×

মুক্তচিন্তা

চলতি দশকটি বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনে কেন প্রয়োজন?

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২১ ডিসেম্বর ২০২১, ০১:০৪ এএম

বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও বিজয়ের ৫০ বছর করোনার অতিমারির প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আমরা বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে উদযাপন করেছি। এই ৫০ বছরে অর্জনের নানা দিক আমাদের কাছে এই উপলক্ষে নানাভাবে উঠে এসেছে। আবার আমাদের এগিয়ে চলার ক্ষেত্রে যেসব প্রতিবন্ধকতা, অপূর্ণতা এবং উন্নয়ন-সমস্যা বিরাজ করছে সেগুলোও বছরব্যাপী নানা আয়োজন, উদযাপন এবং আলোচনা-পর্যালোচনা থেকে বের হয়ে এসেছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে জাতীয়ভাবে আমরা আগামী দিনের জন্য আমাদের করণীয় নিয়ে যে শপথ গ্রহণ করেছি সেটি এখন থেকেই বাস্তবায়ন করার কাজে আত্মনিয়োগ করা জরুরি মনে করছি। সেই বিবেচনা থেকেই আমাদের ধারণা শুরু হওয়া চলতি দশকটি জাতীয়ভাবে আমাদের বিগত দশকটির মতোই লক্ষ্য, পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নের কর্মযজ্ঞ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। তাহলে ২০৩০-৩১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৬০ বছর পূর্ণতার কালে আমরা জাতীয়ভাবে অনেক বেশি অর্জন নিয়ে গর্ব করতে পারব। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনকালে যে বিষয়টি আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়েছে তা হচ্ছে ২০১০-২০-এর দশকটিতে আমরা অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিস্ময়কর সাফল্য দেখাতে সক্ষম হয়েছি। এটি এখন শুধু আমাদের মুখের কথা নয়, বাস্তব জীবনে দেখা এবং আন্তর্জাতিকভাবে সব মহল কর্তৃক স্বীকৃত। উন্নয়নের এই দশকটি আমাদের জাতীয় জীবনকে স্বাধীনতা এবং মানুষের জীবন-জীবিকার নিরাপত্তা ও আস্থা অর্জনে যে শক্তি জুগিয়েছে তার ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। অর্থনৈতিক এই অর্জন ঘটানো সম্ভব না হলে ৫০ বছরের অর্জন আমাদের সম্মুখে তেমন কোনো আস্থা সৃষ্টি করতে পারত না। ডাকঢোল পিটিয়ে উন্নয়নের দশক আইয়ুব খানও করেছিল। কিন্তু সেই দশক উদযাপন পূর্ব বাংলার সাধারণ মানুষের কাছে পরিহাসের মতো লেগেছিল। কারণ পাকিস্তান তখনো পর্যন্ত পূর্ব বাংলার জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে আস্থা অর্জনের ন্যূনতম দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেনি। সে কারণেই উন্নয়নের দশক উদযাপন মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। কিন্তু এবার স্বাধীনতার ও বিজয়ের ৫০ বছর উদযাপনকালে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা লাভ করেছে, দেশের অভ্যন্তরে দারিদ্র্যের হার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে, মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান দৃশ্যমান হয়েছে, সামাজিক প্রায় সব সূচকেই বাংলাদেশ প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়ে এগিয়ে যাওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করেছে। ২০১০ সালে আমাদের মধ্যবিত্তের যে আয়তন ছিল তা ২০২০-২১ সালে দ্বিগুণের চেয়েও বেশি হয়েছে। এখন বাংলাদেশে ৩০ শতাংশ মানুষ মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে উন্নীত হয়েছে, যা ১৯৯০-৯১তে ছিল মাত্র ১০ শতাংশ । গ্রামীণ অর্থনীতি এতটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছে যে শহর গ্রামের দূরত্ব ঘুচিয়ে আসার সম্ভাবনা অনেকটাই হাতের নাগালের মধ্যে চলে এসেছে। ব্যাপক এই পরিবর্তনের পেছনে ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে জাতির সম্মুখে শেখ হাসিনা রূপকল্প ২০২১ এবং দিনবদলের যে সনদ উপস্থাপন করেছিলেন সেটি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে তিনি এবং তার সরকার অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে যেসব পরিকল্পনা ও কর্মসূচি একের পর এক বাস্তবায়ন করেছেন তা ছিল এক দশক আগে আমাদের কাছে কল্পনার বিষয়। কিন্তু দশক শেষে এটি বাস্তবে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। গত এই এক দশকে দেশের অর্থনৈতিক সাফল্য যদি না ঘটত তাহলে এবার সুবর্ণজয়ন্তী পালনের সব আনুষ্ঠানিকতা ফিকে হয়ে যেত, পরিহাসের মতো শুনাত। সুতরাং স্বাধীনতার ৫০ বছরে অন্তত শেষ এই ২০১০-২০ দশকটি আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ইতিহাসের গুরুত্ব যথাযথভাবে উপলব্ধি করে অর্থনৈতিকভাবে বিপ্লবাত্মক যে পরিবর্তনের রূপকল্প বাস্তবায়ন ঘটিয়েছে তার ফলেই ৫০ বছরের স্বাধীনতা অর্জন জাতীয় জীবনে গভীরভাবে পরিবর্তন ও প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছে। অর্থনৈতিক এই পরিবর্তনের জন্য শেখ হাসিনার সরকার শুরুতেই দেশকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার যে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছিল তা ছিল ইতিহাসের এক মাইলফলক ঘটনা। কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, নাগরিক ও গ্রামীণ সমাজে সর্বত্র চাহিদামতো বিদ্যুৎ উৎপাদন ঘটিয়ে অর্থনীতির চাকাই শুধু সচল রাখেনি, জনজীবনের সব ক্ষেত্রকেও বিকশিত হওয়ার সুযোগ উন্মুক্ত করে দিয়েছে। একই সঙ্গে ডিজিটাল প্রযুক্তি এনালগ থেকে বের করে আনার ফলে উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতার আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। দেশ এখন বড় বড় অকল্পনীয় মেগা প্রকল্পের বাস্তবায়ন ঘটিয়ে চলছে। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় এক দশকেই ৩ গুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। গড় আয়ু ৭৩ বছরে উন্নীত হয়েছে। বাংলাদেশ ২০৪১ সালে উন্নত সমৃদ্ধ অর্থনৈতিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠনের লক্ষ্য স্থির করতে পেরেছে। এর কোনোটিই সম্ভব হতো না যদি ২০১০-২০ দশকে রূপকল্প ২০২১ বাস্তবায়নের পরিকল্পনা উপস্থাপন করা না হতো। রাষ্ট্রে এমন ভিশনারি-মিশনারি নেতৃত্ব ছাড়া কখনো বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব নয়। আমরা এবং বিশ্বের নেতৃত্ব এক বাক্যে স্বীকার করে যে বাংলাদেশে শেখ হসিনার ভিশনারি-মিশনারি নেতৃত্বই ১০ বছরে অর্থনীতিতে বিরাট ধরনের সাফল্য এনে দিতে পেরেছে। তিনি এখনো বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিকসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিবর্তনের পরিকল্পনা নিয়ে দেশকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। পরিপক্বতা, দূরদর্শিতা এবং বাস্তব বোধের এমন পরিণত নেতৃত্ব ছাড়া বাংলাদেশের সামগ্রিক পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব নয়। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছে সেটি যে কোনো রাষ্ট্রের প্রাধান্যের তালিকায় প্রথম থাকা ও পাওয়া খুবই জরুরি ছিল। সেটি ব্যতীত সামগ্রিক পরিবর্তন ও উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব নয়। শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত সমৃদ্ধ করার রেললাইনে তুলে দিয়েছেন। এটি এখন স্বাভাবিক গতিতে পরিচালিত হলে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো অবশ্যই সম্ভব। রাজনৈতিক নেতৃত্বকে অবশ্যই উন্নয়ন পরিকল্পনায় যাতে কোনো ব্যত্যয় না ঘটে সে ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। এখন যে বিষয়টি আমাদের অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে বাস্তবায়িত করতে হবে তা হচ্ছে দেশের গোটা শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন সংঘটিত করা। অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি ধারাকে বেগবান করার জন্য উন্নত জাতি গঠনের কোনো বিকল্প নেই। আমাদের ১৮ কোটি মানুষের অর্থনীতির ক্রমবর্ধমান চাহিদা এতদিন ধরে চলে আসা শিক্ষা ব্যবস্থা দিয়ে পূরণ করা মোটেও সম্ভব নয়। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও গতিধারা বেগবান করতে অবশ্যই প্রয়োজন দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টির। সেটির জন্য একান্তই প্রয়োজন ২১ শতকের ২০২০-২১ পরবর্তী যুগের যোগ্য জনশক্তি তৈরির মতো শিক্ষাব্যবস্থা। সেটির অভাব ও ব্যত্যয় ঘটলে আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, জনগণের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ মোটেও সম্ভব হবে না। দেশের বর্তমানে যে শিক্ষাব্যবস্থা রয়েছে তা মোটেও যুগের চাহিদা পূরণের ধারেকাছেও নেই। অপরিকল্পিতভাবে যেসব ধারা-উপধারার শিক্ষাব্যবস্থা এ দেশে চলে আসছে তা শিশু-কিশোরদের খুব সামান্য অংশকেই যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম করে তুলতে পারে। বৃহত্তর শিক্ষার্থীদের দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করতে এটি শুধু ব্যর্থ ও অকার্যকরই নয়, অনেক ক্ষেত্রে অন্তরায়ও সৃষ্টি করে চলছে। বিরাট সংখ্যক সনদধারী শিক্ষার্থী তেমন কোনো জ্ঞানদক্ষতা, উৎপাদনশীলতা, জীবনবোধ এবং আধুনিক সমাজ রাষ্ট্র ও বিশ্ব বাস্তবতার বোধ অর্জন করার সুযোগই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পায় না। ফলে এদের বেশিরভাগই অদক্ষ ও বেকার জনগোষ্ঠী হয়ে রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনের শুধু বোঝাই নয়, নানা ধরনের অনাকাক্সিক্ষত সমস্যা সৃষ্টি করছে। অথচ আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনশীল শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার সুযোগ পেলে এদের প্রত্যেকেই ব্যক্তিগতভাবে যেমন দক্ষ মানবসম্পদ রূপে গড়ে ওঠার সুযোগ পেত, তেমনি সমষ্টিগতভাবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে যুগের চাহিদা পূরণে ভূমিকা রাখার সুযোগ পেত। সেজন্য সরকারকে এখন থেকে এক দশকের শিক্ষা পরিকল্পনা নিয়ে একইভাবে জাতিকে আত্মনিয়োগ করতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে, যাতে আমাদের প্রতিটি শিশু মেধা, মনন, দক্ষতা এবং উদ্ভাবনী ক্ষমতায় বিকশিত হওয়ার প্রয়োজনীয় শিক্ষা লাভ করতে সক্ষম হয়। সরকার এরই মধ্যে যে নতুন শিক্ষাক্রম জাতির সম্মুখে উপস্থাপন করেছে সেটিকে বেগবান করার জন্য এই চলতি দশকটিকে বিগত দশকটির মতো কার্যকর করার উদ্যোগ নিতে হবে যাতে এই দশ বছরে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় মৌলিক রূপান্তর ও পরিবর্তন দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। এর জন্য নীতি কৌশল দক্ষ মেধাবী তরুণদের শিক্ষকতার পেশায় আকৃষ্ট করার মতো ব্যবস্থা করে দেবে। শিক্ষাব্যবস্থার অভ্যন্তরে বিরাজমান অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা এবং শিক্ষক নেতৃত্বের সংকট অবশ্যই দূর করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে। একই সঙ্গে উন্নত আধুনিক শিক্ষাক্রম, পঠন-পাঠন, মূল্যায়ন পদ্ধতি ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের শিক্ষার নিষ্ঠা তৈরি করতে হবে। মেধাবী তরুণ শিক্ষক ছাড়া আগামী দিনের মানবসম্পদ তৈরি হওয়ার নয়। প্রতিটি শিক্ষার্থীর শিক্ষার অধিকারই শুধু নয়, পঠন-পাঠনেরও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা সৃষ্টি করতে হবে। হতদরিদ্র, দরিদ্র ও অপেক্ষাকৃত দরিদ্রদের শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ার কোনো সুযোগ যেন না থাকে সে ধরনের আর্থিক প্রণোদনা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থায় কাঠামোগত এবং শিক্ষার দর্শন ও মানগতভাবে উন্নয়ন ও অগ্রগতির ধারা সর্বত্র সমতাভিত্তিক থাকার বাস্তবতা নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে সরকার বিপুল অর্থ ব্যয় করে। তবে সিংহভাগ অর্থই মানসস্মত শিক্ষা লাভে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না। সরকারকে প্রথাগত শিক্ষার প্রকল্প বাদ দিয়ে যুগোপযোগী সমাজ বাস্তবতার নিরিখে আগামী ১০ বছর পরিকল্পিত উপায়ে শিক্ষাব্যবস্থার ক্রম মানসম্মত উন্নয়ন ঘটানোর পরিকল্পনা ও অর্থের যথাযথ ব্যয় ঘটিয়ে এই লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব। ১০ বছরে মানসম্মত শিক্ষার ভিত্তিটি তৈরি হয়ে গেলে পরবর্তী দশকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও শিক্ষা সংস্কৃতির নবযাত্রা বাংলাদেশকে ২০৪১ সালে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App