×

জাতীয়

পাঠ্যবই নিয়ে এনসিটিবির ঢিলেমি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১২ ডিসেম্বর ২০২১, ০৯:০২ এএম

পাঠ্যবই নিয়ে এনসিটিবির ঢিলেমি

ফাইল ছবি

  • যথাসময়ে ছাপার কাজ শুরু হয়নি
  • ১ জানুয়ারি আংশিক বই পাবে শিক্ষার্থীরা
  • মাঠে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়

রাজধানী ঢাকার গোপীবাগের বাসিন্দা সামিয়া খাতুনের ৫ বছর বয়সি কন্যা জারিন আগামী ১ জানুয়ারি টিকাটুলির শহীদ নবী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণিতে ভর্তি হবে। স্কুলের প্রথম দিনেই নতুন বই নিয়ে ঘরে আসবে বলে তার মুখে এখন থেকেই হাসি লেগে আছে। গত সপ্তাহে সে স্কুল ব্যাগ, খাতা, কলম কিনেছে।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) গত বুধবার প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণির বইয়ের দরপত্র আহ্বান করেছে। এর পরদিন বৃহস্পতিবার মূল্যায়ন হয়েছে। এ সপ্তাহে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন হয়ে আসার পর প্রেস মালিকদের সঙ্গে চুক্তি হবে। তারপর প্রাক-প্রাথমিকের বই ছাপাখানায় পাঠানো হবে। সেক্ষেত্রে চলতি ডিসেম্বরের মধ্যে এই শ্রেণির বই ছাপার কাজ শেষ হবে কীভাবে? জারিনের মতো হাজারো শিক্ষার্থী জানে না- বই ছাপা না হওয়ায় এদিন স্কুলে ভর্তি হলেও নতুন বই হাতে পাবে না। কবে বই পাবে, তারও নিশ্চয়তা পাওয়া যাচ্ছে না। এনসিটিবি বলেছে, এই শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বই দেয়া হয় না। শুধু খাতা দেয়া হয়। খাতা ছাপা হয়ে গেছে।

সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির বই ছাপানোর জন্য গত ৯ নভেম্বর প্রেস মালিকদের সঙ্গে চুক্তি করেছে এনসিটিবি। নিয়ম অনুযায়ী চুক্তির পর বই ছাপাতে প্রেস মালিকরা ৮৪ দিন সময় পান। সেই হিসেবে ৩১ ডিসেম্বরের আগে এই দুই শ্রেণির বই ছাপার কাজও শেষ হবে না। এর ফলে ১ জানুয়ারি এই দুই শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সবকটি বই নাও পেতে পারে। এছাড়া অন্যান্য শ্রেণির পাঠ্যবই ছাপার আংশিক কাজ শেষ হয়েছে। এই আংশিক বই নিয়েই আগামী ১ জানুয়ারি পাঠ্যবই উৎসব করতে চায় শিক্ষা প্রশাসন।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, পাঠ্যবই ছাপানোর জন্য বাজার উপযোগী দাম নির্ধারণ করতে না পারা, বারবার দরপত্র আহ্বান করা, নির্ধারিত সময়ের বহু পরে ছাপার কাজ শুরু করা, অদক্ষ ও অযোগ্য কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেয়া, যোগ্য কর্মকর্তাদের ওএসডি করে রাখা এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ঢিলেমির কারণে সরকার ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে আগামী শিক্ষাবর্ষের সব পাঠ্যবই ছাপাতে পারবে না। অথচ দেশে বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপানোর কাজ শুরু হওয়ার পর থেকে গত বছর পর্যন্ত এ খাতে

সরকারের সাফল্য ছিল প্রসংশনীয়। এ বছর এসে পাঠ্যবই খাতে ‘ধরা’ খেলেন সংশ্লিষ্টরা। এ রকম পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা সময়মতো পাঠ্যবই যাতে হাতে পায় সেজন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এনসিটিবির কাজে হস্তক্ষেপ করেছে। বছরজুড়ে ঢিলেমি দেখিয়ে গত আগস্টের পর থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও পাঠ্যবই ছাপানোর কাজে বেশি তৎপর হয়েছে। এখন এসে মন্ত্রণালয় ১০টি পরিদর্শন টিম গঠন করেছে, যারা ঘুরে ঘুরে পাঠ্যবই ছাপানোর পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। একই সঙ্গে এনসিটিবিও ৩৯টি মনিটরিং টিম গঠন করেছে।

এমন হতাশাজনক তৎপরতার মধ্যেই এনসিটিবি বলছে, আগামী ২৫ ডিসেম্বরের মধ্যে ২০২২ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবই ছাপার কাজ শেষ হবে। এর ফলে এই সময়ের মধ্যে আগামী শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবইও প্রস্তুত হয়ে যাবে। সব বাধা কাটিয়ে পাঠ্যবই উৎসব করার জন্য শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্মতিও চাওয়া হয়েছে। সব ঠিকঠাক থাকলে আগামী ৩০ অথবা ৩১ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বই উৎসবের উদ্বোধন করবেন। আগামী ১ জানুয়ারি শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় পৃথকভাবে স্কুলে বই উৎসব পালন করবে। এনসিটিবি সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও এনসিটিবির একাধিক কর্মকর্তা ভোরের কাগজকে বলেছেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ভেবেছিল এনসিটিবি ঠিকসময়ে কাজটি শেষ করবে। কিন্তু এখন এসে তারা মন্ত্রণালয়কেও ডোবাচ্ছে। অন্যদিকে এনসিটিবি বলছে, পাঠবই ছাপানোর কাজের অনুমোদনের জন্য তারা সময়মতো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে গিয়েছিল, কিন্তু মন্ত্রণালয় থেকে সাড়া পায়নি। এই চাপানউতরের মধ্যেই গত সেপ্টেম্বরে এনসিটিবির কয়েকজন কর্মকর্তাকে ওএসডি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এরপর থেকে কাজ গতি পায়। এছাড়া চলতি ডিসেম্বরের শেষ দিকে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অবসরোত্তর ছুটিতে যাবেন। এনসিটিবির সদস্যরা পাঠ্যবইয়ের কাজ দেখভালের পরিবর্তে তারা চেয়ারম্যান হওয়ার তদবিরে ব্যস্ত। এর ফলে পাঠ্যবই ছাপানোর কাজ পিছিয়ে যায়। পাঠ্যবই ছাপানোর বর্তমান চিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, আগামী ফেব্রুয়ারির আগে সব পাঠ্যবই শিক্ষার্থীরা পাবে না।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ২০২২ শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের জন্য মোট ৩৪ কোটি ৭০ লাখ ২২ হাজার ১৩০ কপি পাঠ্যবই ছাপা হচ্ছে। এর মধ্যে প্রাথমিক স্তরের মোট বই ছাপা হচ্ছে ৯ কোটি ৯৮ লাখ ৫৮ হাজার ৮৭৪ কপি। আর মাধ্যমিক স্তরের জন্য মোট ২৪ কোটি ৭১ লাখ ৬৩ হাজার ২৫৬ হাজার কপি পাঠ্যবই ছাপা হচ্ছে। এনসিটিবির পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তর মিলিয়ে ১৬ কোটি বই ছাপানো হয়েছে। এর মধ্যে ১০ কোটি বই উপজেলাগুলোতে পাঠানো হয়েছে। চলতি ডিসেম্বরের পরবর্তী ২০ দিনে বাকি বইগুলোও পৌঁছে যাবে বলে জানিয়েছে এনসিটিবি। সব আশঙ্কা উড়িয়ে পাঠ্যবই ১ জানুয়ারি শিক্ষার্থীরা পাবে বলেও নিশ্চিত করেছেন এনসিটিবির কর্মকর্তারা।

জানতে চাইলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা ভোরের কাগজকে বলেন, গতকাল পর্যন্ত ৩৫ কোটি বইয়ের মধ্যে প্রায় ১৬ কোটি বই ছাপা শেষ হয়েছে। এর মধ্যে ১০ কোটি বই উপজেলায় পাঠানো হয়েছে। আগামী ২৫ ডিসেম্বরের মধ্যে আমরা পাঠ্যবই ছাপার কাজ শেষ করতে চাই। কিন্তু ৯ নভেম্বর প্রেস মালিকদের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী তারা আগামী ৮৪ দিনের মধ্যে বই ছেপে দেবে। সেক্ষেত্রে ফেব্রুয়ারির আগে সপ্তম-অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা বই পাবে না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আইন অনুযায়ী ৮৪ দিনের মধ্যেই তারা বই ছাপিয়ে দেবে। কিন্তু আমরা তাদের অনুরোধ করেছি ২৫ ডিসেম্বরের মধ্যে যেন বই ছাপিয়ে দেয় এবং আমরা আশা করছি তারা বই ছাপিয়ে দেবে।

এনসিটিবির সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) অধ্যাপক মো. ফরহাদুল ইসলাম গতকাল ভোরের কাগজকে বলেন, আমরা চেষ্টা করছি যথাসময়ে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দিতে। এখনো হাতে যে সময় আছে তাতে আশা করছি, বাকি উপজেলাতেও ঠিক সময়েই সব বই পৌঁছে যাবে। তিনি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকেও পাঠ্যবই ছাপার কাজ তত্ত্বাবধান করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ পাঠ্যপুস্তক মুদ্রক ও বিপণন সমিতির সভাপতি তোফায়েল খান ভোরের কাগজকে বলেন, জীবনে প্রথমবার যে শিশু স্কুলে যাবে সেই শিশু শিক্ষার্থী আগামী ১ জানুয়ারি বই পাবে না। গত ১০ বছরে এমন না হলেও এবার হয়েছে। কেন এমন হয়েছে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এনসিটিবিতে অদক্ষ, অযোগ্য কর্মকর্তাদের কারণে সরকার পাঠ্যবই নিয়ে লজ্জা পাবে। অথচ বিনামূল্যে পাঠ্যবই দেয়া ছিল এই সরকারের বড় অর্জন। শিক্ষা প্রশাসনতো বই উৎসবেরও ঘোষণা দিয়েছে, বই না দিতে পারলে উৎসব হবে কী করে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আংশিক বই দেবে। তাদের সংগঠনের পরিসংখ্যান মতে, ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ৬০ শতাংশ বই ছাপা শেষ হবে। তারপরও আমরা প্রেস শ্রমিকদের ওভারটাইম দিয়ে কাজ করাচ্ছি। পাঠ্যবই ছাড়া অন্য সব কাজ আগামী এক মাস বন্ধ রাখার জন্যও প্রেস মালিকদের নির্দেশনা দিয়েছি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলেন, নোয়াখালীতে অবস্থিত অগ্রণী প্রিন্টার্স একাই পেয়েছে প্রাথমিকের ৬০ শতাংশ বইয়ের ছাপার কাজ। গতকাল পর্যন্ত এই ছাপাখানাকে কয়েকদফায় সময় বাড়িয়ে দিয়েছে এনসিটিবি। কিন্তু এখনো সব বই ছাপিয়ে দিতে পারেনি। জানতে চাইলে অগ্রণী প্রিন্টার্সের মালিক রুবেল বলেন, ডিসেম্বরের মধ্যেই আমরা সব বই ছাপিয়ে দেব।

এ দিকে বই ছাপার কাজ তদারকিতে রয়েছেন এনসিটিবির এমন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ২০২২ শিক্ষাবর্ষের প্রাথমিক স্তরের বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ ও সরবরাহ নিয়ে কোনো অনিশ্চয়তা নেই। তবে যেহেতু নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে মাধ্যমিক স্তরের বই ছাপার কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে সে ক্ষেত্রে এখানে কিছুটা অনিশ্চয়তা রয়েছে। তারপরও ছাপাখানাগুলো যেভাবে দিন-রাত কাজ করছে তাতে মনে হয় না কোনো সমস্যা হবে।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) সূত্র জানায়, প্রাথমিকের পাঠ্যবই ছাপার কাজ আগেই শুরু হয়েছিল। তাই প্রাথমিক ও ইবতেদায়ি পর্যায়ের পাঠ্যবই নিয়ে কোনো সংকট হবে না। ইতোমধ্যে আট কোটির বেশি বই ছাপার কাজ শেষ হয়েছে। বেশির ভাগ বই উপজেলায় পৌঁছেও গেছে। আশা করা হচ্ছে, আগামী ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে সব বই পৌঁছে যাবে। সূত্র আরো জানায়, মাধ্যমিকের ২৪ কোটি বই ছাপার চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে গত ৯ নভেম্বর। বিগত বছরগুলোর কাজের ধারাবাহিকতায় দেখা গেছে, নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে এ বছর কাজ শুরু হওয়ায় ছাপাখানাগুলোতে এখন দম ফেলার সময় নেই। সাধারণ হিসাবেই দেখা গেছে, মাধ্যমিকের ২৪ কোটি ৭১ লাখ ৬৩ হাজার ২৫৬ কপি পাঠ্যবই ছাপতে সময়ে দেয়া হয়েছে ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত। সময়ের হিসাবে ৮ নভেস্বর থেকে ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই ৪৫ দিনে সব বই ছাপতে হলে প্রতিদিন গড়ে ছাপতে হবে ৫৪ লাখ ৯২ হাজার ২৫১ কপি বই। আর সেই টার্গেট পূরণ করতেই দিন-রাত কাজ হচ্ছে ছাপাখানাগুলোতে।

সম্প্রতি সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছিলেন, প্রতি বছর নতুন বই যথাসময়ে পাওয়া নিয়ে সবার মধ্যেই একটি শঙ্কা থাকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা যায় সব শঙ্কা পেছনে ফেলে শিক্ষার্থীরা ঠিক সময়েই বছরের প্রথম দিনে বই হাতে পায়। এ বছরও কোনো ব্যতিক্রম হবে না। করোনার কারণে এ বছরও বই উৎসব আমরা করতে পারব কিনা জানি না। তবে সব শিক্ষার্থীর হাতে বছরের প্রথম দিনেই নতুন বই তুলে দিতে পারব।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App