×

স্বাস্থ্য

স্বাস্থ্যনীতিতে নেই যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবার কথা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৩ ডিসেম্বর ২০২১, ০৯:০১ এএম

প্রতিবন্ধীদের অধিকার নিশ্চিতে দেশে এমন অনেক কিছু রয়েছে যা না থাকারই সমান। প্রতিবন্ধী নারীদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যর বিষয়টি তেমনই বিষয়। জাতীয় স্বাস্থ্য নীতিমালা-২০১১ থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই সেবার বিষয়টি রয়ে গেছে অনুপস্থিত। জাতিসংঘ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, মনোসামাজিক, শারীরিক ও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী নারীদের খুব সঙ্গত কারণেই বিশেষ ধরনের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা প্রয়োজন। এর মধ্যে পিরিয়ডকালীন পরিচর্যা, জন্ম প্রতিরোধ বা বিরতিকরণ পরামর্শ ও সেবা, নিরাপদ গর্ভপাত, গর্ভপাতোত্তর সেবা, বন্ধ্যাত্বকালীন, গর্ভকালীন, প্রসবকালীন ও প্রসবোত্তর সেবা, যৌন রোগসহ প্রজননতন্ত্রের যে কোনো প্রদাহ প্রভৃতি সবই অন্তর্ভুক্ত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে সরকারের পাশাপাশি অনেক বেসরকারি সংস্থা অপ্রতিবন্ধী নারীদের পিরিয়ডকালীন পরিচর্যা ও প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে। কিন্তু সেই কার্যক্রমে প্রতিবন্ধী নারীরা অবহেলিত।

জন্মগত পোলিওর কারণে পঙ্গুত্বের জীবনযাপন করছেন ছন্দা দে (৩২)। শারীরিকভাবে চলাচলে অক্ষম ছন্দার জীবনে এখনো সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক দিন হচ্ছে পিরিয়ড চলাকালীন দিনগুলো। প্রতি মাসে ৪-৫ দিন ছন্দার মায়ের কষ্ট যেন আরো বেড়ে যায়। পিরিয়ড শুরুর দিনের স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে ছন্দা বলেন, আমার বয়স তখন ১৪। ছোট কাকার বিয়ে উপলক্ষে আমরা গ্রামের বাড়িতে ছিলাম। বাড়িভর্তি লোকজন। সবাই বিয়ের আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত। বাইরে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি। আমি বিছানায় বসা। এক সময় দেখলাম বিছানায় ও আমার জামায় রক্ত। ভয়ে চিৎকার করে মাকে ডাকলাম। কাজ ফেলে দৌড়ে আসতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে মার পায়ের নখ উল্টে গিয়েছিল। সবাই মাকে নিয়েই ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। মাকে দেখতে না পেয়ে আমিও ছটফট করছিলাম। পরে মা কাছে এলে বিষয়টা তাকে বললাম। মা পুরো ব্যাপারটাকে ম্যানেজ করলেন। আমাকে পুরো বিষয়টা বোঝানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু আমার অস্বস্তি ও ভয় যেন কিছুতেই কাটছিল না। এখনো আমার পিরিয়ড মানে মার কষ্ট বেড়ে যাওয়া।

তবে বাকপ্রতিবন্ধী বেবী আক্তারের অভিজ্ঞতা ভিন্ন। বেবীর বড় বোন রুবি বেগম বলেন, আমরা গ্রামের মেয়ে। প্রজনন স্বাস্থ্য বা পিরিয়ড নিয়ে কথা বলা বা এসব সম্পর্কে জানার সুযোগ কম। পিরিয়ড হওয়ার পর মা খালাদের কাছ থেকে এ বিষয়ে প্রথম জানতে পারি। এর আগে এ নিয়ে ধারণা খুব একটা ছিল না। বেবীর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। ১৫ বছর বয়সে বেবীর প্রথম পিরিয়ড হয়। একে তো বাকপ্রতিবন্ধী তার ওপর পিরিয়ড শুরুর পর বেবীর চলাচলের পরিধি অনেকটাই সংকুচিত হয়ে আসে।

ছন্দা ও বেবীর মতো অসংখ্য নারীর পিরিয়ড হওয়ার আগে এ বিষয়ে জ্ঞান থাকে না। শুধু প্রতিবন্ধী নারীর বেলায় নয় সুস্থ স্বাভাবিক নারীর ক্ষেত্রেও বয়ঃসন্ধিকালে পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পিরিয়ড নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হয় না। পিরিয়ড হওয়ার পর মা, খালা, দাদি, নানির কাছ থেকে এ বিষয়ে ধারণা পান। তবে সেই ধারণাতেও থেকে যায় অনেক ফারাক। প্রতিবন্ধী নারীর ক্ষেত্রে প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা এবং এ বিষয়ে তথ্য পাওয়ার পরিধিটা অনেক সীমিত।

জাতীয় স্বাস্থ্য নীতিমালা-২০১ এর ১৫টির মধ্যে ১৩তম উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে, ‘মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধী ও বয়স্ক মানুষের জন্য বিশেষ স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা করা’ হবে। কিন্তু এ নিয়ে সুস্পষ্ট কোনো ধারণা দেয়া হয়নি। সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রতিবন্ধী নারী-সহায়ক সেবার কোনো ব্যবস্থাও নেই। এই নীতিমালার কর্মকৌশলে ৩১ নম্বর অনুযায়ী মনোসামাজিকসহ অন্য সব ধরনের প্রতিবন্ধী মানুষের স্বাস্থ্যসেবার উন্নতি সাধনে বিশেষ স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচি তৈরির উদ্যোগ নেয়া হবে বলা হয়েছে। কিন্তু সেই নীতিমালায় প্রতিবন্ধী নারীদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ে আলোকপাত করা হয়নি। তবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অধিকার ও সুরক্ষা আইন-২০১৩ এর প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার সংক্রান্ত ধারা ১৬ তে প্রতিবন্ধী মানুষের বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন ও পরিবার গঠনসহ সন্তান বা পরিবারের সঙ্গে সমাজে বসবাসের অধিকার নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। যদিও প্রতিবন্ধী নারীর মাসিককালীন পরিচর্যা ও প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার এখানেও উপেক্ষিত। এমনকি জাতীয় বাজেটে প্রতিবন্ধী নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্য খাত বঞ্চিত।

বিশ্ব জনসংখ্যা প্রতিবেদন ২০১০-এর তথ্য অনুযায়ী, পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ প্রতিবন্ধী মানুষের মধ্যে ১০ শতাংশ প্রজননসক্ষম নারী, যাদের অধিকাংশই উন্নয়নশীল দেশের নাগরিক। তথ্য-উপাত্ত থেকে জানা যায়, প্রতিবন্ধী নারীদের যৌন (মাসিক পরিচর্যা) ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবামূলক আলোচনার শুরুটা হয় সত্তর দশকের দিকে। সমাজে প্রচলিত একটি ধারণার ওপর গবেষণায় আলোকপাত করে সেখানে বলা হয়েছে, প্রতিবন্ধী নারীদের কোনো যৌন চাহিদা রয়েছে, এমনটা ভাবতে পারে না সমাজ। সত্তর দশকের প্রাপ্ত সেই পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সেখানকার ৮০ শতাংশের বেশি অভিভাবক এবং সাহায্যকারী সেবাকর্মী অপারেশনের মাধ্যমে স্থায়ী জন্মনিয়ন্ত্রণ উপযোগী ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রতিবন্ধী নারীদের মাসিক নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। বিশেষত বুদ্ধি ও মনোসামাজিক প্রতিবন্ধী নারীদের ক্ষেত্রে এটি বেশি করা হতো। ১৯৯৪ সালে কায়রোতে অনুষ্ঠিত ‘আন্তর্জাতিক জনসংখ্যা ও উন্নয়নবিষয়ক সম্মেলন’ (আইসিপিডি) এর ঘোষণাপত্রে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছিল ‘প্রজনন স্বাস্থ্য তথ্য ও সেবা প্রত্যেক নারীর আইনগত ও মানবিক অধিকার; এটি কোনো সুবিধা অথবা দয়া নয়।’ ২০০৬-এ জাতিসংঘ আয়োজিত ‘প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকারবিষয়ক সম্মেলন’-এর ঘোষণাপত্রের ২৫ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রতিবন্ধী মানুষেরও রয়েছে অপ্রতিবন্ধী মানুষের মতোই একই রকম যৌন এবং প্রজনন স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির অধিকার। বাংলাদেশ সরকার ২০০৮ সালে জাতিসংঘের প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার সনদে অনুসমর্থন করে। বাংলাদেশ সরকারের নারী উন্নয়ন নীতিমালার ৩৯ নম্বর ধারায় প্রতিবন্ধী নারীদের একীভূত হওয়ার বিষয়ে খানিকটা উল্লেখ থাকলেও, কোথাও নেই তাদের পরিবার গঠনসহ প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকারের বিষয়টি।

প্রতিবন্ধী কিশোরীদের পিরিয়ডকালীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার জন্য পরীক্ষামূলকভাবে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করে রেড অরেঞ্জ মিডিয়া এন্ড কমিউনিকেশন্স নামের একটি প্রতিষ্ঠান। আলোর যাত্রা নামের এক বছর মেয়াদি এই প্রকল্প পরিচালিত হয় ঢাকার ছয়টি বিশেষ স্কুলে। এ প্রসঙ্গে প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অর্নব চক্রবর্তী ভোরের কাগজকে বলেন, সাধারণভাবেও যদি বলি তাহলে বলতে হয় এ বিষয়ে নারীদের ধারণা এখনো অনেক কম। প্রতিবন্ধী নারীর ক্ষেত্রে এটি আরো কম। প্রতিবন্ধী নারীরা পুরোপুরি আমাদের ওপর নির্ভরশীল। পিরিয়ডকালীন পরিচর্যা ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে না জানা ও না বুঝার কারণে তারা প্রতি মাসে ভয়াবহ সমস্যার সম্মুখীন হয়। আলোর যাত্রা প্রকল্পের মাধ্যমে আমরা চেষ্টা করছি প্রতিবন্ধী নারীদের জন্য একটি মাসিকবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা। যারা তাদের পরিচর্যা করছেন বাবা-মা কিংবা পরিবারের অন্য সদস্যরা, শিক্ষিকা তাদের সচেতনতা বাড়ানো। যাতে তারা বিষয়টি ভালো করে বুঝেন। পাশাপাশি আমরা চেষ্টা করছি তাদের কী জানা দরকার সেই বিষয়টিও জানার। জনসচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি এই প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন এনজিওর সঙ্গে কাজ করছি। যাতে করে প্রতিবন্ধী নারীদের জন্য একটি মাসিকবান্ধব পরিবেশ তৈরি হয়।

ওয়াটার এইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর হাসিন জাহান ভোরের কাগজকে বলেন, নারীর প্রজনন স্বাস্থ্যের এই বিষয়গুলো নিয়ে ২০২০ সালে প্রকাশিত ওয়াটার এইড বাংলাদেশের এক গবেষণায় দেখা গেছে, নিম্ন আয়ের পরিবারের নারী ও কিশোরীদের অধিকাংশই স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করে না। দেশের ৬৪ শতাংশ কিশোরী তাদের প্রথম পিরিয়ড হওয়ার আগে এই শারীরিক পরিবর্তনের কথা শুনেনি। যে নারীরা পুরনো কাপড় ব্যবহার করেন তাদের মধ্যে মাত্র ২০ ভাগ সেটিকে স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে ব্যবহার করার চেষ্টা করেন। প্রতিবন্ধী নারীর ক্ষেত্রে এই বিষয়টি আরো জটিল। আমাদের দেশে এখনো প্রতিবন্ধীবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত হয়নি। তাদের পিরিয়ডকালীন পরিচর্যার বিষয়টি আরো বেশি অবহেলিত। তাদের ব্যবহার উপযোগী করে প্যাড তৈরি ও টয়লেট ব্যবস্থাপনার ওপর জোর দেন তিনি।

প্রতিবন্ধী নারী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক আশরাফুন নাহার মিষ্টি ভোরের কাগজকে বলেন, প্রজনন স্বাস্থ্যসেবায় প্রতিবন্ধী নারীদের বিষয়টি এতদিন ধরে উপেক্ষিতই ছিল। ২০২০ সাল থেকে এই সেবার বিষয়টি সরকারের পরিবার পরিকল্পনা সেবার সঙ্গে ডিজঅ্যাবেলিটি ইনক্লুসিভ স্ট্যান্ডার্ড অপারেশনাল প্রসিডিওরে (এসওপি) যুক্ত করা হয়। এটি কীভাবে বাস্তবায়ন করা যায় সেই কৌশল তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। প্রতিবন্ধী নারীর প্রজনন স্বাস্থ্যর বিষয়টি বাজেটে গুরুত্ব পেলে এক্ষেত্রে বরাদ্দ থাকলে তা বাস্তবায়ন করা সহজ হবে। এর পাশাপাশি যারা প্রতিবন্ধী এবং তাদের প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের দৃষ্টিভঙ্গী বদলানো দরকার।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App