×

স্বাস্থ্য

ওমিক্রন উদ্বেগ, জোর প্রস্তুতি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২২ ডিসেম্বর ২০২১, ০৯:০১ এএম

  • টিকার পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি মানার তাগিদ
  • বুস্টার ডোজের নিবন্ধন চলতি মাসের শেষে

নতুন নতুন ধরন নিয়ে গত দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে করোনা ভাইরাস। তবে এক বছরের বেশি সময় ধরে ভাইরাসটির ডেল্টা ধরনই মহামারির মাত্রা ভয়াবহ করে তোলে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পাশাপাশি টিকার মাধ্যমে মহামারি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টার কাজটি অনেকটাই আশার আলো দেখিয়েছিল। কিন্তু গত নভেম্বরে দক্ষিণ আফ্রিকায় ধরা পড়ে ভাইরাসটির নতুন রূপ ‘ওমিক্রন’ পুরানো সব হিসাবনিকাশই বদলে দেয়। ইতোমধ্যে বিশ্বের ৯০টি দেশে ওমিক্রনের সংক্রমণ ছড়িয়েছে। সংক্রমণের নিম্নমুখী প্রবণতার মধ্যে বাংলাদেশেও শনাক্ত হয়েছে ওমিক্রনে আক্রান্ত রোগী। শনাক্তের সংখ্যা মাত্র ২ জন হলেও পরিস্থিতি ভাবিয়ে তুলেছে গবেষক ও বিজ্ঞানীসহ খোদ সরকারকেও। ওমিক্রন নিয়ে সতর্ক থাকার জন্য গত ১৩ ডিসেম্বর মন্ত্রিসভার বৈঠকে নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর শুরু হয় জোরালো প্রস্তুতি।

দেশে ওমিক্রন ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালিকও। সচিবালয়ে গতকাল মঙ্গলবার সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, বিশ্বের ৯০টি দেশে করোনা ভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রনের সংক্রমণ ছড়িয়েছে। বাংলাদেশে ২ জনের মধ্যে এই ভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়লেও তা এখনো ছড়িয়ে পড়েনি। তবে দেশের মানুষ এখন আর মাস্ক পরছে না। স্বাস্থ্যবিধিও মানছে না। যে কারণে যে কোনো সময় ওমিক্রন বাড়ার আশঙ্কা করছে সরকার। সারাদেশের মানুষ যাতে আগের মতো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে, এ জন্য জেলা প্রশাসক ও সিভিল সার্জনদের চিঠি দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

এর আগে ওমিক্রনের সংক্রমণ ঠেকাতে বিমানবন্দর, স্থলবন্দরসহ দেশের সব প্রবেশপথে স্ক্রিনিং জোরদার, বিদেশ থেকে দেশে ফিরলে ১৪ দিনের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করা, করোনা বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোকে প্রস্তুত থাকার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বেশ কয়েকটি দেশ থেকে আসা যাত্রীদের স্ক্রিনিং, জনসমাগম নিরুৎসাহিত করা এবং পর্যটন, বিনোদন কেন্দ্র, রেস্তোরাঁয় ভিড় এড়ানোসহ ১৫ নির্দেশনা দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

ওমিক্রনের সংক্রমণ শুরুর পরপরই এই ধরনটিকে ‘উদ্বেগজনক ধরন’ হিসেবে চিহ্নিত করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও)। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রস্তুতি নেয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ ডাব্লিউএইচও। ওমিক্রন ঠেকানোর কাজটি যে ঠিকভাবে হচ্ছে না, তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে গত ১৫ ডিসেম্বর সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হয়, ওমিক্রন গোটা বিশ্বেই অপ্রত্যাশিত গতিতে ছড়িয়ে পড়ছে। এখন পর্যন্ত যা জানা গেছে, তাতে বলা যায় সত্যিকার অর্থেই আমাদের বিপদ আরো বাড়িয়ে তুলেছে। ওমিক্রনে রোগীদের অসুস্থতা যদি মারাত্মক নাও হয়, তাতেও এটা যে হারে সংক্রমণ ঘটাচ্ছে, তাতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর বড় চাপ তৈরি করতে পারে।

এর ৪ দিন পরই (২০ ডিসেম্বর) এক সংবাদ সম্মেলনে ডাব্লিউএইচওর মহাপরিচালক তেদ্রোস আধানম গ্রেব্রিয়েসুস বলেন, বিশ্বজুড়ে আধিপত্য বিস্তার করা করোনা ভাইরাসের ডেল্টা ধরনের চেয়েও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে ওমিক্রন। এর বিস্তার ঠেকাতে ফ্রান্স এবং জার্মানিসহ বেশ কিছু দেশ স্বাস্থ্যবিধির কড়াকড়ি বাড়ানোর পাশাপাশি নতুন করে ‘ভ্রমণ বিধিনিষেধ’ জারি করেছে। বড় দিনের সময় কঠোর লকডাউনের ঘোষণা দিয়েছে নেদারল্যান্ডস। অনেক দেশেই উৎসবের সময় সামাজিক মেলামেশার কারণে সংক্রমণ বাড়বে, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করে তুলবে এবং মৃত্যু বাড়বে-এ বিষয়ে ‘কোনো সন্দেহ নেই’। আর সেজন্য প্রয়োজনে বড়দিনের ছুটিতে উদযাপনের পরিকল্পনা বাতিল করার পরামর্শ দেন সংস্থার প্রধান।

এখানেই শেষ নয়। আরেক আশঙ্কার কথাও জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। ‘মারাত্মক’ ডেল্টার ধরনের সঙ্গে মিলে ‘অতি সংক্রামক’ ওমিক্রন নতুন করে আরেকটি ধরন তৈরি করতে পারে। যা অনেক বেশি ভয়ঙ্কর হতে পারে। সম্প্রতি টিকা প্রস্তুতকারী সংস্থা মডার্নার প্রধান মেডিকেল অফিসার ড. পল বার্টন এমনটাই জানিয়েছেন।

চিকিৎসাবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব হেলথ সায়েন্সেসের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী ভোরের কাগজকে বলেন, আমাদের দেশে সংক্রমণ কম থাকলেও করোনা ভাইরাস নিয়ে উপসংহারে আসার সুযোগ নেই। ইউরোপ-আমেরিকায় ওমিক্রন যেভাবে ছড়িয়ে পড়ছে তাতে শঙ্কা বাড়ছে। কারণ অন্য দেশে যে তা ছড়াবে না তা তো নয়। সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, টিকা ব্যবস্থাপনা ও স্বাস্থ্য সেবার সক্ষমতা বাড়ানোর দিকে আমাদের এখন বেশি মনযোগ দিতে হবে। কোনো প্রকার ঢিলেমির সুযোগ নেই। বিজ্ঞানী ও গবেষকরা বলছেন ওমিক্রনের তীব্রতা কম হলেও সংক্রমণ অনেক বেশি। কেউ বলছে প্রচলিত টিকাগুলো ওমিক্রনের সংক্রমণ ঠেকাবে না। আবার ভিন্ন মতও আছে। তবে আমাদের প্রস্তুতি থাকলে ভাইরাসের ধরন যাই হোক তা মোকাবিলা করা সম্ভব।

দেশে ওমিক্রন ঝুঁকি কতটা সে প্রসঙ্গে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, ইতোমধ্যেই বিশ্বের অনেক দেশেই ওমিক্রন ছড়িয়ে পড়েছে। সংখ্যায় কম হলেও আমাদের দেশে ওমিক্রনে সংক্রমিত রোগী শনাক্ত হয়েছে। বিশ্বে যেভাবে ওমিক্রন ছড়িয়ে পড়ছে তাতে স্বাভাবিকভাবেই আমাদের চিন্তা বাড়চ্ছে। নতুন নতুন ধরন আমাদের সামনে আসছে। সংক্রমণ প্রতিরোধে টিকার বৈষম্য যত বেশি হবে ভাইরাসের ধরনও তত বেশি হবে। টিকার মাধ্যমে পরিপূর্ণভাবে ভাইরাসটি নিশ্চিত করা না গেলেও ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব। এখনো অনেক মানুষ টিকার আওতার বাইরে রয়েছে। তাদের টিকার আওতায় আনতে হবে। প্রয়োজনে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বয়স্ক ব্যক্তিদের টিকা নিশ্চিত করতে হবে।

স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর জোর দিয়ে এই জনস্বাস্থ্যবিদ বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়টি জনগণের ওপর ছেড়ে দিলে হবে না। প্রতিষ্ঠানিক বা কর্তৃপক্ষকেই তা নিশ্চিত করতে হবে। বাস কাউন্টার, বাজার-ঘাট, শপিংমল, কমিউনিটি সেন্টার, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্থানে স্বাস্থ্যবিধি মানা এবং মাস্কের ব্যবহার নিশ্চিত করার বিষয়টি সেখানকার কর্তৃপক্ষকেই করতে হবে। এছাড়া স্বাস্থ্য খাতের যেসব ঘাটতিগুলো ছিল সেগুলো মেটাতে হবে। শনাক্ত রোগীরা এবং তাদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিরা সঠিকভাবে আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টাইন করছে কিনা সেই বিষয়টিও তদারকি দরকার বলে মনে করেন তিনি।

এদিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ করোনা প্রতিরোধী টিকার বুস্টার ডোজের (৩য় ডোজ) পথে হাঁটলেও বিশ্বব্যাপী টিকার বৈষম্যের চিত্র নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ডাব্লিউএইচও। করোনা মহামারির অবসান ঘটাতে আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে বিশ্বের সব দেশের ৭০ শতাংশ মানুষের টিকা প্রাপ্তি নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বরাবরই বলে আসছে, শুধু নিজেরা টিকা নিয়ে বাকিদের টিকাহীন রেখে এই মহামারি নির্মূল করা যাবে না।

গতকাল করোনা টিকা প্রসঙ্গে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, করোনা নিয়ন্ত্রণে টিকা কার্যকরী ভূমিকা রেখেছে। এখন পর্যন্ত প্রথম ডোজ ৬০ শতাংশ আর দ্বিতীয় ডোজ ৩০ শতাংশ মানুষকে দেয়া হয়েছে। সরকারের লক্ষ্য ১২ থেকে ১৩ কোটি মানুষকে টিকা দেয়া। এখন পর্যন্ত দেয়া হয়েছে ৩০ শতাংশ মানুষকে।

বুস্টার ডোজ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, করোনা ভাইরাসের টিকার বুস্টার ডোজ সবাইকে দিতে সুরক্ষা অ্যাপের আপডেট করা হচ্ছে। কিছু সংশোধন করা হচ্ছে। এখন সীমিত আকারে দেয়া হচ্ছে ডাক্তার-নার্সসহ ফ্রন্টলাইনারদের। টিকা কার্ড নিয়ে ষাটোর্ধ্ব ও ফ্রন্টলাইনাররা বুস্টার ডোজ নিতে পারবেন। ডিসেম্বরের শেষের দিকে আগেরগুলোর মতো অ্যাপ ও ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বুস্টার ডোজের নিবন্ধন শুরু হবে। এখন এ নিয়ে কাজ করছে আইসিটি মন্ত্রণালয়।

প্রসঙ্গত; দেশে করোনা মহামারি নিয়ন্ত্রণে টিকাযজ্ঞের যাত্রা শুরু হয়েছিল চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি। বুস্টার ডোজ দেয়া শুরু হয় ১৯ ডিসেম্বর।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App