×

মুক্তচিন্তা

কেমন চলছে বেসরকারি হাসপাতালগুলোর চিকিৎসাসেবা

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২২ ডিসেম্বর ২০২১, ০১:৩৮ এএম

‘আপনি একটু ঘুমান তো। রাত হয়েছে। লক্ষ্য করছি আপনি কেবল ছটফট করছেন। চোখ বুজে শান্ত মনে শুয়ে থাকুন ঠিক ঘুম আসবে। আমি বসে আছি, বসে থেকে আপনার ঘুম দেখব।’ কথাগুলো শুনে অবাক হই না। এই তো আদর্শ সেবিকার ভূমিকা। এমন মানসিকতা ও মানবীয় চরিত্র নিয়েই তো চিকিৎসাসেবার অঙ্গনে তথা হাসপাতালে আদর্শ, মানবিক চরিত্রের সেবিকা শ্রেণির উদাহরণ সৃষ্টি। কানে বাজছে পাবনার মেয়ে নবীনার কণ্ঠস্বর। ঘটনাস্থল ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতাল, স্পেশালাইজড হাসপাতাল শুধুমাত্র হৃদরোগীদের জন্য। কদিন থেকে শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না, বিশেষ করে ব্লাডপ্রেশার অর্থাৎ রক্তচাপের খেয়ালখুশি মতো আচরণে, মূলত সিস্টোলিক চাপটি। তিনি তো ঊর্ধ্বস্থানে, তবু সন্তুষ্টি নেই। মেজাজমর্জি খচড়া। কখনো উচ্চ শিখরে, কখনো সমতলে তরাইয়ে, ক্বচিৎ আরো নিম্নমুখী। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে নাড়ি (পালস) তথা হার্ট রেটের আচরণও নৈরাজ্যক, বিশেষ করে বিকাল থেকে রাতে। অবস্থাদৃষ্টে আমি দিশাহারা। ইতোমধ্যে হার্টের সব পরীক্ষা করিয়ে এসেছি বিশিষ্ট হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সিরাজুল হকের নির্দেশে- সব স্বাভাবিক। উনি আশ্বস্ত করে ব্যবস্থাপত্র দিয়ে দিলেন। এর মধ্যে দিনশেষে এই অঘটন। রক্তচাপের সঙ্গে বুকে ব্যথা, স্প্রে ব্যবহারের পরও। স্বভাবতই আমি বিচলিত। রাত দুপুরে হার্টঅ্যাটাক হলে তৎক্ষণাৎ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার মতো কেউ নেই। সিরাজুল হক সাহেবের পরামর্শ এক্ষুনি ইব্রাহিম কার্ডিয়াক ইমারজেন্সিতে চলে যান, আমি রসিদ সাহেবকে আপনার পরিচয় দিয়ে বলে দিচ্ছি, উনি নিশ্চয়ই ব্যবস্থা নেবেন। একটা সুযোগ এসে গেল এই হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা, রোগী সেবার ব্যবস্থাপনা দেখে নেয়ার। ইতোপূর্বে দু-একটি বেসরকারি হাসপাতালের পূর্বোক্ত ব্যবস্থা দেখে নেয়ার সুযোগ হয়, তার ব্যবস্থা সন্তোষজনক মনে হয়নি। আমি একজন ডাক্তার। চিকিৎসাসেবার আদর্শ ও মেডিকেল এথিকস নিয়ে সদাই ভাবি, পড়াশোনা করি, আমাদের বেসরকারি হাসপাতালগুলোর ব্যবস্থা নিয়ে ক্ষুব্ধ হই। করোনাকালে তাদের আচরণে দুর্ভাগ্যজনক কয়েকটি অবাঞ্ছিত মৃত্যু নিয়ে কলাম লিখেছি কয়েকবার। তাতেও সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের টনক নড়েনি। তারা নড়েচড়ে বসা ও প্রতিকারের প্রয়োজন বোধ করেননি। করোনার পিক-আওয়ারে ট্রাজিক কয়েকটি অঘটনের খবর দৈনিক পত্রিকায় ফলাও করে ছাপা হয়েছিল। বিশেষ করে বিশিষ্ট হাসপাতালে প্রত্যাখ্যাত হয়ে একজন সরকারি অতিরিক্ত সচিবের করুণ মৃত্যু এবং তার ডাক্তার কন্যার ক্ষোভ ও বিষাদ আমার মনে গভীর দাগ কেটেছিল। লেখা ছাড়া আমার করার কিছু ছিল না। এছাড়া কোমর ভেঙে গ্রিন লাইফে ভর্তি হয়ে অভিজ্ঞতাটাও সন্তোষজনক ছিল না। যদিও ডা. রিজভির অপারেশন ছিল পারফেক্ট। কিন্তু পোস্ট অপারেটিভে সেবার মানটা একরকম ছিল না। সেখানে ঘাটতি সেবিকা ও ডিউটি চিকিৎসকদের ক্ষেত্রে। অথচ এ পর্যায়টা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। দুই. ইব্রাহিম কার্ডিয়াকের সুনাম শুনেছি ইতোপূর্বে। আবার রফিকউল্লার ক্ষোভের কথাও শুনেছি বাইপাস সার্জারিতে ইনফেকশন হওয়ার কারণে। ওর ভাষায়, ‘আমার নয় শুধু, আরো কয়েকজনের একই অবস্থা।’ ঘটনা অবাঞ্ছিত। ঘাটতি কি স্টেরিলাইজেশনে? মনে পড়ে যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথের দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুর কথা। তাও বিধান রায় প্রমুখ প্রতিভাবানের তত্ত্বাবধান সত্ত্বেও অতি সাধারণ একটি অপারেশনে (যেটাকে অপারেশনও বলা চলে না সুপ্রাপিউবিক সিস্টোসটোমি নামটা বড়, কিন্তু বিষয়টা তলপেটে একটি ছিদ্র করা) ইনফেকশন, প্রচণ্ড জ¦র, সেপ্টেসেমিয়া ও মৃত্যু। বাঙালি শোকাহত, সচেতন মানুষ ক্ষুব্ধ। আসলে সার্জারিতে স্টেরিলাইজেশন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দরকার এদিকে সর্বোচ্চ নজর। না হলে প্রবাদবাক্য- ‘সাকসেসফুল অপারেশন, কিন্তু রোগীর মৃত্যুও।’ কথাগুলো ইব্রাহিম কার্ডিয়াক নয়, সব হাসপাতালের উদ্দেশে সতর্কবাণী হিসেবে বলা- আদর্শ সার্জারির নিরিখে। নির্বীজন সেখানে একটা বড় বিচার্য বিষয়। প্রথমেই বলে নিই, ইব্রাহিম কার্ডিয়াকে আমার এ প্রথম ভর্তি, হাসপাতাল সম্বন্ধে আমার অনীহা বরাবরের, তাই কিছুটা ভয় তো ছিলই মনে- অস্বীকার করব না। কিন্তু ইমারজেন্সি থেকে ‘সিসিইউ, প্রায় মাত্র তিন দিনের অভিজ্ঞতা আমার- তাতে বিন্দুমাত্র অভিযোগের অবকাশ ছিল না। সর্বোচ্চ চিকিৎসক থেকে কর্তব্যরত চিকিৎসক এবং বিশেষজ্ঞ সেবিকাদের কর্তব্য পালনে। আমার নিজের হাসপাতাল বাসের অভিজ্ঞতা কম। কিন্তু পরিবারের অন্যদের, এমনকি নিকট আত্মীয়দের হাসপাতালে চিকিৎসাসেবার অভিজ্ঞতা অনেক- কী পাবলিক হাসপাতাল, কী বেসরকারি ক্লিনিক বা হাসপাতাল। ভাবতে গেলে হৃদয়ে রক্ত ঝরে আমার নিজ শিক্ষায়তনিক হাসপাতালের কয়েকটি ঘটনায়। সেখানে এবং অন্যান্য ক্ষেত্রেও বড় সমস্যা একটি শব্দে প্রকাশ করা যায়- অবহেলা। শব্দটি যদি কারো বিচারে কঠোর মনে হয়, তাহলে একটি বাক্যে বলা যায়- দায়িত্ব পালনে যথাযথ মনোযোগ বা আন্তরিকতার অভাব। অথবা বলা যায় কর্তব্য পালনে ঘাটতি। বলাই বাহুল্য এটা সর্বক্ষেত্রে এবং সর্বজনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, ব্যতিক্রমের সংখ্যা একমাত্র জরিপের মাধ্যমে নির্ধারণ করা সম্ভব। যে কয়েকটি ট্রাজিক ঘটনা আমার অভিজ্ঞতায় রয়েছে সেগুলোকেই বরং ব্যতিক্রম ভেবে নিতে পারলে স্বস্তিবোধ করি। করোনাকালে আমাদের চিকিৎসা অঙ্গনের দুর্বলতাগুলো, অমানবিকতার উদাহরণগুলো সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে। স্বাস্থ্য বিভাগ এসব নিয়ে মাথা ঘামায়নি, এমনকি ট্রাজিক ঘটনা নিয়েও। প্রকাশ পেয়েছে ব্যাপক ও ভয়ানক দুর্নীতির, যেখানে চিকিৎসকও সংশ্লিষ্ট। সেগুলোর অবশ্য বিচার হচ্ছে। অন্যদিকে করোনা রোগীর বহুসংখ্যক চিকিৎসকের আত্মদানের মহৎ ঘটনা চিকিৎসক সমাজের জন্য গৌরবের। অন্তত কয়েকটি ঘটনা তো আমার ব্যক্তিগত পরিচয়ের মধ্যে পড়ে। করোনাকালের প্রসঙ্গ থাক। সাধারণভাবেও হাসপাতালে চিকিৎসাসেবায় এক কথায় অবহেলার দিকটি নিয়ে সাধারণ মানুষের অভিযোগ কম নয়। সে অভিযোগ যেমন সেবিকার ক্ষেত্রে, তেমনি কর্তব্যরত চিকিৎসকদের ক্ষেত্রে। ব্যতিক্রমীদের কথা আলাদা। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে সচেতন হবে, পরিকল্পিতভাবে ব্যবস্থা নেবে, সেবিকা ও চিকিৎসকদের আদর্শিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেবে- যাতে তারা কর্তব্য কর্মে নীতি ও নৈতিকতা সম্বন্ধে সচেতন হয় এবং সেই নিরিখে সক্রিয় হয়। বিশদ বিবরণে না গিয়ে এখানেই সমস্যার ইতি টানি এবং আমার এবারকার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় ফিরি, যে অভিজ্ঞতার এক চিলতে বক্তব্য দিয়ে এ লেখাটা শুরু করেছি। তিন. এ লেখার পাঠক ভাবতে পারেন, আমি কেবল সমালোচনাই করেছি হাসপাতালগুলোর চিকিৎসাসেবা, রোগী সেবা নিয়ে। বস্তুত তা নয়। নিজের এবং নেতিবাচক অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এবং এ বিষয়ে সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন, খবর বা লেখালেখির ওপর নির্ভর করে সাধারণ মাত্রার ধারণা প্রকাশ করেছি মাত্র- পরিস্থিতির গভীরে প্রবেশ করিনি অনুসন্ধানী সাংবাদিকের মতো। কারণ সাংবাদিকতা আমার পেশা নয়- নিজের, অন্যের এবং ধারকরা অভিজ্ঞতার সারাৎসার প্রকাশ করেছি মাত্র। ইচ্ছা পূরণের সুযোগ নেই, কারণ আমি সাহিত্যিক। কিন্তু হলফ করে বলতে পারি এ লেখায় কল্পনার কোনো প্রশ্রয় নেই। এবার ইব্রাহিম কার্ডিয়াকের অভিজ্ঞতা উদ্ধৃত করে লেখা শেষ করছি। ইমারজেন্সির নিয়মতান্ত্রিক আন্তরিক কর্মকাণ্ড শেষে সিসিইউর (চার তলার) কোণের একটি পছন্দসই বেডে শুয়ে সেবিকাদের বিরামহীন ছোটাছুটি এবং ডিউটি ডাক্তারদের গম্ভীর কর্মরত পদচারণা লক্ষ্য করে যখন প্রসন্ন মনে ভাবছি, মনে হয় এখানকার অভিজ্ঞতা বোধহয় অসন্তোষজনক হবে না, ঠিক তখনই একজন সিস্টারের (সেবিকার) বক্তব্য কানে এলো : স্যার, আমরা এখানেই আছি, যখন দরকার হয় ডাকবেন, সংকোচ করবেন না, আমি তখনি এসে যাব। পরে এই আসা-যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে জেনেছি এই সিস্টার নরসিংদীর মেয়ে, নাম শামসুন্নাহার। আমি একটু চমকাই। প্রথমত এই সেবিকার বিনয়নম্র ব্যবহারে, দ্বিতীয়ত নানা কারণে ও আসা-যাওয়ার কারণে নরসিংদীর স্মৃতি আমার জীবনে বিশিষ্ট হয়ে আছে। ভুলি কেমন করে ছাত্রজীবনে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার পথে লঞ্চের জন্য অপেক্ষমাণ ঘণ্টাগুলো রানুদির আন্তরিক আতিথেয়তার মাধুর্যে ভরে তোলার কথা। উনি এখন কোথায় আছেন, কেমন আছেন জানি না, ভাবতে গেলে মনটা বিষণ্ন হয়ে যায়। এ তরুণী কি সেই উত্তরাধিকার বহন করছে? তার শিফটের ডিউটিতে সময়ে-অসময়ে আমার খবর নিয়েছে শামসুন্নাহার সেবার আন্তরিকতায়। একইভাবে অবাক হয়েছি ডিউটি ডাক্তার ইকবালের আন্তরিক জিজ্ঞাসাবাদে, প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন সহজ সারল্যে, অকারণে মাঝে মাঝে এসে আমার সুবিধা-অসুবিধার খবর নিয়েছেন। আশ্চর্য, ডিউটি শেষে চলে যাওয়ার সময় দেখা করে বলেছেন এখন যাচ্ছি, কাল ডিউটির সময় দেখা হবে। আপনার কথা বলে যাচ্ছি আমার রিপ্লেসমেন্টকে। সিস্টারকে। সত্যি আমি বিস্মিত। কারণ এ পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে এদের গাম্ভীর্য নিয়ে চলতে। সহজে এদের দেখা মেলে না। আমাকে হলটর টেস্টের জন্য ৫ তলায় পাঠানো হলে ডাক্তার ইকবাল এসে দেখা করে গেছেন, জানতে চেয়েছেন; কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা, বলেছেন, আপনার ছুটির সময় দেখা করব। সম্ভবত সে সময় তিনি অফ-ডিউটি, তাই দেখা হয়নি। তাই বিদায়কালে মনটা বিষণ্ন হয়ে রইল। পূর্বোক্ত নবীনা এখানে থাকার সময় যখন-তখন এসে আমার ঘুমের খবর, স্বস্তির খবর নিয়েছে, কখনো ডাকতে হয়নি- এ এক নতুন অভিজ্ঞতা। তার সহকর্মী জ্যোৎস্না, শাহিদা এবং নাম না জানাদেরও কর্তব্য পালনে কোনো অভাব দেখিনি। যদিও এরা পেশাগত দায়িত্ব পালন করেছে, তবু মনে হয়েছে এদের মধ্যেকার বিশেষদের কাছে বুঝি আমি ঋণী। তেমনি ডা. ইকবাল, তাকে ব্যতিক্রমী বলে মনে হয়েছে দায়িত্ব পালনের ঊর্ধ্বে। সর্বোপরি সংস্থার প্রধান প্রফেসর এমএ রশিদ- প্রতিদিন একবার করে দেখে গেছেন, প্রসন্নমনে প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। বিদায়কালে ব্যতিক্রম ধারায় অনেককে নিয়ে মধ্যমণি হয়ে বসে আমার সমস্যার কথা বলেছেন, প্রয়োজনে আসার কথা বলেছেন। অসাধারণ সহৃদয় ব্যবহার করেছেন নাদিয়ার সঙ্গে। এক কথায়, এরা সবাই মিলে চিকিৎসাসেবায় মানবিকতার উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। আমার প্রত্যাশা প্রতিটি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল এমন উদাহরণ সৃষ্টি করুক। এ কাজে স্বাস্থ্য বিভাগের দায়িত্ব রয়েছে বলে আমি মনে করি। তারা যেন সে দায়িত্ব পালনে সক্রিয় হয়। আহমদ রফিক : লেখক, গবেষক ও ভাষাসংগ্রামী।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App