×

খেলা

ক্রীড়াঙ্গনে বিজয়ের ৫০ বছর

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৬ ডিসেম্বর ২০২১, ১২:০৮ এএম

ক্রীড়াঙ্গনে বিজয়ের ৫০ বছর

বিজয়ের পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশের ক্রিকেটে বড় অর্জন ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি জয়। শিরোপা হাতে অধিনায়ক আকরাম খান। ছবি: ইন্টারনেট

ক্রীড়াঙ্গনে বিজয়ের ৫০ বছর
ক্রীড়াঙ্গনে বিজয়ের ৫০ বছর
ক্রীড়াঙ্গনে বিজয়ের ৫০ বছর
ক্রীড়াঙ্গনে বিজয়ের ৫০ বছর

বাঙালি জাতির জন্য ১৬ ডিসেম্বর গৌরবান্বিত ও মর্যাদার দিন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ আর ৩ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম হারানোর বিনিময়ে অর্জিত হয় কাঙ্খিত বিজয়। তাই অন্য যে কোনো দিনের চেয়ে আমাদের জাতীয় জীবনে দিনটির গুরুত্ব অনেক। দেখতে দেখতে গৌরবোজ্জ্বল বিজয়ের ৫০ বছরে পা রাখল বাংলাদেশ। বাঙালি এ বছর আনন্দ-উৎসবের মধ্য দিয়ে বিজয় দিবস পালন করছে। মহাকালের ইতিহাসের দিকে তাকালে একটি দেশের জন্য ৫০ বছর খুব বেশি সময় নয়। সে তুলনায় বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে ঈর্ষণীয় উন্নতি করেছে। ৫০ বছরে খেলাধুলায় যতটা উন্নতি হতে পারত ততটা হয়তো হয়নি। কিছু কিছু গেমসে অনেক ভালো করছে, আর কিছু কিছু খেলা উন্নতির পথে রয়েছে।

সুবর্ণজয়ন্তী পালনের দিনে আমরা ক্রীড়াঙ্গনের দিকে দৃষ্টি দিলে ক্রিকেটের জয়জয়কারই বেশি। ৩০ বছর আগেও দেশের ক্রিকেটে গৌরব করার মতো তেমন কিছু ছিল না। ফুটবলের সঙ্গে মাঠ ভাগাভাগি করে খেলতে হতো। যে খেলার নিজস্ব একটি মাঠ ছিল না, সেই ক্রিকেটে গৌরব করার মতো অনেক অর্জন রয়েছে এখন। প্রায় প্রতিটি বিভাগেই টেস্ট ভেন্যু তৈরি হয়েছে। ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি বিজয় বাংলাদেশের ক্রিকেটে বড় অর্জন। ১৯৯৯ সালে ওয়ানডে বিশ্বকাপে খেলেছে বাংলাদেশ। ২২ বছর আগে নিজেদের অভিষেক বিশ্বকাপেই অভাবনীয় কিছু সাফল্য এনে দিয়েছিলেন টাইগাররা। পাকিস্তান ও স্কটল্যান্ডকে হারিয়ে পথ তৈরি করেছিলেন আইসিসির পূর্ণ সদস্যপদ প্রাপ্তিতে। যার ফলে ২০০০ সালে টেস্ট দলের মর্যাদা পায় লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা।

[caption id="attachment_324164" align="aligncenter" width="700"] ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশের নিয়াজ মোর্শেদ উপমহাদেশে প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার খ্যাতি অর্জন করেন।[/caption]

বিগত ২২ বছরে ছয়টি ওয়ানডে এবং টি-টোয়েন্টির সব বিশ্বকাপই খেলেছে বাংলাদেশ। যদিও বিশ্বকাপ থেকে এখনো কাঙ্খিত সাফল্য অর্জিত হয়নি। ২০০৭ বিশ্বকাপে সুপার এইটে খেলা, ২০১৫ সালে কোয়ার্টার ফাইনালে উন্নীত হওয়া কম প্রাপ্তি নয়। ২০১৯ সালের ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে সেমিফাইনাল খেলার একটি সুবর্ণ সুযোগ থাকলেও কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি টাইগাররা। ২০১৭ সালে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনাল খেলা, ২০১৯ সালে আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজে চ্যাম্পিয়ন হওয়া এবং তিনবার এশিয়া কাপের ফাইনাল খেলাকেও প্রাপ্তি হিসেবেই দেখা যেতে পারে। ২০১০ সালে চীনের গোয়াংজুতে ১৬তম এশিয়ান গেমসে প্রথমবার অন্তর্ভুক্ত হয় ক্রিকেট। তখন খুলে যায় বাংলাদেশের সম্ভাবনার দুয়ার। টি-টোয়েন্টির এই ফরম্যাটের কারণে এশিয়ান গেমসে ৩২ বছর পর স্বর্ণ জিততে সক্ষম হয় লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা।

ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েদের ক্রিকেটেও এসেছে ঈর্ষণীয় সাফল্য। এশিয়া কাপ জয়ের কৃতিত্ব আছে  টাইগ্রেসদের। ২০১৮ সালে মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত ফাইনালে ভারতকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয় জাহানারা-সালমারা। সব মিলে ক্রিকেট-বিশ্বে বাংলাদেশ এখন প্রতিষ্ঠিত শক্তি। সাকিব ছাড়াও বাংলাদেশের তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, মুস্তাফিজুর রহমানের খ্যাতি এখন বিশ্বজোড়া। ক্রিকেটে আয়োজক হিসেবেও আছে ব্যাপক সুনাম। ২০১১ সালে প্রথমবারের মতো ওয়ানডে বিশ্বকাপ ও ২০১৪ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সফল আয়োজন করে বাংলাদেশ। এছাড়া একবার ‘মিনি বিশ্বকাপ’ এবং দু-দুবার অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের মতো মর্যাদার আসর সাফল্যের সঙ্গে আয়োজন করার কৃতিত্বও আছে। ২০২০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের ফাইনালে ভারতকে হারিরে শিরোপা জিতেছে বাংলাদেশ।

[caption id="attachment_324165" align="aligncenter" width="700"] এশিয়া কাপে টাইগ্রেসরা ২০১৮ সালে মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত ফাইনালে ভারতকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয়।[/caption]

বীর মুক্তিযুদ্ধা বাংলাদেশ জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক রকিবুল হাসান বলেন, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর যখন বিজয়ের সংবাদ পাই তখন আমি ভারতে। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল এবং ক্রিকেট দল এক সঙ্গে ছিল। মুহূর্তের মধ্যে চারদিকে বিজয়ের সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে। ১৮ ডিসেম্বর ভারত থেকে দেশে ফিরে আসি। ৫০ বছরে ক্রীড়াঙ্গনে যে সাফল্য এসেছে তা মন্দ নয়। তারপরও বলব আরো ভালো করা উচিত ছিল।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ছিল ফুটবল। উপমহাদেশের প্রথম ফুটবলার হিসেবে কাজী সালাউদ্দিন ১৯৭৬ সালে হংকং পেশাদার লিগে খেলেন। সে সময় এশিয়ায় হংকংয়ের পেশাদার ফুটবল লিগ এতটাই জনপ্রিয় ছিল যে, ইউরোপের বড় বড় তারকারাও সেখানে খেলতে আসতেন। এছাড়া দেশের বাইরে ফুটবল খেলে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন মোনেম মুন্না, শেখ মোহাম্মদ আসলাম, ইমজিয়াজ সুলতান জনি, কায়সার হামিদ, রুম্মন ওয়ালি বিন সাব্বির, গাউস, মানুনুল ইসলাম ও জামাল ভূঁইয়া। দল হিসেবে বাংলাদেশের প্রথম শিরোপা ১৯৮৯ সালে। প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপের ফাইনালে দক্ষিণ কোরিয়ার সম্মিলিত বিশ্ববিদ্যালয় একাদশকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় ছাইদ হাছান কাননের দল। বাংলাদেশ দু-দুবার সাফ গেমসে (১৯৯৯ ও ২০১০ সাল) চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। ২০০৩ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সাফ চ্যাম্পিয়নশিপেও শিরোপা জয় করে লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা।

[caption id="attachment_324166" align="aligncenter" width="700"] ২০১৯ সালে কাঠমান্ডুতে অনুষ্ঠিত সাফ গেমসে বাংলাদেশের আর্চারি দল আসরের ১০ ইভেন্টের সবকটিতে স্বর্ণপদক জেতে।[/caption]

১৯৯৫ সালে মিয়ানমারে অনুষ্ঠিত চার জাতি টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। ওই আসরে বাকি তিন দল ছিল স্বাগতিক মিয়ানমার, সিঙ্গাপুর ও চাইনিজ তাইপে। মেয়েদের ফুটবলেও এসেছে সাফল্য। ২০১৫ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব-১৫ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলার মেয়েরা।

বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি কাজী মো. সালাউদ্দিন বলেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ যে দিন বিজয় লাভ করে তখন আমি ভারতে (স্বাধীন বাংলা ফুটবলের হয়ে ভারতে খেলি)। দেশ স্বাধীন হয়েছে এ কথা বিশ্বাস করতে আমার ২ ঘণ্টা সময় লেগেছিল। আমার বিশ্বাস শেখ কামাল বেঁচে থাকলে বাংলাদেশ বিশ্বকাপে খেলত।

ফুটবল-ক্রিকেট বাংলাদেশের জনপ্রিয় খেলা হলেও অন্যান্য খেলায়ও বিজয়ের ৫০ বছরে সাফল্য এসেছে। বিশেষ করে দাবা, আরচারি, গলফ, শুটিং, অ্যাথলেটিকস ও সাঁতারের সাফল্যের কথা না বললে নয়। ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশের নিয়াজ মোর্শেদ উপমহাদেশে প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার খ্যাতি অর্জন করেন। এর এক বছর পর ভারত তাদের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার (বিশ্বনাথন আনন্দ) পেয়েছিল। মেয়েদের দাবায় রানি হামিদ ১৯৮৫ সালে আন্তর্জাতিক মাস্টার খেতাব অর্জন করেন। এ তারকা এখন পর্যন্ত ২০ বার জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জিতেছেন। তিনবার ব্রিটিশ ওমেন্স চেজ চ্যাম্পিয়নশিপেও শিরোপা জিতেছেন তিনি। ১৯৯০ সালে কমনওয়েলথ গেমসের মতো বৈশ্বিক আসরে শুটিংয়ে যুগ্মভাবে স্বর্ণপদক লাভ করে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন দুই শুটার আতিকুর রহমান ও আবদুস সাত্তার নিনি।

[caption id="attachment_324167" align="aligncenter" width="700"] সাকিব ছাড়াও বাংলাদেশের তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, মাশরাফির খ্যাতি এখন বিশ্বজোড়া।[/caption]

এর এক যুগ পর আবারও বিশ্বমঞ্চে আলোচনায় আসে বাংলাদেশ। ২০০২ সালে ম্যানচেস্টারে অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ গেমসে আবারও স্বর্ণ জেতেন বাংলাদেশের আরেক কৃতী শুটার আসিফ হোসেন খান।  অ্যাথলেটিকসেও সাফল্য আছে বাংলাদেশের। ১৯৮৫ ও ১৯৮৭ সালের সাফ গেমসে অ্যাথলেট শাহ আলম একাই দু-দুবার দ্রুততম মানব হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। ১৯৯৩ সালে সাফ গেমসে দ্রুততম মানব হয়েছিলেন বিমল তরফদার। সাঁতারে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন মোশারফ হোসেন। ১৯৮৫ সালে মোশারফ হোসেন সাফ গেমসে এ সাঁতার ইভেন্ট থেকে একাই পাঁচটি স্বর্ণপদক লাভ করেন। ২০১৬ সালে ভারতের শিলং-গৌহাটিতে অনুষ্ঠিত এসএ গেমসে সাঁতারে ৫০ ও ১০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে মাহফুজা খাতুন শিলা জোড়া স্বর্ণ জেতেন। গলফার সিদ্দিকুর রহমান একাই দু-দুবার এশিয়ান ট্যুরের শিরোপা জিতে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছেন। ২০১০ সালে ব্রুনাই ওপেন এবং ২০১৩ সালে হিরো ইন্ডিয়া ওপেনের শিরোপা জয় ছাড়াও ইউরোপিয়ান ট্যুরের আসরেও বেশ সাড়া ফেলেছেন সিদ্দিকুর।

বিবিসির মতো মিডিয়াতেও তাকে নিয়ে ছাপা হয়েছে কিছু ফিচার স্টোরি। ২০১৮ সালে নেদারল্যান্ডসে অনুষ্ঠিত মর্যাদাপূর্ণ আসর বিশ্ব আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপে ব্রোঞ্জ জিতে আলোড়ন সৃষ্টি করেন রোমান সানা। ২০১৯ সালে কাঠমান্ডুতে অনুষ্ঠিত সাফ গেমসে বাংলাদেশের আর্চারি দল তো রীতিমতো চমক সৃষ্টি করে। আসরের ১০ ইভেন্টের সবকটিতে স্বর্ণপদক জেতে বাংলাদেশ। ওই আসরে সর্বমোট ১৯টি স্বর্ণ জিতে ছিল লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা। ২০২১ টোকিও অলিম্পিকে বাংলাদেশের দুই আর্চার বিশ্ববাসীর নজর কাড়তে সক্ষম হন। ফুটবল বিশ্বের অন্যতম সেরা তারকা লিওনেল মেসি ২০১১ সালে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে নাইজেরিয়ার বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচে মাঠ মাতিয়েছিলেন। ফরাসি ফুটবল তারকা জিনেদিন জিদান, কিংবদন্তি বক্সার মোহাম্মদ আলী, ফিফা সভাপতি সেপ ব্লাটার ও বর্তমান সভাপতি ইনফান্তিনোসহ অনেক ক্রীড়াবিদ বাংলাদেশ সফর করেছেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App