×

মুক্তচিন্তা

রেমিট্যান্স প্রবাহ কমছে

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০১ ডিসেম্বর ২০২১, ০১:৪০ এএম

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে দেশে রেমিট্যান্সের প্রবাহ কমে যাওয়ার হার উদ্বেগজনক। এর পেছনে কারণ হিসেবে মহামারির বিধিনিষেধ উঠে যাওয়ার পর অর্থ লেনদেনের অবৈধ চ্যানেলগুলো চালু হওয়া, নতুন বৈদেশিক নিয়োগ কমে যাওয়া এবং প্রবাসীদের চাকরি হারানোর মতো বিষয়গুলোকে চিহ্নিত করা যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে দেশে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে প্রায় ৫ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার এসেছে। গত বছর একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ৬ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মালয়েশিয়া, এই তিন দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসে। এ বছর এই তিন দেশ থেকে উল্লিখিত তিন মাসে গত বছরের চেয়ে ৯৩২ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলার কম এসেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে গত অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকের চেয়ে ৭৭১ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলার কম রেমিট্যান্স পেয়েছে বাংলাদেশ। মহামারিতে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ধস নামলেও দেশে আসা রেমিট্যান্সের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছিল। প্রবাসীরা দেশে ২৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়ে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেন, যা অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মহামারির মধ্যে রেমিট্যান্সের বৃদ্ধি অনেককেই বিস্মিত করেছিল। সব ধরনের অর্থ আনুষ্ঠানিক চ্যানেলের মাধ্যমে আসছিল তখন। যাতায়াতের বিধিনিষেধ ও বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি কার্যত বন্ধ থাকার কারণে হুন্ডির মতো অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলগুলো তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছিল না। কিন্তু এই অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলগুলো বিধিনিষেধ উঠে যাওয়ার পর আবার চালু হয়েছে এখন। ফলে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে রেমিট্যান্স কমে যাচ্ছে। ২০২০ সালের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশি প্রবাসীরা মালয়েশিয়া থেকে ৬০৭ দশমিক ২৪ মিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছিলেন। এই পরিমাণ কমে এ বছর ২৯০ দশমিক ৮৫ মিলিয়ন হয়েছে, অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় এ বছরের রেমিট্যান্স ৩১৬ দশমিক ৩৯ ডলার কম। সৌদি আরব থেকে গত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আসে। এ বছর একই সময় ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে গত বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে ৭৫২ দশমিক ৪৭ মিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। এ বছরের পরিমাণ ৪৪৬ দশমিক ১৭ মিলিয়ন। যুক্তরাজ্য ও কুয়েত থেকে আগের বছরের তুলনায় রেমিট্যান্স যথাক্রমে ৬৪ দশমিক ১৮ মিলিয়ন ও ২৪ দশমিক ৩৩ মিলিয়ন ডলার কমে গেছে। অক্টোবর মাসে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ১৬৪ কোটি ৬৮ লাখ মার্কিন ডলার। আগের মাসে অর্থাৎ সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৭২ কোটি ৬২ লাখ মার্কিন ডলার। এর আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরের মে মাসে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৫০ কোটি ৪৬ লাখ মার্কিন ডলার। এরপর থেকে এত কম রেমিট্যান্স আসেনি। ১৭ মাস পর ফের রেমিট্যান্স এতটা কমেছে। জুলাই ২০১৯ থেকে সরকার বিদেশ থেকে পাঠানো টাকার ওপর ২ শতাংশ প্রণোদনা দিচ্ছে। আনুষ্ঠানিক চ্যানেলের মাধ্যমে আসা রেমিট্যান্স কমে যাওয়াতে সরকারের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ এবং বিনিময় মূল্যের ওপর চাপ পড়বে। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাই থেকেই রেমিট্যান্সের প্রবাহ কমতে শুরু করেছে। গত অক্টোবর মাসেও তা অব্যাহত ছিল। যা গত ১৭ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে। কিন্তু করোনাকালে লকডাউন থাকায় প্রবাসীদের জীবনযাত্রার ব্যয় কমে গিয়েছিল বিপরীত দিকে লকডাউন থাকায় অবৈধ পথে রেমিট্যান্স আসেনি। ওই সময় প্রবাসীরা তাদের জমানো অর্থ দেশে পাঠানোর কারণেই রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়ে গিয়েছিল। করোনা মহামারির কারণে অনেক প্রবাসী কাজ হারিয়েছেন, অনেকে দেশে ফেরত এসেছেন। তাছাড়া যারা প্রবাসে আছেন তাদের খরচ বেড়েছে, ওভারটাইম কমেছে। এসব কারণে রেমিট্যান্স প্রবাহ ফের সঠিক জায়গায় ফিরে আসছে। করোনাকালে রেমিট্যান্স আসার যে রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছিল তার বেশ কিছু কারণ আছে। আমাদের রেমিট্যান্স আসার অন্যতম উৎস মধ্যপ্রাচ্য। করোনায় অনেকের কাজ কমে গেছে, যারা ওভারটাইম করতেন তারা তা করতে পারছেন না। করোনার আগে যেসব প্রবাসী দেশে এসেছিলেন তারা অনেকেই ফেরত যেতে পারেননি। তাছাড়া করোনার মাঝেও যারা দেশে এসেছেন তারা তাদের সব আয় দেশে ফেরত এনেছেন। ফলে করোনাকালে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি রেমিট্যান্স এসেছিল। তবে এখন যে পরিমাণ রেমিট্যান্স দেশে আসছে তা দুয়েক মাসের মধ্যে আরো বাড়বে। রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানোর জন্য বৈধ পথে তা পাঠালে প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্য ছাড়াও নতুন নতুন দেশ খুঁজতে হবে যেখানে আমাদের দক্ষ মানবসম্পদ কাজ করতে পারবে। তাতে রেমিট্যান্সের প্রবাহ আরো বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে ২ হাজার ৪৭৮ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল। যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩৬ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১ হাজার ৮২০ কোটি ৪৯ লাখ ডলার রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। করোনায় লকডাউন থাকায় এতদিন হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স আসেনি। তাছাড়া প্রণোদনার কারণে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স এসেছে। এতে রেমিট্যান্সের উল্লম্ফন হয়েছে, যা বেশি দিন থাকেনি। তবে এখন যেটা এসেছে সেটাই স্বাভাবিক। করোনায় প্রবাসীদের কাজের সুযোগ কমে যাওয়াসহ বেশ কিছু কারণে রেমিট্যান্স কমেছে। করোনার আগে ও করোনাকালে যেসব প্রবাসী দেশে এসেছেন তাদের অনেকেই নানা প্রতিবন্ধকতায় পড়ে ফেরত যেতে না পারা, করোনায় কাজের সুযোগ কমে যাওয়া, অনেকের কাজ হারানো, ওভারটাইম করতে না পারা; বিপরীত দিকে প্রবাসীদের ব্যয় বেড়ে যাওয়ার রেমিট্যান্সে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। যেহেতু সরকারের জন্য রেমিট্যান্স খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিরীক্ষণ প্রক্রিয়াকে আরো শক্তিশালী করতে হবে, যাতে অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলের মাধ্যমে টাকা পাঠানো নিরুৎসাহিত হয়। সরকারের উচিত বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় মূল্য স্থিতিশীল রাখা। তবে মধ্যপ্রাচ্য ছাড়াও বিশ্বের অন্যান্য দেশে নতুন নতুন শ্রম বাজার খুঁজে বের করে দক্ষ মানবসম্পদ পাঠাতে পারলে রেমিট্যান্স ভবিষ্যতে রেকর্ড গড়বে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় এক কোটি বাংলাদেশি রয়েছে, যাদের ৮৮ শতাংশই কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ ছাড়া দেশত্যাগ করেছে। অর্থাৎ প্রায় ৭৬ লাখ প্রবাসীর কাজের প্রশিক্ষণ নেই। আর বাকি ১২ শতাংশ প্রবাসী কারিগরি শিক্ষা, ভাষা, কম্পিউটার ও ড্রাইভিং- এ চারটির কোনো একটির ওপর প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশ ছেড়েছে। প্রবাসীদের মধ্যে চিকিৎসক, প্রকৌশলী, শিক্ষক এবং বৃত্তিমূলক শিক্ষায় ডিগ্রিধারীর সংখ্যা খুবই কম। বেশিরভাগ প্রবাসীর শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসির নিচে। ৬২ শতাংশের শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রথম থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত। ১৬ শতাংশের উচ্চশিক্ষা রয়েছে। দক্ষ ও শিক্ষিতের সংখ্যা কম হওয়ায় বিদেশে বাংলাদেশিরা ভালো চাকরি পান না। বিদেশে গিয়ে অদক্ষ, আধা দক্ষ শ্রমিক হিসেবে কম বেতনে যেন চাকরি করতে না হয়, প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে যাওয়া দক্ষ-অভিজ্ঞ শ্রমিকদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তুলনামূলকভাবে বেশি বেতনের চাকরি যাতে পেতে পারেন- তেমন যোগ্যতা নিয়ে বিদেশে যেতে হবে। দক্ষ জনশক্তি প্রেরণের মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানো সম্ভব। এ লক্ষ্যে সরকার এখন অনেকটাই মনোযোগী হয়েছে। বিদেশ গমনেচ্ছু শ্রমিকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে দক্ষ, যোগ্য ও অভিজ্ঞ করে তোলার লক্ষ্যে এখন বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। বিদেশগামীদের দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে রেমিট্যান্সের ওপর ইতিবাচক প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে হলে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনশক্তি পাঠানোর ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। তাহলেই ভবিষ্যতে রেমিট্যান্স বাড়বে বলে আশা করা যায়। রেজাউল করিম খোকন : সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App