×

জাতীয়

যুদ্ধের আড়ালে অন্য যুদ্ধ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০২১, ০৮:৩৩ এএম

যুদ্ধের আড়ালে অন্য যুদ্ধ

ফাইল ছবি

একাত্তরের ১৮ এপ্রিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে মাইলফলক ১৭ এপ্রিল প্রবাসী সরকারের মন্ত্রিসভার শপথ নেয়ার ঘটনায় সারা বিশ্ব ছিল আলোড়িত। এর রেশ না কাটতেই কূটনৈতিক ক্ষেত্রে আরেক আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় পাকিস্তানের উপহাইকমিশন কার্যালয় নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে সেখানে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন উপহাইকমিশনার হোসেন আলী। পাল্টে যায় কলকাতার ৯ নম্বর পার্ক সার্কাস এভিনিউয়ে উপহাইকমিশনের নাম। করা হয় ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, কূটনৈতিক মিশন’। বিদেশের মাটিতে এটাই ছিল প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন।

এর আগে ৭ এপ্রিল বাংলাদেশে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর গণহত্যার প্রতিবাদে পাকিস্তানি পক্ষ ত্যাগ করে প্রথম বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন দিল্লির দুই তরুণ বাঙালি কূটনীতিক কে এম শেহাবউদ্দিন ও আমজাদুল হক। তারাই ছিলেন বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য প্রকাশকারী প্রথম কূটনীতিক। পদত্যাগের পর সংবাদ সম্মেলন করে বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর অন্যায়-অত্যাচারের তীব্র নিন্দা জানান তারা।

বিশ্লেষকদের মতে, মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই সূচনা হয় কূটনৈতিক যুদ্ধের। কূটনৈতিক তৎপরতার কারণেই যুদ্ধের ভয়াবহ তাণ্ডবের কথা জানতে পারে বহির্বিশ্ব। মুক্তিযুদ্ধের কূটনৈতিক দিক কেমন ছিল- জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শমসের মবিন চৌধুরী ভোরের কাগজকে বলেন, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খবর পৌঁছে দেয়ার জন্য তাজউদ্দীন আহমেদের সরকার খুব তৎপর ছিল। যুক্তরাষ্ট্র পক্ষে না থাকলেও তাদের জনগণ এবং কয়েকজন সিনেটর আমাদের পক্ষে ছিলেন। লন্ডনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। পাকিস্তানি দূতাবাস থেকে অনেকেই পদত্যাগ করে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। যদিও মধ্যপ্রাচ্য পাকিস্তানের পক্ষে ছিল, তারা ঐক্যবদ্ধ মুসলিম দেশ চেয়েছিল। তবে কূটনৈতিক তৎপরতায় পাকিস্তান একঘরে হয়ে পড়েছিল।

যুদ্ধের আড়ালে যুদ্ধ : মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী জেনেভায় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য হিসেবে মিটিং করার পর লন্ডনে ফিরে এপ্রিল মাসেই বাংলাদেশের পক্ষে ঘোষণা দেন। মুজিবনগর সরকারের ‘অ্যাম্বাসেডর অ্যাট লার্জ’ ছিলেন তিনি। লন্ডন দূতাবাসের প্রথম বাংলাদেশের পক্ষে আসা কূটনীতিক দ্বিতীয় সচিব মহিউদ্দিন আহমেদ। সেখানে বাংলাদেশ মিশন প্রতিষ্ঠিত হয় ১৭ আগস্ট। হাবিবুর রহমান, লুৎফুল মতিন ও ফজলুল হক চৌধুরী- তিন কূটনীতিকের বাংলাদেশ মিশনে যোগ দেয়ার পর সিনিয়র কূটনীতিক কাউন্সিলর রেজাউল করীম যোগ দেন। ভারতের বাইরে সবচেয়ে বড় দলবেঁধে বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য প্রকাশ হয় ওয়াশিংটন ডিসিতে। সেখানে জাতিসংঘে পাকিস্তানের উপপ্রধান প্রতিনিধি ও মিনিস্টার সৈয়দ আনোয়ারুল করীমের নেতৃত্বে একযোগে ১৪ জন কূটনীতিক ও স্টাফ একসঙ্গে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন একাত্তরের ৪ আগস্ট। দলে ছিলেন ওয়াশিংটনে পাকিস্তানের উপমিশন প্রধান এনায়েত করীম, কাউন্সিলর শাহ এমএস কিবরিয়া, অর্থনৈতিক কাউন্সিলর আবুল মাল আবদুল মুহিত, শিক্ষাবিষয়ক কাউন্সিলর সৈয়দ আবুল রশীদ মতীন উদ্দিন, দ্বিতীয় সচিব (হিসাব বিভাগ) আতাউর রহমান চৌধুরী ও তৃতীয় সচিব (রাজনৈতিক) সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী। তিনজন স্থানীয়ভিত্তিক কর্মকর্তা শরফুল আলম, শেখ রুস্তম আলী ও আবদুর রাজ্জাক খান। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালের সিসিইউতে থাকা এনায়েত করীম দৃঢ়কণ্ঠে বলেছিলেন, মরতে হলে বাঙালি হিসেবে মরব, পাকিস্তানি হিসেবে নয়।

আনুগত্য প্রকাশের পর মুজিবনগর সরকারের সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান সিদ্দিককে মিশন প্রধান করে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ মিশন স্থাপন করা হয়। আর নিউইয়র্কে সৈয়দ আনোয়ারুল করীম ও ভাইস কনসাল মাহমুদ আলীকে নিয়ে মিশন গঠিত হয়। বাগদাগের পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত আবুল ফাতেহ, ম্যানিলার রাষ্ট্রদূত খুররম খান পন্নী, আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত আবদুল মোমেন, কায়রোর দ্বিতীয় সচিব ফজলুল করীম, লাগোসের তৃতীয় সচিব মহীউদ্দিন জায়গীরদার, তিউনিসিয়ার তৃতীয় সচিব সৈয়দ আমীরুল ইসলাম, নেপালের দ্বিতীয় সচিব মুস্তাফিজুর রহমান, টোকিওর প্রেস কাউন্সিলর এসএম মাসুদ ও তৃতীয় সচিব কমর রহীম, হংকংয়ের ভারপ্রাপ্ত বাণিজ্য মিশন প্রধান মহিউদ্দিন আহমেদ ও সুইজারল্যান্ডের ওয়ালিউর রহমান, নয়াদিল্লির কাউন্সিলর হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী যোগ দেন। তারা বিভিন্ন দেশ সফর করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বজনমত তৈরি করেন।

জাতিসংঘে প্রতিনিধি দল : বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে একটি প্রতিনিধি দল পাঠায় বাংলাদেশ সরকার। প্রতিনিধি দলটি বিভিন্ন দেশের দলের সঙ্গে ব্যাপক লবিং করে। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী নিউইয়র্কে যান ও ভাষণ দেয়ার অনুমতি চান। কিন্তু জাতিসংঘের সদস্য দেশ না হওয়ায় তাকে সেই সুযোগ দেয়া হয়নি। অন্যদিকে নিরাপত্তা পরিষদে পশ্চিমা দেশগুলো যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য এবং ভারত-পাকিস্তানের সৈন্যদের আন্তর্জাতিক স্বীকৃত নিজ নিজ সীমান্তে ফিরে যাওয়ার জন্য তিনটি প্রস্তাব দেয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের ভেটো দিয়ে বন্ধ করে। কারণ এ প্রস্তাবগুলো বাংলাদেশের সমস্যাকে সম্পূর্ণ ধামাচাপা দিতে চেয়েছিল।

বাংলাদেশের বিজয় ও যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক পরাজয় : একাত্তরের ৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধবিরতির জন্য জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবে ভেটো দেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন। ৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ইস্যুতে নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি সিনিয়র বুশের দ্বিতীয় দফা যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে কমরেড মালিক সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষ থেকে আবারো ভেটো প্রয়োগ করেন। বিশ্লেষকদের মতে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর তীব্র চাপ তৈরি করেছিলেন। আমেরিকার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের মাধ্যমে ভারতকে থামানো এবং পাকিস্তানকে ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করা। ভারতের ওপর এক ধরনের সামরিক হুমকি তৈরি করতে বঙ্গোপসাগরে রণতরীও পাঠিয়েছিল আমেরিকা। ৬ ডিসেম্বর মাত্র তিন ঘণ্টার ব্যবধানে বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ভুটান ও ভারত। হেনরি কিসিঞ্জার লিখেছেন, ইন্দিরা গান্ধীর দেয়া সেই স্বীকৃতির ফলে রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনার সব সম্ভাবনা কার্যত শেষ হয়ে যায়। ৯ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সন সপ্তম নৌবহরকে বঙ্গোপসাগরে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এটি ৭৫টি জঙ্গিবিমান বহন করছিল- যার অধিকাংশই ছিল এফ ফোর-ফ্যান্টম টু ফাইটার। এতে নিউক্লিয়ার বোমাসহ ২০০০ মেরিন সৈন্যের ব্যাটালিয়ন ও ২৫টি অ্যাসল্ট হেলিকপ্টার ছিল। ১১ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে সোভিয়েত প্রতিনিধিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার সাবধান করে দিয়ে বলেন, আগামীকাল ভারতকে অবশ্যই যুদ্ধবিরতি মেনে নিতে বাধ্য করানো হবে। না হলে যুক্তরাষ্ট্র নিজেই প্রয়োজনীয় সামরিক ব্যবস্থা নেবে। ১৩ ডিসেম্বর জাতিসংঘে ফের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেয় যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটোর কারণে আবারো ভেস্তে যায় ওই প্রস্তাব। এ অবস্থায় ১৫ ডিসেম্বর সপ্তম নৌবহর মালাক্কা প্রণালি থেকে বাংলাদেশ অভিমুখে বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করে। এদিকে সোভিয়েত সরকার সম্ভাব্য হুমকি প্রতিরোধ করতে ৬ ও ১৩ ডিসেম্বর অ্যাডমিরাল ভদ্মাদিমির ক্রন্টিয়াকভের অধীনে সোভিয়েত প্রশান্ত মহাসাগরীয় নৌবহরের দুই স্কোয়াডন ক্রুজার ও ডেস্ট্রয়ার এবং সুসজ্জিত পারমাণবিক সাবমেরিন পাঠায়। এগুলোর মধ্যে থেকে ৬ নম্বর ফ্লিট দিয়ে বঙ্গোপসাগর অভিমুখে থাকা সপ্তম নৌবহরকে তাড়াও করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়ার সব চেষ্টা ব্যর্থ হলে সেদিন জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক থেকে ক্ষোভ প্রকাশ করে বেরিয়ে যান পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র বাধ্য হয় বঙ্গোপসাগর থেকে সপ্তম নৌবহর ফিরিয়ে নিতে।

অকৃত্রিম বন্ধু ইন্দিরা গান্ধীর কূটনৈতিক কৌশল : বাংলাদেশে যুদ্ধ বিরতি এবং ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের জন্য জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে যে প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়েছিল, তাতে সমর্থন দিয়েছিল আমেরিকা। নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকা জানিয়েছে, এই প্রস্তাবের পক্ষে ১০৪টি ভোট পড়েছিল এবং বিপক্ষে ছিল ১১টি ভোট। ওই ভোটের পরদিন জাতিসংঘে নিযুক্ত ভারতীয় প্রতিনিধি দলের সদস্য নরেন্দ্র সিংকে উদ্ধৃত করে নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছিল, আমরা যুদ্ধবিরতি করব না। অবশ্যই না। আমরা বোকা নই। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সব ধরনের অর্থনৈতিক সহযোগিতা বন্ধ করে দেয়ার পরও নিজ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেনি ভারত। ভারত যাতে বাংলাদেশের পক্ষে হামলা বন্ধ করে সেই লক্ষ্যে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ৬ ডিসেম্বর সোভিয়েত নেতা লিওনিদ ব্রেজনেভকে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি। কারণ মস্কো চেয়েছিল ভারত যুদ্ধে যাক।

এর আগে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে বিদেশি নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ২৪ অক্টোবর পাশ্চাত্য দেশগুলোতে তার তিন সপ্তাহের সফর শুরু করেন। সকালে তিনি দিল্লি থেকে বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে রওনা হন। একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির ভোরের কাগজকে বলেন, এটি ছিল ইন্দিরা গান্ধীর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কূটনৈতিক সফর। তিনি বেলজিয়াম, অস্ট্রিয়া, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও পশ্চিম জার্মানি সফর করেন। তার লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে ভারতের অভিমত এবং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তায় বিঘ্ন ঘটাতে উদ্গ্রীব পাকিস্তানের যুদ্ধ হুমকি নিয়ে কথা বলা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App