×

জাতীয়

অসাম্প্রদায়িক চেতনার লড়াই

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১১ ডিসেম্বর ২০২১, ০৯:৩৬ এএম

অসাম্প্রদায়িক চেতনার লড়াই

প্রতীকি ছবি

লাখো শহীদের রক্তে কেনা সংবিধানের প্রস্তাবনায় রাষ্ট্র পরিরচালনার চার মূলনীতি হলো- জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। সেই সঙ্গে সংবিধানের ২৮ (১) অনুচ্ছেদে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে- ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্রবৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।’ কিন্তু পঁচাত্তরে জাতির পিতা ও জাতীয় চার নেতা হত্যাকাণ্ডের পর রাষ্ট্রধর্ম নির্ধারণের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র নিজেই রচনা করেছে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প। বিজয়ের পঞ্চাশ বছরে রাজনীতির নানা খেলায় ধর্মনিরপেক্ষতায় আঘাত এসেছে বারবার। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূল বৈশিষ্ট্য বৈষম্যমুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক, অন্যায়, অবিচার, শোষণ, নিষ্পেষণমুক্ত সামাজিক ন্যায়বিচারভিত্তিক বাংলাদেশ। পঞ্চাশ বছর পরও চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনা।

বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীতে দাঁড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় কতটুকু এগুলো বাংলাদেশ- এমন প্রশ্ন সর্বত্র। বিশ্লেষক ও গবেষকদের মতে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন এখনো অধরা। স্বাধীনতার সাড়ে তিন বছরের মাথায় পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু ও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী জাতীয় চার নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করার মধ্য দিয়ে উল্টোপথে যাত্রা করে বাংলাদেশ। বন্দুকের নলের খোঁচায় ক্ষতবিক্ষত সংবিধান থেকে অন্তর্নিহিত হয়ে যায় ধর্মনিরপেক্ষতা। রাষ্ট্র কাঠামোর পরিবর্তনে দেখা দেয় নানা বৈপরীত্য। ইতিহাস বিকৃতির মহোৎসব, বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও দুর্নীতির ক্রমবিকাশে মুখ থুবড়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বৈষম্যমুক্ত, ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজ গঠনের আকাক্সক্ষা। এ ব্যাপারে বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ, ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য ভোরের কাগজকে বলেন, অসাম্প্রদায়িক চার মূল নীতি এখনো আছে তবে সাংঘর্ষিক রয়েছে। মৌলবাদের উত্থান ঘটেছে। জাতীয় সংগীত, জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতা প্রবল হচ্ছে। প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তি ব্যর্থ হলে বাড়ে মৌলবাদ। যখন গণতন্ত্র গণহীন গণতন্ত্র হয়, মুক্তিযুদ্ধের ধারা থেকে ক্রমেই সরে যায় দেশ, অতীত সংগ্রামের সাফল্য থেকে সরে যায় জাতি, তখন মৌলবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।

গবেষকদের মতে, বাহাত্তরের সংবিধানে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এবং জাতীয় চার নেতা হত্যাকাণ্ডের পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির সুযোগ করে দেন। পঞ্চদশ সংশোধনীর পর সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনা হলেও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়নি। ফলে ধর্মীয় সংগঠনগুলো এর সুযোগ নিচ্ছে এবং অপব্যবহার করছে। শুধু তাই নয়, রাষ্ট্রের ৫০ বছরে এসে রাষ্ট্রের স্থপতির ভাস্কর্য ভাঙার ধৃষ্টতা দেখিয়েছে মৌলবাদী সংগঠন। এর আগেও হেফাজতে ইসলামসহ ইসলামপন্থি কয়েকটি সংগঠনের ‘আবদারে’ সরিয়ে নেয়া হয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে গ্রিক দেবীর ভাস্কর্য, বন্ধ হয়ে যায় বাংলাদেশের বিবেক লালন ফকিরের ভাস্কর্য নির্মাণ। ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরে মৌলবাদী শক্তি হেফাজতের ঘাড়ে ভর করেই সরকার পতনের স্বপ্ন দেখেছিল বিএনপি-জামায়াত। রাজনৈতিক বিশ্লেষক, ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল ভোরের কাগজকে বলেন, মৌলবাদ গোটা দেশের জন্যই চ্যালেঞ্জ। বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িকতাকে তারা মেনে নিতে পারেনি। বাঙালি জাতীয়তাবাদ ধারণ করে না। কখনো কখনো রাষ্ট্রের তোষণনীতি মৌলবাদ পরিপোষণের কাজ করছে বলে মন্তব্য করেন এই ইতিহাসবিদ।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ধর্মকে ব্যবহার করে পাকিস্তান ২৩ বছর এদেশকে শোষণ করেছিল। ধর্মভিত্তিক পাকিস্তান রাষ্ট্রটি ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। কিন্তু পাকিস্তানিদের ভূত যাদের ঘাড়ে চেপে আছে, যারা মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনাবিরোধী, যারা সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাসী সেই অপশক্তি অশুভ কাজ করছে। তারা সুযোগ পেলেই সংখ্যালঘুদের অত্যাচার নির্যাতন করে। এ ব্যাপারে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির ভোরের কাগজকে বলেন, আমাদের অর্জন অনেক। নিজস্ব দেশ, মানচিত্র, নিজস্ব পতাকা, আর্থসামাজিক উন্নয়নে অনেক দেশের ‘রোল মডেল’ বাংলাদেশ। তবে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ এখনো সাম্প্রদায়িকতার কলঙ্ক থেকে মুক্তি পায়নি। কাক্সিক্ষত মুক্তির লড়াই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চালিয়ে যেতে হবে।

সরকারপক্ষের মতে, একটি চক্র বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। তবে বিজয়ের ৫০ বছরে এসেও পাকিস্তানের প্রেতাত্মা বা রাজাকারদের হুমকি শোনার জন্য বাংলাদেশ হয়নি। বিভিন্ন দেশের সরকার বাংলাদেশকে জঙ্গি দমনের রোল মডেল হিসেবে আখ্যায়িত করছে। তবে মাঝেমাঝে সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে আলোচনায় আসতে চায় মৌলবাদ গোষ্ঠী। জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ ও শক্তির জানান দিতে চায়। এদের পাত্তা দেয়ার কিছু নেই। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার সবসময় অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী। কিন্তু ক্ষমতার লোভে দেশকে অস্থিতিশীল করতে উগ্র-সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদী গোষ্ঠী রাষ্ট্র ও সরকারের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। তারা নানা অজুহাতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অস্থিরতা সৃষ্টির অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ধর্মীয় উন্মাদনা, ধর্মান্ধদের আমরা চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছি না। এই অপশক্তির যেন কোনোভাবেই উত্থান না ঘটে এ ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App