×

জাতীয়

যুদ্ধাপরাধীদের সম্পদ জব্দের কী হলো

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৮ ডিসেম্বর ২০২১, ০৮:৩৮ এএম

যুদ্ধাপরাধীদের সম্পদ জব্দের কী হলো

মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শীর্ষস্থানীয় কয়েকজনের বিচারের পর তাদের মালিকানাধীন ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ অঢেল সম্পদের বিষয় আলোচনায় আসে। এমনকি মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার ঠেকাতে বিদেশে কোটি কোটি টাকা খরচ করে তারা লবিস্ট নিয়োগ করেছিল। এমন পরিস্থিতিতে যুদ্ধাপরাধীদের সম্পদ বাজেয়াপ্তের বিষয়ে সোচ্চার হন শহীদ পরিবার, মুক্তিযোদ্ধাসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। ২০১৬ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধুর খুনি ও দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধীদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার একটি প্রস্তাব জাতীয় সংসদে তোলা হলে সর্বসম্মতিক্রমে তা গৃহীত হয়। তবে এ বিষয়ে আইন প্রণয়নের কথা বারবার বলা হলেও তা এখনো আলোর মুখ দেখেনি।

জানা যায়, জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি কার্যকরের আগেই সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি পরিবারের সদস্যদের নামে হস্তান্তর করেন তিনি। জামায়াতের নায়েবে আমির মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী আব্দুস সুবহান বিচারের আগেই সন্তানদের নামে সম্পত্তি হস্তান্তর করেন। বিচার শুরুর আগেই বাড্ডা এলাকায় থাকা সম্পত্তি পানির দামে বিক্রি করে দেন চট্টগ্রামের কুখ্যাত রাজাকার সাকা চৌধুরী। ফরিদপুরের কুখ্যাত রাজাকার পলাতক আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারও পালিয়ে যাওয়ার আগে একাধিক সম্পত্তি বিক্রি করেন। পিরোজপুরের সাবেক এমপি ইঞ্জিনিয়ার আবদুল জব্বার পালিয়ে যাওয়ার আগে গোপনে কিছু সম্পত্তি বিক্রি করেন। গোপনে সম্পত্তি হস্তান্তর করেন কক্সবাজার-মহেশখালীর যুদ্ধাপরাধ মামলার প্রধান আসামি মৌলভী জাকারিয়া।

একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সহায়তা করে জামায়াতে ইসলামীসহ বেশ কয়েকটি ধর্মভিত্তিক দল। রাজাকার, আলবদর, আলশামস নামে বিভিন্ন দল গঠন করে তারা ধর্ষণ, অপহরণ, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ, ধর্মান্তরে বাধ্য করার মতো যুদ্ধাপরাধ ঘটায়। সাধারণ মানুষের ধনসম্পদও লুট করে তারা। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরুর উদ্যোগ নেয়া হলে তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার দাবি ওঠে। মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক ও শহীদ সন্তানদের মতে, ওই বছর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর গোপনে সম্পত্তি বিক্রি করে পালিয়ে যায় চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের অনেকেই। যারা পালাতে পারেনি তারা বিভিন্ন সময় পরিবারের সদস্যদের নামে সম্পত্তি হস্তান্তর করেন। ২০১৩ সালে কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে গড়ে ওঠা শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনেও যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্তদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার দাবি জোরালো হয়। তারই ধারাবাতিকতায় ২০১৬ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধুর খুনি ও দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধীদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার একটি প্রস্তাব জাতীয় সংসদে তোলা হলে সর্বসম্মতিক্রমে তা গৃহীত হয়। জানা যায়, স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে যুদ্ধাপরাধীরা মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশবিরোধী রাষ্ট্রগুলোর আর্থিক সহায়তা লাভ করে ব্যাংক,

বিমা, হাসপাতাল, ক্লিনিক, এনজিও ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে বিপুল ধনসম্পদের মালিক বনে যায়। যুদ্ধাপরাধীদের সম্পদ বাজেয়াপ্তের পাশাপাশি জামায়াতের সম্পদ বাজেয়াপ্তের তালিকায় রয়েছে ইসলামী ব্যাংক, ইবনে সিনা, কেয়ারী ফুড, ইসলামী ব্যাংক চক্ষু হাসপাতাল, সান সিটি, দৈনিক সংগ্রাম, শতাব্দী প্রেস, আধুনিক প্রকাশনী প্রেস, দারুল ইসলাম ট্রাস্ট, সোনার বাংলা পত্রিকা, রাবেতা ইসলাম, দারুল ইসলাম ট্রাস্ট, ফুলকুড়ি, ফালাহ্ আম ট্রাস্টসহ ১০৯টি প্রতিষ্ঠান। অভিযোগ রয়েছে, এসব সম্পদ তারা ব্যবহার করছে রাষ্ট্রবিরোধী সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে। জঙ্গিদের আর্থিক সহায়তাও দেয়া হচ্ছে। যুদ্ধাপরাধী যারা ট্রাইব্যুনাল থেকে সাজাপ্রাপ্ত হচ্ছে তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার দাবি সর্বস্তরের স্বাধীনতার সপক্ষের ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর। কিন্তু কয়েক বছর ধরে এই দাবি শুধু আশার বাণী হয়েই রয়েছে।

এদিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মিরপুরের কাদের মোল্লার বিচারের রায়ের মধ্যদিয়ে শুরু হয়ে একে একে জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, কামারুজ্জামান, সাকা চৌধুরী ও মীর কাসেম আলীর বিচার সম্পন্নের পর তাদের প্রত্যেকের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। আরো অনেকের ফাঁসির রায় হয়েছে। এ বিচার এখনো অব্যাহত আছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে যাদের মৃত্যুদণ্ড অথবা আজীবন কারাদণ্ড হয় তাদের বিচারিক নথি থেকে দেখা যায়, শুধু তাদের বিরুদ্ধে হত্যা, খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, নির্যাতনের অভিযোগই ছিল না, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সম্পদ লুট, দখল করে তাদের বিতাড়ন করা, পরে ওই সম্পত্তি দখল করে ভোগ করা, সাধারণ স্বাধীনতাকামীদের সম্পদ লুটের অভিযোগও প্রমাণিত হয়েছে প্রায় প্রত্যেকের বিরুদ্ধে।

২০১৬ সালে বিজয় দিবসের প্রাক্কালে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছিলেন, আইন করে মানবতাবিরোধীদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হবে। এরপর ওই অর্থ দেশের কল্যাণে ব্যয় করার পরিকল্পনা করা হয়েছে বলেও তিনি জানান। মন্ত্রীর এই প্রতিশ্রæতির কথা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পায়। আইনমন্ত্রী অন্য একটি অনুষ্ঠানে এ সংক্রান্ত আইনের খসড়া প্রণয়নের কাজ চলছে বলেও জানান। একই বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক সার্ক চলচ্চিত্র সাংবাদিক ফোরামের এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, মানবতাবিরোধীদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার আইন করা হবে। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরেও তিনি আইন করার কথা বলেন। মানবতাবিরোধীদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার বিষয়টি সংসদেও উত্থাপিত হয়। ২০১৬ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর সংসদে সংসদ সদস্য প্রয়াত ফজিলাতুন্নেছা বাপ্পী বিষয়টি প্রস্তাব আকারে উত্থাপন করেন। সর্বসম্মতভাবে ওই প্রস্তাব গ্রহীত হয়, কিন্তু এখনো তা আইনে পরিণত হয়নি।

এ বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা ভোরের কাগজকে বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের সম্পদ বাজেয়াপ্তের বিষয়ে একটা সময় আইনের খসড়া প্রস্তুতির কাজ শুরু হয়েছিল। তবে বর্তমানে ওই উদ্যোগ একেবারেই আলোচনার বাইরে। এটি নিয়ে আইন মন্ত্রণালয়ে কোনো কাজ হচ্ছে বলে আমার জানা নেই। এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের মোবাইল ফোনে বেশ কয়েকবার কল করলেও তিনি রিসিভ করেননি। এছাড়া মন্ত্রীর হোয়াটসঅ্যাপ ও মেসেঞ্জারে খুদে বার্তা পাঠিয়েও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।

এদিকে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কেন সরকার তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেনি এমন প্রশ্ন গবেষকদের। এ ব্যাপারে একাত্তরের ঘাতক-দালাল-নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির ভোরের কাগজকে বলেন, আমরা বারবার বলেছি, ট্রাইব্যুনালে যাদের বিচার হয়েছে, শাস্তি হয়েছে, তারা যখন ক্ষমতায় ছিল, ক্ষমতার অংশীদার ছিল, তখন সম্পদের বিশাল পাহাড় বানিয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছে। মীর কাসেম আলী একাত্তরে কী ছিল? আর এখন কত টাকার সম্পদ রেখে কবরে গেল? এই সম্পদ এ দেশের জনগণের সম্পদ। মুক্তিযুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের অনেক পরিবারই নিঃস্ব হয়েছেন। আমাদের কাছে অনেকেই আসে, যারা ভিক্ষা করে। তাদের অনেকেরই ভিটেমাটি নেই। মুক্তিযুদ্ধের এই গবেষক বলেন, এদের যাবতীয় সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে ৩০ লাখ শহীদ পরিবারের পুনর্বাসনের জন্য ব্যয় করতে হবে। এদের শাস্তি হয়েছে কিন্তু এদের কারণে যারা প্রায় ৫০ বছর ধরে ভুক্তভোগী তাদের ক্ষতিপূরণের কী হবে? কিন্তু সরকার এখনো এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানায়নি। ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর্যবেক্ষণে আছে, মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর আমরা অতিক্রম করতে যাচ্ছি। কিন্তু শহীদ পরিবারের দুঃখ কষ্ট তো এখনো শেষ হয়নি।

সম্পদ বাজেয়াপ্ত ছাড়াও যুদ্ধাপরাধীর সন্তানদের সরকারের উচ্চপদে চাকরি না দেয়া, কোনো রাজনৈতিক দলে অন্তর্ভুক্তি না করার আহ্বান গবেষকদের। জানতে চাইলে ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিংয়ের প্রধান ডা. এম এ হাসান ভোরের কাগজকে বলেন, যারা শান্তি কমিটির সদস্য ছিল তাদের বিরুদ্ধে আগে ব্যবস্থা নেয়া উচিত। আলবদর বাহিনীর সবাইকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো প্রয়োজন। রাজাকারদের মধ্যে যারা যুদ্ধাপরাধী, মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত তাদের শাস্তির আওতায় আনা আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি। তাদের কোনো অধিকারই থাকা উচিত নয়। রাষ্ট্রীয় কোনো লাভজনক প্রতিষ্ঠানে যুদ্ধাপরাধীর সন্তান যেন চাকরি না পায় বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। আজকাল ঘোষণা দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোতে এরা স্থান পাচ্ছে। কিন্তু কোনো রাজনৈতিক দলে যেন এরা ঠাঁই না পায়, চলতি ডিসেম্বরেই দলগুলোর এই সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App