×

জাতীয়

বিদ্রোহের ভারেই নৌকাডুবি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩০ নভেম্বর ২০২১, ০৮:৩৯ এএম

  • যোগ্য প্রার্থীর ছড়াছড়ি মন্ত্রী-এমপি বলয়
  • বিএনপির কৌশল
  • তৃণমূল থেকে নাম পাঠাতে আর্থিক লেনদেন

কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার কৈয়ারবিল ইউনিয়নে নৌকা প্রতীকের চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী, উপজেলা আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক জান্নাতুল বাকেয়া রেখার সর্বমোট প্রাপ্ত ভোট ৯৯। চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার বেলগাছিতে নৌকাপ্রার্থী সমীর কুমার দে পেয়েছেন ১০২ ভোট। পিরোজপুরের কাউখালী উপজেলার সয়না রঘুনাথপুর ইউনিয়নে নৌকাপ্রার্থী এইচ এম আর কে খোকন পেয়েছেন ১২০ ভোট। তৃতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে গত রবিবার এক হাজার ইউপিতে ভোটের ফলাফলে ভরাডুবি হয়েছে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের। আপাতত কোন কোন ভুলে ডুবল নৌকা, তার কারণ অনুসন্ধান করছে দলটি। কারণগুলো চিহ্নিত করে পরের ধাপে প্রতিকারের ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেছেন দলের শীর্ষ নেতারা। সেই সঙ্গে তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল মিটিয়ে আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগেই দলের সাংগঠনিক শক্তিকে আরো ঐক্যবদ্ধ ও গতিশীল করার কথা জানিয়েছেন তারা।

তৃতীয় ধাপে চেয়ারম্যান পদে বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের ১০০ প্রার্থী। গত রবিবার অনুষ্ঠিত হয়েছে ৯০০ ইউপির ভোট। এর মধ্যে ৭৮৭ ইউপির তথ্যে জানা গেছে নৌকা প্রতীক নিয়ে বিজয়ী হয়েছেন ১৯১ জন। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী জয় পেয়েছেন ১৭৭টিতে ইউপিতে। স্বতন্ত্র, স্বতন্ত্র পরিচয়ে বিএনপি প্রার্থী, জাতীয় পার্টি, জাসদ, সিপিবিসহ অন্যান্য মিলে জয়ী হয়েছেন বাকি ৪১৯ জন। নির্বাচনী সংঘাতে সারা দেশে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ১০ জন। এর আগে দ্বিতীয় ধাপে নৌকা প্রতীক হেরেছে ৪২ শতাংশ ইউপিতে। প্রথম ধাপে হেরেছে ২৬ শতাংশ ইউপিতে। নির্বাচনে অনুকূল পরিস্থিতিতেও ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা হেরে যাচ্ছেন। এ ব্যাপারে টনক নড়েছে ক্ষমতাসীনদের। এক্ষেত্রে একাধিক দক্ষ প্রার্থীর মধ্যে সঠিক প্রার্থী বাছাই করে মনোনয়ন দেয়া, দলীয় প্রার্থীর জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে সবাইকে মাঠে কাজ করা ও অভ্যন্তরীণ কোন্দল মেটানোর ওপর জোর দিয়েছেন তারা।

জানতে চাইলে দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কর্নেল (অব.) ফারুক খান ভোরের কাগজকে বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। ফলে দলের পক্ষে অনেকেই মনোনয়ন চাইবেন, এটি স্বাভাবিক। প্রতিটি ইউনিয়নেই ৫ থেকে ১০ জন মনোনয়ন চান। অধিকাংশই খুব দক্ষ এবং যোগ্য। মনোনয়ন পান একজন। তখন কেউ কেউ অতি আবেগী হয়ে ভুল করে বিদ্রোহী হন। অন্যদিকে কোথাও কোথাও বিএনপি-জামায়াত কাঁধে সওয়ার হয়ে তাদের বিদ্রোহী করে তোলে। এছাড়া দলের অভ্যন্তরীণ গ্রুপিংয়ের কারণেও কেউ কেউ বিদ্রোহী হন। তখন দলীয় প্রার্থীর ভোটগুলো বিভক্ত হয়ে যায়।

সারা দেশে নৌকার ভরাডুবি: কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার ১০ ইউনিয়নের মধ্যে ৫টিতে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর বিজয় হলেও বাকি ৫টিতে ভরাডুবি হয়েছে। ফরিদপুরের ভাঙ্গা ও চরভদ্রাসন উপজেলার ১৫টি ইউনিয়নের মধ্যে ১৪টিতেই স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয়লাভ করেছেন। ১টিতে বিজয়ী হয়েছে নৌকা। মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলা ও টঙ্গীবাড়ী উপজেলার মোট ২১ ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রাথী বিজয়ী হয়েছে ১০টিতে এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী জয় পেয়েছেন ১১ ইউপিতে। কুমিল্লার দাউদকান্দি, বরুড়া ও হোমনার ৩০টি ইউনিয়নে ১৫টিতে নৌকার প্রার্থী বিজয়ী এবং ১১টিতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। এছাড়াও ৩টিতে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী জয়ী হয়েছেন এবং একটির ফলাফল স্থগিত রয়েছে। নেত্রকোনার তিন উপজেলার ২৫টি ইউনিয়নে ৮টিতে নৌকা ও ১৬টিতেই স্বতন্ত্র জিতেছে। নড়াইলের কালিয়া উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের ১০টিতে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয়লাভ করেছেন, বাকি দুটিতে জয় পেয়েছেন নৌকার প্রার্থীরা। যশোরের শার্শা উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের মধ্যে ৫টিতে নৌকার ভরাডুবি হয়েছে। ৫টিতে জয় পেয়েছেন বিদ্রোহী প্রার্থীরা। সুনামগঞ্জ সদর ও দক্ষিণ উপজেলার ১৭ ইউনিয়নে আ.লীগ কেবল দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপেজলার দুই ইউনিয়নে জয় পেয়েছে। ৫টি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ বিদ্রোহী, ২টিতে জাতীয় পার্টি, ১টিতে জমিয়ত ও ৯টিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল পৌরসভায় টানা চতুর্থবারের মতো মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী মহসিন মিয়া মধু। নওগাঁর মান্দায় ১৪টি ইউপির তিনটিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও ১১টিতে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী চারজন। একটি ইউপিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে।

যে কারণে নৌকার ভরাডুবি: নির্বাচনে বিদ্রোহীদেরকেই গলার কাঁটা হিসেবে দেখছে আওয়ামী লীগ। সংশ্লিষ্টদের মতে, নির্বাচনে বেশ কিছু ইউনিয়নে একেবারে অপরিচিত ও অযোগ্যদের দলীয় প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেয়ায় এবং বিদ্রোহী প্রার্থী থাকায় নৌকার ভরাডুবি হয়েছে। তৃণমূলে অনৈতিক বাণিজ্যের কারণে এমন প্রার্থীরা দলীয় মনোনয়ন পান। এ ব্যাপারে দলের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন ভোরের কাগজকে বলেন, নিঃসন্দেহে বিদ্রোহী প্রার্থী দলের জন্য সুখকর নয়। তৃণমূলে বিদ্রোহী প্রার্থীর কারণে দলের ত্যাগী মানুষদের মধ্যে বিভাজন বাড়ছে। যার নেতিবাচক প্রভাব আগামী জাতীয় নির্বাচনে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। আমাদের কিছু স্থানীয় নেতা বিএনপির পাতা ফাঁদে পা দিয়ে স্থানীয় প্রভাব বলয় সৃষ্টির জন্য বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে সর্বনাশ ডেকে আনছে। অন্যদিকে নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার অপসংস্কৃতি রোধ করতে গিয়ে আমরা বিদ্রোহীদের প্রার্থী প্রত্যাহারের জন্য চাপ দিতে পারছি না। নানা কারণে বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রণে আমাদের সফলতা কম।

এদিকে স্থানীয় পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, তৃণমূলের গ্রুপিং নৌকার পরাজয়ের অন্যতম কারণ। রয়েছে মন্ত্রী-এমপি বলয়, স্থানীয় পর্যায়ে টাকার ছড়াছড়ি। জানতে চাইলে সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার এনামুল কবির ইমন ভোরের কাগজকে বলেন, কোথাও কোথাও তৃণমূল থেকে পাঠানো নামের বাইরেও কেন্দ্র থেকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। সুনামগঞ্জ সদরে তিনজনের নাম আমরা দেইনি, কেন্দ্র থেকে এসেছে। তারা কেউ বিজয়ী হননি। এছাড়া সুনামগঞ্জে লাঙ্গলের দুজন পাস করেছে, যাদের টাকার ছড়াছড়ি ছিল। এদের একজন করোনার সময় চাল চুরির অভিযোগে ধরাও পড়েছিলেন। অন্যদিকে গতবারের বিদ্রোহীরা এবারো বিদ্রোহী হয়েছেন। এরপরও প্রতিযোগিতাপূর্ণ নির্বাচন হয়েছে। একজন ৩৫ ভোটে ও একজন ১৮০ ভোটে হেরেছেন। তিনি বলেন, তৃণমূলে কিছুটা স্থবিরতা রয়েছে। নেতৃত্বস্থানীয়রা অনেকেই মাঠে নামেননি। আগামীতে আমাদের এসব সমস্যা কাটিয়ে ওঠতে হবে।

এ ব্যাপারে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নিজ দলের বিদ্রাহীদের কাছেই আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের হেরে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। অনেক ইউপিতে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা জয়ী প্রার্থীদের নিকটতম প্রতিদ্ব›দ্বীও ছিলেন না। তবে এসব রোগ নয়, রোগের লক্ষণ। রোগ হচ্ছে ফায়দাভিত্তিক রাজনীতি। এই রাজনীতিতে দলীয় পদ-পদবি, স্থানীয় সরকারের পদ- এসব অত্যন্ত লোভনীয়। পদ পেলে অনেক ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়। ফলে যে কোনোভাবে পদ-পদবি পেতে অনেকে মরিয়া হয়ে ওঠেন। রাজনীতিতে অন্যায় সুবিধা পাওয়ার সুযোগ বন্ধ না হলে ফায়দাতন্ত্রের অবসান না হলে নির্বাচনে এই সহিংসতা, প্রতিপক্ষকে মাঠছাড়া করা, বিনা ভোটে নির্বাচিত হওয়া, মনোনয়ন বাণিজ্য- এসব চলতেই থাকবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App