×

জাতীয়

চালের দাম বাড়ার নেপথ্যে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৩ ডিসেম্বর ২০২১, ০৮:৪৩ এএম

চালের দাম বাড়ার নেপথ্যে

ফাইল ছবি

  • ধান-চালের উৎপাদন ও বিপণনে তথ্যে গরমিল
  • দেশে ধান-চালের কোনো সংকট নেই

ভরা মৌসুমেও ক্রেতার পকেট কাটছে চাল। এ বছর বোরো ধান উৎপাদনে নতুন রেকর্ড করেছে। চলছে আমনের ভরা মৌসুম। এছাড়া চলতি বছর জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১০ লাখ ৬৫ হাজার টন চাল আমদানি করা হয়েছে। আর গত ২০২০-২১ অর্থবছরে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ১৩ লাখ ৫৯ হাজার টন চাল আমদানি হয়েছে। বর্তমানে সরকারের গুদামে ১৫ লাখ টন খাদ্যশস্য মজুত আছে। এর মধ্যে চাল ১২ দশমিক ৩২ লাখ টন ও গম ২ দশমিক ৭৬ লাখ টন। হিসাব অনুযায়ী, দেশে ধান-চালের কোনো সংকট নেই। তবুও বাড়ছে চালের দাম। কিন্তু কেন বাড়ছে? এর কোনো সদুত্তর নেই সংশ্লিষ্টদের কাছে।

চালের বাজার ঊর্ধ্বমুখী দীর্ঘদিনের। দায় চলে আসে চাতাল বা মিল-মালিকদের ওপর। কিন্তু দাম নিয়ন্ত্রণে যথাযথ বাজার মনিটরিং নেই সংশ্লিষ্টদের। তারা কেবল হুঁশিয়ারি আর কমিটি গঠন করেই দায় সারছেন।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, দাম কমার কোনো লক্ষণ নেই। একদিকে উচ্চ আমদানি, অন্যদিকে সরকারি পর্যায়ে বোরো ধানের চাল কেনার পরিসর বাড়ার কারণে রাষ্ট্রীয় গুদামগুলোতে চালের মজুত নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। এদিকে চালের দাম নিয়ন্ত্রণে আগামী ২৯ ডিসেম্বর খাদ্য মন্ত্রণালয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করবে বলে জানা গেছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম বলেন, চালের দাম বাড়ার কারণ সুনির্দিষ্টভাবে বলা যাচ্ছে না। আমদানি বেড়েছে কিন্তু যতটা অনুমোদন দেয়া হয়েছে ততটা নয়। কৃষক যাতে ন্যায্যমূল্য পান তার জন্য আমদানি শুল্ক আগের স্তরে আনা হয়েছে মন্তব্য করে খাদ্য সচিব আরো বলেন, দাম বাড়লে আমরা আবার আমদানি শুল্ক কমানোর কথা ভেবে দেখব। এ বিষয়ে আগামী বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চলতি বছর বোরোর উৎপাদন গত বছরের তুলনায় ১১ লাখ টনেরও বেশি হয়েছে। গত বছর উৎপাদন হয়েছিল ১ কোটি ৯৬ লাখ টন। চলতি বছর বোরোতে ২ কোটি ৫ লাখ টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। হয়েছে ২ কোটি ৭ লাখ ৮৪ হাজার ৫০৮ টন। চলছে আমন মৌসুম। কৃষি বিভাগ বলছে আমনের এবার ভালো ফলন হয়েছে। এর বাইরে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১০ লাখ ৬৫ হাজার টন চাল আমদানি করা হয়েছে। আর গত ২০২০-২১ অর্থবছরে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ১৩ লাখ ৫৯ হাজার টন চাল আমদানি হয়েছে। বর্তমানে সরকারের গুদামে ১৭ দশমিক ১৩ লাখ টন খাদ্যশস্য মজুত আছে। এর মধ্যে চাল ১৩ দশমিক ৯১ লাখ টন ও গম ৩ দশমিক ১৬ লাখ টন। ফলে দেশে ধান-চালের কোনো সংকট নেই। তবুও বাজারে কমছে না চালের দাম। ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকার ধান কিনতে থাকলে চালের দাম এর চেয়ে কমবে না।

টিসিবির তথ্য বলছে, গতকাল বুধবার বাজারে প্রতি কেজি মোটা চাল স্বর্ণা কেজিপ্রতি খুচরা মূল্য ছিল ৪৫ টাকা থেকে ৫০ টাকার মধ্যে। দেশের সিংহভাগ মানুষ এই চাল কেনেন। গত নভেম্বর মাসে কেজিপ্রতি মোটা চালের দাম ছিল ৪৪-৪৮ টাকা। দেশের মানুষের কাছে প্রধান খাদ্য হিসেবে বিবেচিত চালের এই ঊর্ধ্বমুখী দরের ভেতরেই আমন ধান কাটা চলছে।

প্রতিবেদনে আরো দেখা গেছে, চিকন চালের দাম ৫৮-৬৮ টাকা কেজি ও মাঝারি ৫০-৫৬ টাকা কেজি। খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, আমনের ভরা মৌসুমে চালের দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই। কেউ কারসাজি করে চালের দাম বাড়ালে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। কারণ চলতি বছর জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১০ লাখ ৬৫ হাজার টন চাল আমদানি করা হয়েছে। আর গত ২০২০-২১ অর্থবছরে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ১৩ লাখ ৫৯ হাজার টন চাল আমদানি হয়েছে। বর্তমানে সরকারের গুদামে পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য মজুত রয়েছে। ফলে দেশে ধান-চালের কোনো সংকট নেই।

তবে কেউ কেউ বলছেন, ধান-চালের উৎপাদন ও বিপণনে তথ্যের গরমিল রয়েছে। এই কথাটি অবশ্য খোদ বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন। এমনকি কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্তা-ব্যক্তিরাও একাধিকবার বলেছেন। চালের দাম ঊর্ধ্বমুখীর পেছনে চাতাল মালিক ও ব্যবসায়ীদের ওপর দায় এলেও উৎপাদন ও বিপণন তথ্যের গরমিলও অন্যতম কারণ বলেই মনে করা হয়।

চালের দাম বাড়তে থাকার জন্য বড় বড় কোম্পানিগুলোকে দায়ী করলেন বাংলাদেশ অটো রাইসমিল ওনার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি এ কে এম খোরশেদ আলম খান। ভোরের কাগজকে তিনি বলেন, চাল ব্যবসায়ীদের সঠিক কোনো নীতিমালা নেই। আর এ কারণে এ খাতে কোনো শৃঙ্খলা নেই বললেই চলে। তিনি বলেন, মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো প্রয়োজনের বেশি ধান কিনে মজুত করছে। নীতিমালা থাকলে এটা নিয়ন্ত্রণ করা যেত। তিনি বলেন, আমন ধান এখনো কাটা শেষ হয়নি। অথচ এর মধ্যেই কেজিতে প্রায় ৪ টাকা দাম বেড়ে যাওয়া চিন্তার বিষয়। খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা দেয়া আছে, ৩০ দিনের বেশি মজুত করে রাখা যাবে না। আমার মতে, ৩০ দিন না করে ৭ দিনের জন্য মজুতের সুযোগ দিলে কিছুটা দাম কমতে পারে।

তিনি আরো বলেন, বড় বড় কোম্পানিগুলো প্রতিদিন ২০০-৩০০ কেজি ধান কিনে গোডাউনে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেই পরিমাণে চাল তৈরি করে বাজারে দিচ্ছে না। দাম বাড়ার এটাও একটি অন্যতম কারণ বলে জানান তিনি।

চালের দাম প্রসঙ্গে সম্প্রতি খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার সম্প্রতি বলেছেন, বর্তমানে সরকারের গুদামে যথেষ্ট পরিমাণে খাদ্যশস্যের মজুত রয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তায় এই মজুত বাড়াতে সরকার সচেষ্ট। তিনি বলেন, কেউ যেন অবৈধ মজুত করে খাদ্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি করতে না পারে সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। কোনো কারণ ছাড়া চালের দাম বাড়ালে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।

উল্ল্খ্যে, গত বোরো ধানের মৌসুম থেকেই চালের দর বাড়তি। বাধ্য হয়ে সরকার গত আগস্টে চালের আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ কমিয়ে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করে। পাশাপাশি পণ্যটি আমদানিতে সব ধরনের নিয়ন্ত্রকমূলক শুল্কও প্রত্যাহার করা হয়েছিল। তারপরও বাজারে চালের দাম কমেনি।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এ বছর আমন ধানের সরকারি ক্রয়মূল্য প্রতি কেজি ২৭ টাকা, চালের মূল্য প্রতি কেজি ৪০ টাকা এবং গমের মূল্য প্রতি কেজি ২৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। ২০১৯ সাল থেকে আমন মৌসুমে চালের পাশাপাশি ধানও সংগ্রহ করা হচ্ছে। এতে মাঠপর্যায়ে ধানের দাম ভালো পাচ্ছে কৃষক। প্রধান রপ্তানিকারক দেশগুলোতে চালের দাম কমে যাওয়ায় আমদানি বেড়েছে। এ সময়ে বাংলাদেশেও ধানের উৎপাদন বেড়েছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ফসল বোরোর উৎপাদন গত অর্থবছরে ১ দশমিক ২ শতাংশ থেকে বেড়ে ১ কোটি ৯৯ লাখ টনে দাঁড়িয়েছে।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, গত ১০ অক্টোবর রাষ্ট্রীয় গুদামগুলোতে চালের মজুত ছিল ১৩ লাখ ৭০ হাজার টন। গত বছরের একই দিনে এর পরিমাণ ছিল ৮ লাখ ২ হাজার টন। ১০ নভেম্বর গুদামগুলোতে চাল ও গমের সমন্বিত মজুত ১৫ লাখ ২৬ হাজার টনে পৌঁছেছে। গত জানুয়ারিতে এর পরিমাণ ছিল ৮ লাখ টন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App