×

জাতীয়

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি রোধে খসড়া আইন এখনও বন্দিদশায়!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০২১, ০৮:৩১ এএম

মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অস্বীকার ও বিকৃতি রোধে আইন প্রণয়নের দাবির মুখে ২০১৬ সালের ২১ মার্চ আইন মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে খসড়া আইন জমা দেয় আইন কমিশন। এরপর পেরিয়ে গেছে পাঁচ বছর। আজো আলোর মুখ দেখেনি খসড়া আইনটি। কবে আলোর মুখ দেখবে, তা জানেন না কেউ। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষকরা। তাদের মতে, আইন না থাকায় একদিকে ইতিহাস বিকৃতিকারীদের শাস্তির আওতায় আনা যাচ্ছে না, অন্যদিকে থামানো যাচ্ছে না ইতিহাস বিকৃতির চর্চা। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস হারিয়ে গেলে জাতির অস্তিত্ব বিপন্ন হবে- এমন মন্তব্য করে বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীতে আইনটিকে ফাইলবন্দি দশা থেকে মুক্ত করে আলোর স্পর্শে আনার দাবি বিশেষজ্ঞদের।

‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতিকরণ অপরাধ আইন’ নামে প্রস্তাবিত আইনটির খসড়া তৈরির জন্য আইন কমিশনকে দায়িত্ব দেয় সরকার। সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বে কমিশন দীর্ঘদিন গবেষণার পর খসড়াটি প্রস্তুত করে ২০১৬ সালের মার্চে আইন মন্ত্রণালয় ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। এরপর আর কোনো অগ্রগতি নেই। তবে আইন প্রণয়নের কাজ চলছে মন্তব্য করে যত দ্রুত সম্ভব এটি প্রণয়ন করা হবে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।

আইনটি পাস হলে দেশি-বিদেশি কোনো ব্যক্তি প্রচারমাধ্যম, গণমাধ্যম বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার বা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি করে কিছু বললে ও লিখলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হবে। এই অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি পাঁচ বছর কারাদণ্ড বা ১ কোটি টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছিল। বিজয়ের পঞ্চাশ বছরে এই আইনটি কেন প্রয়োজন জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক ভোরের কাগজকে বলেন, গত ৫০ বছরে দীর্ঘ সময় মুক্তিযুদ্ধবিরোধীরাই ক্ষমতায় ছিল। তারা নানাভাবে ইতিহাস বিকৃতি করেছে। এখনো ইতিহাস বিকৃতির অপচেষ্টা করছে। জনগণকে বিভ্রান্ত করছে। এদের আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন। এছাড়া নতুন প্রজন্মকে সঠিক ইতিহাস জানানোর স্বার্থেও আইন প্রয়োজন।

যা আছে খসড়া আইনে : মহান মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা অস্বীকার, মুক্তিযুদ্ধের কোনো ঘটনাকে হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যম বা প্রচারমাধ্যমে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য প্রদান বা প্রচার, ১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রচারিত বা প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংক্রান্ত দলিল এবং ওই সময়ের যে কোনো ধরনের প্রকাশনার অপব্যাখ্যা বা অবমূল্যায়ন, পাঠ্যপুস্তকসহ যে কোনো মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে অসত্য, অর্ধসত্য, ভ্রান্ত বা বিভ্রান্তিকরভাবে উপস্থাপন; মুক্তিযুদ্ধের শহীদ, মুক্তিযোদ্ধা, নারী মুক্তিযোদ্ধা বা জনগণকে হত্যা, ধর্ষণ ও তাদের সম্পত্তি লুট বা অগ্নিসংযোগ সংক্রান্ত যে কোনো তথ্যের অবনমন; মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত কোনো ঘটনা, তথ্য বা উপাত্ত ব্যঙ্গাত্মকভাবে উপস্থাপন; মুক্তিযুদ্ধকে জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রাম ভিন্ন অন্য কোনো রূপে অবনমন বা অবমাননা; পাকিস্তানি দখলদার সশস্ত্র বাহিনী, তাদের বিভিন্ন সহায়ক বাহিনী, যেমন- রাজাকার, আলবদর, আলশামস ইত্যাদির বিভিন্ন অপরাধমূলক কার্যক্রমের পক্ষে কোনো ধরনের যুক্তি প্রদর্শন বা প্রচার; মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ, শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ, গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধকে সমর্থন বা ওই রকম অপরাধের বিচার কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করা বা এ বিষয়ে কোনো ধরনের অপপ্রচার অপরাধ বলে গণ্য হবে। এ ধরনের অপরাধের জন্য আইনে সর্বোচ্চ সাজা পাঁচ বছর কারাদণ্ড বা ১ কোটি টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের প্রস্তাব রাখা হয়েছে।

ইতিহাস বিকৃতির মহোৎসব : ধর্ম নিরপেক্ষতা-সাম্প্রদায়িকতা-ইতিহাস বিকৃতির মহোৎসবে অবহেলিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মুখ থুবড়ে পড়েছে বারবার। ফলে ৫০ বছরেও পাঠ্যপুস্তকে পূর্ণাঙ্গভাবে প্রতিফলিত হয়নি মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাথা, নির্মম-নিষ্ঠুর গণহত্যা, পৈশাচিক নারী নির্যাতনসহ মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনা। এখনো গণহত্যা, নারী নির্যাতনের বিবরণ পাঠ্যপুস্তকে ওভাবে আসেনি। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথার ইতিহাস পাঠ্যপুস্তকে আসেনি। গবেষকদের মতে, উল্টো নানাভাবে ইতিহাস বিকৃতির মহোৎসব চলছে। বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার খুনিদের নানাভাবে পুরস্কৃত করা, স্বাধীনতাবিরোধীদের হাতে জাতীয় পতাকা তুলে দেয়া, স্বাধীনতার ঘোষক, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রশ্নবিদ্ধ করা, যুদ্ধাপরাধের বিচার, ৩০ লাখ শহীদদের সংখ্যার মতো মীমাংসিত বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলে ইতিহাস বিকৃতির অপচেষ্টা করা হয়।

আইন না থাকায় অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে মন্তব্য করে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামসুদ্দীন চৌধুরী মানিক ভোরের কাগজকে বলেন, অনেক আগেই আইনটি হওয়া উচিত ছিল। ইতিহাস বিকৃতির ধারা আজো বন্ধ হয়নি। যারা মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তোলে, বুদ্ধিজীবীরা কেন দেশের বাইরে যাননি বলে প্রশ্ন তোলে, তারাও ইতিহাস বিকৃতির মধ্যে পড়ে। অন্যদিকে জিয়াকে এখনো স্বাধীনতার ঘোষক বলা হচ্ছে। তাদের দল ক্রমাগত ইতিহাস বিকৃতি করছে। আইন হলে এদের বিচারের আওতায় আনা যেত।

মুক্তিযুদ্ধ গবেষকদের মতে, এ রকম আইন প্রণয়ন সময়ের দাবি। দেশবিরোধী শক্তি, বিশেষ করে একাত্তরের পরাজিত শক্তি মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে দেশে-বিদেশে নানাভাবে অপপ্রচার চালাচ্ছে। দেশের একটি বড় রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে নানাভাবে কথা বলে। তারা মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা থেকে শুরু করে প্রতিটি বিষয় নিয়ে কটূক্তি ও মিথ্যাচার করে। প্রকারান্তরে তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকেই অস্বীকার করে। এ রকম চলতে থাকলে দেশ পথহারা হয়ে যাবে। এজন্য আইনটি পাস করা জরুরি।

এ ব্যাপারে একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির ভোরের কাগজকে বলেন, আইনটি জরুরি। ’৭৫-এর পর থেকেই ইতিহাস ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। সংবিধান ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। সবই ইতিহাস বিকৃতির ধারাবাহিকতা। ইউরোপের আদলে হলোকাস্ট আইন প্রয়োজন। ৬ মাস থেকে ১৫ মাস শাস্তি এবং জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস হারিয়ে গেলে আমাদের অস্তিত্ব থাকবে না। সময় চলে যাচ্ছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App