×

মুক্তচিন্তা

মিলনের রক্তে বিভেদের ধারা!

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ৩০ নভেম্বর ২০২১, ০১:১৮ এএম

মিলনের রক্তে বিভেদের ধারা!

মিলন জাসদ-ছাত্রলীগের একজন সাব্যস্তের নেতৃস্থানীয় সংগঠক ছিলেন। মেডিকেলের ছাত্র। আমি বুয়েট প্রান্তে। বয়সের হেরফের। একটা সময় ছিল সত্তরের দশকে যখন জাসদ-সিপিবি তথা জাসদ-ছাত্রলীগ এবং ছাত্র ইউনিয়ন স্বাধীন দেশে হাড্ডাহাড্ডি তাত্ত্বিক এবং সামাজিক বিরোধের তপ্ত বারুদে মুখোমুখি ছিল। পর বঙ্গবন্ধু হত্যা, জিয়া পর্বের পর এরশাদ শাহীর আমলে একদা দোর্দণ্ড প্রতাপ দুটি সংগঠন একসঙ্গে হতে বাধ্য হলো সামরিক শাহীকে হটাতে। ড. কামাল হোসেন ১৯৯০ সালের শুরুতে একান্তে টেবিল চাপড় দিয়ে বলছিলেন, এ বছরেই হটতে হবে এরশাদকে। এরশাদকে হটতেই হলো। লীগ-দল-ইউনিয়ন সবাই অদম্য উত্তাপে। এরশাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক পরিবেশ প্রতিকূল করে তোলার কাজে যে কামাল সাহেব করিৎকর্মা ভূমিকা পালন করেছিলেন তাতে সন্দেহ বা ভুল নেই। ডা. জাফরুল্লা তখন এরশাদ রক্ষায় মশগুল। এদিকে এরশাদ যায় যায়, তবু যায় না। কী করা যায়! ষড়যন্ত্র-তত্ত্বের উপাসক একদল বলল, তখন এরশাদবিরোধী সেনা নেতৃত্ব একালের মান্না-স্টাইলে একটা লাশ চাইছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাহলে রাজপথ উত্তাপে ফেটে যাবে। সেই ফাটলে পপাত ধরণীতল হবে এরশাদ সরকার। তখন গোপনে শোর উঠল : লাশ চাই, লাশ চাই, যে করেই হোক ২৭ নভেম্বর ১৯৯০ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সুপরিচিত শিক্ষক কিংবা ছাত্রের লাশ চাই। তাহলে গুলির দায়িত্ব নেবে কে বা কারা? এতটুকু বলার পর আর বলব না প্রমাণের অভাবে। সেদিন বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এই দায়িত্ব নেয়ার গোষ্ঠীর একজন সে সময়ের যুব সংগ্রাম পরিষদের সভায় বিষয়টি স্বল্প স্বরে বলছিল! ঢাকা মেডিকেল থেকে মোস্তফা জালাল এবং মিলন একই রিকশায় আসছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে। সেই লাশ ফেলবার গুলি ছুটল। অল্পের জন্য টার্গেট মোস্তফা জালাল মিস হয়ে গেল। মিলন সুপরিচিত কম ছিল। ঘাতক বুলেটের রক্তে সমগ্র বাংলাদেশে স্রোতের গর্জন উঠল। মনে পড়ে প্রমিথিউসের গান : ‘ওগো মা তুমি কেঁদো না/মিলনের রক্তে আমি হটিয়েছি স্বৈরাচারী/উড়িয়েছি স্বাধীনতার পতাকা!’ মিলন যেন জাতীয় মিলনধারার মুখ হয়ে উঠল। আর সেই স্রোতেই অবশেষে এরশাদ-মওদুদের ক্ষমতার চেয়ারের ঠ্যাং ভেঙে ভেসে গেল। এলো তত্ত্বাবধায়ক শাহাবুদ্দিন পর্ব। সংগ্রামী তরুণরা সব আত্মহারা। এরশাদ কারাগারে। হাসিনা-খালেদা নির্বাচনী প্রতিদ্ব›িদ্বতায়। কারাগারে থেকেও এরশাদ পেল আঞ্চলিক ৩৫ আসন। ক্ষমতায় খালেদা সব অনুমান চূর্ণ করে। রাজনীতির জটিল পর্বে ৪৪ বছর বয়সি হাসিনা। যে কামাল দিল্লি থেকে হাসিনাকে নিয়ে এলো আওয়ামী লীগকে চাঙ্গা করতে সেই হাসিনা-কামাল রাজনীতির ঘোর দ্ব›েদ্ব যে জড়িয়ে গেল, সেই জট ক্রমশ জটিলতর হতেই থাকল। আমরা ২০২১ সালে এসে বলতে পারি ‘আন্তর্জাতিক’ ব্যক্তিত্ব জাতীয় রাজনীতিতে লাড্ডু মেরেছেন। বিদেশি ভরসায় স্বদেশি ক্ষমতায় বসা যায় না, স্বদেশি ভিত্তি না থাকলে। জাসদীয় গোঁয়ারতুমি কিংবা উগ্রতার আদল মিলনের ছিল না। তার নিবেদন এবং আন্তরিকতার গভীরতা প্রশ্নবিহীন। আজ মিলন বুঝি হারিয়ে গেছে। রক্ত তার শুকিয়ে কালো হয়ে গেছে। সেই রক্তের ওপর দিয়ে হেঁটে যায় বর্তমান মহান বিপ্লবীরা, বিতর্কিত নির্বাচনে যায়, মন্ত্রিত্বের গদিতে বসে, ইত্যাদি ইত্যাদি। মিলন তুমি দেখছ কী? কথা ছিল স্বৈরাচারী ব্যবস্থা দেশে থাকবে না। প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্র গভীর হবে। হলো না। কেন হলো না? দৃশ্যত অনেক কথাই বলা যায়। মার্কি-পাকি-সেনাদুর্গ বাংলাদেশের মূল মহানায়ককে নৃশংসতার সঙ্গে বধ করে বাংলাদেশের ভেতরে পাকিস্তানি সুধারস ঢুকিয়ে দিল। ২১টি বছর মহানায়ককে বিদ্রƒপ-অপমান আর বিস্মৃত করে দেয়ার পরিকল্পিত জঘন্যতা চলল সেনাদুর্গের গভীর হতে। বঙ্গবন্ধুর মাঠ-হত্যাকারীদের পুরস্কৃত করল দুই জেনারেল। স্বাধীনতার বর্বর দুশমন আলবদর গোষ্ঠীকে পাশকোলে নিয়ে ক্ষমতায় মসনদের ভাগ দেয়া হলো। এখনো চলছে একাত্তর। দুভাগে দেশ। পাকিস্তানপন্থিরা ক্ষমতায় এলে আরো অনেক একুশে আগস্ট ঘটাবে। এই আশঙ্কায় বর্তমান ক্ষমতাসীনরা শক্ত অবস্থান নিয়েছে। যুদ্ধ চলছে। গড়ে উঠছে না গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠান। মিলন, হয়তো ভেবেছিলেন এরশাদ উৎখাত হলেই থেমে যাবে উৎপাত। গণতন্ত্রের ভিত্তি হবে পোক্ত। না, তা হবে না। একাত্তরের ফয়সালা না হলে দেশে স্থিতিশীলতা আসবেই না। এই অস্থিতিশীলতায় একাত্তরপন্থিদের নাম দিয়ে গাজীপুরের ‘দুনিয়ার বাদশা’ কতখানে যে কীভাবে ঢুকে পড়েছে। সব মিলিয়ে সুশাসন দিন দিন চলে যাচ্ছে দূরে আরো দূরে। মিলন, তোমার রক্তদান কি বৃথা হয়ে গেল? না। বৃথা হতেই পারে না। দেশে কংক্রিট আর ইস্পাতের বিশাল কর্মযজ্ঞ। বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশ। উন্নয়নে চমকে যাচ্ছে পৃথিবী, ১৮ কোটি লোকের দেশে আর যাই হোক হা অন্ন হা অন্ন রব নেই। তবে মানুষ মানুষের মতো বাঁচতে চায়। দেশজুড়ে প্রযুক্তি বিছানো। মোবাইলে, টকশোতে সবরকম মতামত কোনো না কোনোভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। তবুও বলব এই কংক্রিটে, এই ইস্পাতে চাই সুরভিত কুসুম, মানবিকতার বিস্তার। মিলন, তোমার রক্তে সেদিন হবে মানচিত্র ধন্য। বিভেদের কৃষ্ণধারা মুছে যাবে তখন দেশ জমিন থেকে। মিলন, শহীদ মিলন, বিপ্লবী মিলন, তোমাকে সালাম।

হিলাল ফয়েজী : মুক্তিযোদ্ধা ও রম্যলেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App