×

জাতীয়

মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি বন্ধুদের নামে স্মৃতিফলক: দাবিতেই অর্ধশতক পার!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০২ ডিসেম্বর ২০২১, ০৯:১২ এএম

মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি বন্ধুদের নামে স্মৃতিফলক: দাবিতেই অর্ধশতক পার!

ছবি: সংগৃহীত

১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ। রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নৌকার আদলে একটি মঞ্চ তৈরি করেছিলেন সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। উদ্দেশ্য মহান মুক্তিযুদ্ধে অসীম অবদানে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে সম্মান জানানো। ইন্দিরা গান্ধীর নামানুসারেই মঞ্চটির নামকরণ করা হয় ইন্দিরা মঞ্চ। শেখ মুজিবের জন্মদিনে ওই মঞ্চেই নেহেরুকন্যাকে রাজকীয় সংবর্ধনা দেয়া হয়। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর জিয়াউর রহমানের নির্দেশে ইন্দিরা মঞ্চটি ভেঙে সেখানে নির্মিত হয় জাতীয় শিশু পার্ক।

স্বাধীনতার ৪০ বছর পর মুক্তিযুদ্ধের বিদেশি বন্ধুদের সম্মাননা জানিয়েছে বাংলাদেশ। তবে বিদেশি বন্ধুদের সম্মাননা জানানোর পাশাপাশি তাদের নামে স্থাপনা এবং রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়কের নামকরণের দাবিতেই পেরিয়ে গেছে অর্ধশতক।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষকদের মতে, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতেই ইন্দিরা গান্ধী, রণাঙ্গনের নায়ক জগজিৎ সিং অরোরা, একমাত্র বিদেশি বীরপ্রতীক ওডারল্যান্ড, আমেরিকান কূটনীতিক আর্চার কে ব্লাড, জার্মান চ্যান্সেলর উইলি ব্র্যাড, সিনেটর এডওয়ার্ড, ফ্রান্সের জাতীয় বীর আর্দ্রে মার্লোসহ মুক্তিযুদ্ধের বিদেশি বন্ধুদের নামে স্থাপনা এবং সড়কের নামকরণ করা হলে বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আরো উজ্জ্বল হবে। কূটনৈতিক সম্পর্ক আরো বাড়বে। সেই সঙ্গে বিশ্বের তরুণদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস সম্পর্কে আগ্রহ বাড়বে।

এ ব্যাপারে একাত্তরের ঘাতক-দালাল-নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির ভোরের কাগজকে বলেন, চার বছর আগে ইন্দিরা গান্ধীর জন্মশত বর্ষ পালনের সময় আমাদের দাবি ছিল, রাজধানীর একটা গুরুত্বপূর্ণ সড়কের নাম তার নামে করার জন্য। কিন্তু কেন যেন সরকার এক্ষেত্রে উদাসীন। মুক্তিযুদ্ধে তুরস্ক ছিল পাকিস্তানের পক্ষে। অথচ তুরস্কের জাতির পিতা

কামাল আতাতুর্কের নামে সড়ক আছে। আর যে ইন্দিরা গান্ধীর কারণে ৯ মাসে আমরা বিজয় পেয়েছি তার নামে একটা স্থাপনা না থাকা দুর্ভাগ্যজনক। আমরা সুনির্দিষ্টভাবে প্রস্তাব করেছিলাম গুলশান কূটনৈতিক পাড়া, যা গুলশান এভিনিউ নামে পরিচিত সেটি ‘ইন্দিরা গান্ধী এভিনিউ’ নামে করার জন্য। প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক সম্মতও হয়েছিলেন। ভারতীয় দূতাবাসের সড়কটি বিজয়ের আরেক নায়ক রণাঙ্গনের জগজিৎ সিং অরোরার নামে করার কথা হয়েছিল। আনিসুল হকের মৃত্যুতে এই উদ্যোগ থেমে যায়।

তিনি বলেন, ইন্দিরা গান্ধীসহ অন্যদের নামে স্থাপনা ও সড়কের নামকরণ করলে আমাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। কূটনৈতিক সম্পর্ক আরো বাড়বে। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি বহির্বিশ্বের জানার আগ্রহ বাড়বে। সারা বিশ্বের প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ত্যাগ-তিতিক্ষা-বীরত্বগাঁথা ছড়িয়ে দিতে পারব। আমরা আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু সবকিছুর জন্য সরকারি সিদ্ধান্ত জরুরি।

সড়কের নামকরণের জন্য একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি প্রস্তাবিত নামগুলো হলো- ভারতের জগজিৎ সিং অরোরা, অটলবিহারী বাজপেয়ী, পণ্ডিত রবিশঙ্কর, অন্নদাশঙ্কর রায়, ওয়াহিদা রেহমান, রাশিয়ার লিওনিদ ব্রেজনেভ, আলেক্সেই কোসিগিন, কিউবার ফিদেল কাস্ত্রো, সাবেক যুগোশ্লাভিয়ার জোশেফ টিটো, যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাডওয়ার্ড কেনেডি, জর্জ হ্যারিসন, অ্যালেন গিনসবার্গ, জোয়ান বায়েজ, এডওয়ার্ড হিথ, যুক্তরাজ্যের পিটার সোর, মার্ক টালি, জার্মানির উইলি ব্র্যান্ড, ফ্রান্সের আঁদ্রে মালরো, সুইডেনের গুনার মিরডাল, আয়ারল্যান্ডের শন ম্যাকব্রাইড, নোরা শরিফ, ডেনমার্কের কার্সটেন ওয়েস্টারগার্ড, ইতালির শহীদ ফাদার মারিও ভেরোনিস, আর্জেন্টিনার ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো, অস্ট্রেলিয়ার উইলিয়াম ওডারল্যান্ড (বীরপ্রতীক), জিওফ্রে ডেভিস, নেপালের বিশ্বেশ্বর প্রসাদ কৈরালা, ভুটানের রাজা জিগমে দোরজি ওয়াংচুক, জাপানের তাকাশি হায়াকাওয়া, তাকাওশি সুজুকি, মিসরের রিফাত মোহাম্মদ সাঈদ ও পাকিস্তানের খান আবদুল গাফফার খান। শাহরিয়ার কবির বলেন, ভারত ও পাকিস্তানে বিদেশি বন্ধুদের নামে আমি এ ধরনের সড়কের নামকরণ করতে দেখেছি। এমনকি কলকাতায় ও দিল্লিতে বঙ্গবন্ধুর নামে সড়ক রয়েছে।

গবেষকদের মতে, বিশ্ব জনমত গঠনে ইন্দিরা গান্ধীর ভূমিকা অসামান্য। শুধু ১ কোটি শরণার্থীর আশ্রয়, খাবার-চিকিৎসার পাশাপাশি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাই নয়, ভারত পাশে না থাকলে বিজয় প্রলম্বিত হতো। রাজধানীতে তার নামে স্থাপনা জরুরি। এছাড়া মহান মুক্তিযুদ্ধে রক্ত দিয়েছে ভারত। সালাম আজাদের ‘কন্ট্রিবিউশন অফ ইন্ডিয়া ইন দি ওয়ার অব লিবারেশন অব বাংলাদেশ’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, এক হাজার ৫০০ ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রাণ উৎসর্গ করেছেন। ২০১০ সালে লে. জে. বিজয় কুমার সিংহের নেতৃত্বে ভারতীয় একটি প্রতিনিধিদল ঢাকায় এলে তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধ প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব.) এ বি তাজুল ইসলাম ঘোষণা দেন, তাদের সম্মানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হবে। যেখানে নিহত সৈনিকদের নাম অন্তর্ভুক্ত থাকবে। তবে ঘোষণাতেই আটকে রয়েছে এ উদ্যোগ।

এ ব্যাপারে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দীন চৌধুরী ভোরের কাগজকে বলেন, ১৯৭২ সাল থেকেই আমরা এই দাবি জানিয়ে আসছি। বঙ্গবন্ধু ইন্দিরা মঞ্চ করেছিলেন। জিয়া এসে ভেঙে দেন। এখন তো রাজধানীতে মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি বন্ধুর নামে কোনো স্থাপনা বা সড়ক নেই। ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে একটি স্মৃতিসৌধ রয়েছে। ভারত, ইংল্যান্ড, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রের অকৃত্রিম বন্ধুরা মুক্তিযুদ্ধের সময় সহযোগিতা করেছেন। তাদের নাম সংরক্ষণ জরুরি। এতে একদিকে আমাদের তরুণ প্রজন্ম জানতে পারবে অন্যদিকে, বিদেশে আমাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। নতুবা আমরা অকৃতজ্ঞ জাতিতে পরিণত হবো।

এদিকে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শ সমুন্নত রেখে কাজ করার প্রত্যয় নিয়ে ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ সরকার। দায়িত্ব নেয়ার পর তৃণমূল পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধিস্থল সংরক্ষণ ও উন্নয়ন প্রকল্প, মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক স্থানগুলো সংরক্ষণ ও স্মৃতি জাদুঘর নির্মাণসহ ৬টি প্রকল্প নেয়া হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধের বিদেশি বন্ধুদের স্মৃতিরক্ষার ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App