কলগুলো। ব্যক্তি খাতে বিক্রি করে না দিয়ে যদি মাথাভারি প্রশাসনে কাটছাঁট করা যায়, দুর্নীতি বন্ধ করা যায় এবং কলকব্জার আধুনিকায়ন করা যেত তবে অবশ্যই সরকারি খাতে থেকেই মিলগুলো বেশি মুনাফা অর্জন করতে পারত, শ্রমিকদেরও বেকারত্বে পড়তে হতো না। তাই শিল্পক্ষেত্রে আবারো শক্তিশালী সরকারি ক্ষমতা বাড়ানো দরকার। এ ব্যাপারে সৎ ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনও উন্নয়নের সহায়ক হতে পারে। বাহাত্তরের সংবিধানের আলোকে উন্নয়নমুখী শিল্পনীতি গড়ে তোলা দেশের সার্বিক স্বার্থে অপরিহার্য। অপর হতাশামূলক দিক হলো সব ক্ষেত্রে দুর্নীতির ব্যাপক প্রসার। আন্তর্জাতিক এক পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে বাংলাদেশে কোটিপতির সংখ্যা দ্রুতই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কথা তো সবাই জানি, সৎপথে কারো পক্ষেই কোটিপতি হওয়া সম্ভব না। সুতরাং রাতারাতি চোরাপথে কোটিপতি হওয়ার কারণেই বিদেশে বেআইনি পন্থায় লাখ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়ে যাওয়ার কাহিনী প্রায় প্রতিদিনই জাতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে সরকারকে অত্যন্ত কঠোর হতেই হবে। দুর্নীতি বন্ধ হলে জাতীয় উন্নয়নে আমরা উল্লম্ফন দেখতে পাব। বায়ান্ন থেকে একাত্তর ছিল বাঙালির আন্দোলন সংগ্রামের স্বর্ণযুগ। তারই সাফল্য আজকের উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি। কিন্তু আমরা যেন ভুলেই গেছি বিগত দিনের ওই স্বর্ণোজ্জ্বল আন্দোলনকে রসদ জুটিয়েছে, প্রেরণা জুগিয়েছে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলন-সংগীত, নৃত্য, নাটক, বাউল সংগীত, জারি, সারি, কবি গানের আসর প্রভৃতি। বাঙালি সংস্কৃতির এই সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য খাতটি আজ মারাত্মকভাবে অবহেলিত। সহজ কথায় অনেকে বলতে পারেন, করোনা সংক্রমণের আশঙ্কা থেকেই এমনটি ঘটেছে। এই বক্তব্যকে সরাসরি অস্বীকার করে জাতীয় বাজেটে বিগত এক যুগের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় খাতের বরাদ্দের প্রতি নজর দিলেই দিব্যি বোঝা যাবে উপেক্ষার গভীরতা। যে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে দেশব্যাপী গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছিল, আজ ওই সাংস্কৃতিক জোটও নীরব পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর অবদান ও বিপুলভাবে উল্লেখযোগ্য বাংলাদেশের প্রগতিশীল আন্দোলনে দেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলন শুধু আমাদের অতীতের রাজনৈতিক আন্দোলনের বিকাশেই ভূমিকা রাখেনি- সমাজের সব পশ্চাৎপদতা, ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধেও বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে আমাদের সভ্যতা বিকাশেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। স্পষ্টতই দেখা যায়, সাংস্কৃতিক আন্দোলন যখনই জোরদার হয়ে উঠেছে সমাজে তখন নারী অপহরণ-ধর্ষণসহ নানাবিধ সামাজিক ব্যাধি থেকেও বহুলাংশে মুক্ত থাকতে পেরেছে বাঙালি সমাজ। সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ব্যাপকতা ঘটলে নারী-অপহরণ, ধর্ষণ, লুটপাট প্রভৃতি নানা অপরাধও তুলনামূলকভাবে অনেক কম সংঘটিত হয়। মানুষের রুচিবোধ, শালীনতাবোধ প্রভৃতিও বৃদ্ধি পায়। ফলে বাঙালি সভ্যতাই নতুন উচ্চতায় অধিষ্ঠিত হয়। কিন্তু আজ সে ক্ষেত্রেও মারাত্মক শূন্যতা। কৃষি আমাদের প্রধান আর্থিক সেক্টর। ১৬/১৭ কোটি বাঙালির আহারাদির জোগান দেয়ার পরও শাক-সবজি, নানা জাতের মাছ, বিশেষ করে ইলিশ ও হিমায়িত মাছ আমাদের কৃষি খাতে রপ্তানি পণ্য। এছাড়াও উন্নতমানের চালও অল্প পরিমাণে রপ্তানি হয়ে থাকে। কিন্তু কৃষিক্ষেত্রে আরো ব্যাপক উন্নয়নের সুযোগ রয়েছে। নদীপ্রধান এই দেশটি আজ নদীহীন হয়ে পড়েছে। বেআইনি দখলদারের প্রতাপে সব নদীই আজ শীর্ণকায়। নদীর উভয় পাশে বহুতলবিশিষ্ট দালান-কোঠা, বসতি, বাণিজ্যিক এলাকা ও মসজিদ গড়ে তোলা হয়েছে। এগুলো উদ্ধারে অনুকূলে হাইকোর্টের ঐতিহাসিক রায় ঘোষিত হওয়ার পর দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও ঢাকা শহরের কোনো কোনো এলাকা ব্যতীত দেশব্যাপী এ ব্যাপারে চোখে পড়ার মতো কোনো উদ্যোগ নেই। অথচ নদ-নদী-খাল-বিল দখলমুক্ত ও ব্যাপক খননের ফলে দেশের অসাধারণ উন্নতি হতে পারে। নৌপরিবহনের প্রসার ঘটলে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন ব্যয় বিপুলভাবে কমে আসতে পারে, শস্যক্ষেত্রেও সেচ কার্যের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হয়ে কৃষি পণ্যের উৎপাদন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে এবং তার ব্যয়ও কমে আসতে পারে। তদুপরি বৈপ্লবিক উন্নয়ন ঘটতে পারে মৎস্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে। এক কথায় নদ-নদীর স্বাভাবিক প্রস্থ ও গভীরতা সৃষ্টি করে স্রোতস্বিনী নদী দেশের উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রাখতে পারে। জলবিদ্যুৎ উৎপাদনেও যথেষ্ট সুযোগ বৃদ্ধি পেতে পারে। সার্বিক উন্নয়ন সম্ভাবনা খতিয়ে দেখে তার সর্বাত্মক ব্যবহারের পথ অনুসন্ধানই হতে পারে মুক্তিযুদ্ধের রজতজয়ন্তী উদযাপনের প্রকৃষ্ট পন্থা। বাহাত্তরের সংবিধানে সমাজতন্ত্র রাষ্ট্রীয় চার মৌলনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মৌলনীতি হিসেবে গৃহীত হয়েছিল। বামপন্থি রাজনৈতিক দল ও তাদের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন তো বটেই, বঙ্গবন্ধু তাঁর অসংখ্য ভাষণে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। তাই সমাজতন্ত্রকে পাশ কাটিয়ে না গিয়ে তাকে বরং আঁকড়ে একটি শোষণমুক্ত উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের নতুন যাত্রা শুরুর মাধ্যমেই হোক মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত উদযাপন। রণেশ মৈত্র : রাজনীতিক ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App