×

মুক্তচিন্তা

প্রকৃতির অলঙ্কার পরিযায়ী পাখি

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ৩০ নভেম্বর ২০২১, ০১:১৭ এএম

শীত আর পরিযায়ী বা অতিথি পাখি যেন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই শীতের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে আনাগোনা শুরু হয়েছে অতিথি পাখিদের। মূলত শীতের সময় অতিথি পাখির আগমন প্রকৃতির একটি স্বাভাবিক নিয়ম। শীতকালীন ঋতুতে সাইবেরিয়া অঞ্চলসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের অধিকাংশ অঞ্চল বরফে ঢাকা থাকে। তাই সেসব অঞ্চলের পাখিগুলো অপেক্ষাকৃত উষ্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে খাদ্যের সন্ধানে। একই কারণে আমাদের দেশেও শীত মৌসুমে প্রতি বছর রং-বেরঙের অতিথি পাখির আগমন ঘটে। পাখি বিজ্ঞানীদের মতে, পৃথিবীতে ১০ হাজারেরও বেশি প্রজাতির পাখি রয়েছে। তার মধ্যে কিছুটা উষ্ণতা পাওয়ার আশায় হাজার হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে ২ হাজার ১০০ প্রজাতির মতো পাখি বিভিন্ন দেশে চলে আসে। তার ধারাবাহিকতায় ৩০০ প্রজাতিরও বেশি পাখির আগমন ঘটে আমাদের দেশেও। আবার শীত শেষে এ অতিথি পাখিগুলো নিজ দেশে চলে যায়। এ ৩০০ প্রজাতির মধ্যে রয়েছে শামুককৌড়, বুনোহাঁস, ছোট সারস, বড় সারস, চামুচমুখ, ধূসর, গোলাপি রাজহাঁস, বালিহাঁস, পেরিহাঁস, বিদেশি পানকৌড়ি, গাঙচিল, টিয়া, শালিক, কবুতর, থাম পাইজ, জলপিপি, পাতিবাটান, পাতিকুট, গিরিয়া, পাতারি, লেঞ্জা, চিতি, সরালি, বিলুপ্তপ্রায় উদয়ী গয়ার, প্যালাস ফিস ঈগল বা বুলুয়া, লালবুবাসহ বিভিন্ন রং-বেরঙের অতিথি পাখি। যেসব অঞ্চলে হাওর-বাঁওড়, বিল-ঝিল, বড় পুকুর-বড় জলাশয়-দীঘি, সমুদ্রসৈকত থাকে, সেসব অঞ্চল অতিথি পাখিগুলো তাদের অস্থায়ী আবাস্থল হিসেবে বেছে নেয়। এর মধ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, সোনাদিয়া, মহেশখালী দ্বীপ, টাঙ্গুয়ার হাওর, হাকালুকি হাওর, হাইল হাওর, আশুড়ার বিল, বাইক্যা বিল, নিঝুম দ্বীপ, ঢাকার আশপাশের জলাশয়, দেশের বিভিন্ন চর-দ্বীপাঞ্চলসহ ২০০৪ সালে ঘোষিত এক বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে পচামাড়িয়ার অভয়াশ্রম অন্যতম। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, প্রচণ্ড শীত থেকে বাঁচার জন্য যেসব রং-বেরঙের পরিযায়ী পাখি বরফাচ্ছাদিত হিমালয় থেকে হাজার হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আমাদের দেশে চলে আসে, সেসব পাখি আমাদের প্রশাসনযন্ত্রের অবহেলার কারণে পাখি শিকারিদের শ্যেনদৃষ্টি এড়াতে পারে না। দেশে অতিথি পাখিগুলোকে নিরাপত্তা দেয়ার আইন থাকলেও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার এ ব্যাপারে গা-ছাড়া ভাব লক্ষ করা যায়। ফলে সুযোগ পেয়ে পাখি শিকারিরা এয়ারগান দিয়ে, বিষ প্রয়োগ করে, জাল পেতে প্রতি বছর বিস্তর পাখি বধ করে। ‘বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন-২০১২’ মতে, অতিথি পাখি হত্যা সম্পূর্ণ দণ্ডনীয় অপরাধ। যে কাউকে এ অপরাধের শাস্তিস্বরূপ ১ বছরের কারাদণ্ড বা ১ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে। একইভাবে কোনো ব্যক্তি যদি পরিযায়ী পাখির মাংস, দেহের অংশবিশেষ সংগ্রহ করেন বা দখলে রাখেন অথবা আটক করে ক্রয়-বিক্রয় করেন সেক্ষেত্রে তার ৬ মাসের কারাদণ্ড বা ৩০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এছাড়া পাখি লালন-পালন, কেনাবেচা, আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে লাইসেন্স নিতে হবে। তা না হলে ১ বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এমন একটি আইন থাকা সত্ত্বেও পরিযায়ী পাখি হত্যা বা আটক বন্ধ হচ্ছে না, কারণ এ আইন সম্পর্কে জনগণ সচেতন নয় এবং জনগণকে সচেতন করা এবং আইনটি যথাযথ প্রয়োগে সরকারি-বেসরকারিভাবে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে কিনা জানা নেই। প্রশাসনের ব্যর্থতার কারণেই পাখি শিকারিরা প্রকাশ্যে প্রশাসনের নাকের ডগায় জনবহুল বাজারে বসে হত্যা বা আটক করা পাখি ক্রয়-বিক্রয় করছে। আর বাবু-সাহেবেরা তাদের পরিবারের রসনা তৃপ্তির জন্য কিনে নিয়ে যান সেসব পাখি। নির্বিচারে পাখি হত্যার ফলে অতিথি পাখিগুলোর নিরাপদ আশ্রয়স্থল ও পরিবেশ দিন দিন অনিরাপদ হয়ে উঠছে। ফলে বাংলাদেশে অতিথি পাখি আসা কয়েক বছর ধরে হ্রাস পাচ্ছে এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। পাখি হলো প্রকৃতির অলংকার ও আমাদের বন্ধু। এছাড়া কিছু পাখি আছে রাস্তাঘাটে পড়ে থাকা দুর্গন্ধময় আবর্জনা খেয়ে পরিবেশকে বায়ুদূষণ থেকে রক্ষা করে। অনেক পাখি ক্ষেত-খামারের পোকা-মাকড় খেয়ে ভালো ফসল উৎপাদনে কৃষকদের সহায়তা করে। পরিশেষে বলব, প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও নিজেদের স্বার্থে অতিথি বা পরিযায়ী পাখি নিধনের মতো অমানবিক কাজ পরিহার করে মানবিক হওয়া প্রয়োজন এবং পাখিদের জন্য প্রাকৃতিক অভয়ারণ্য সৃষ্টি করা খুবই জরুরি। অন্যথায় পৃথিবীতে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া অন্যান্য প্রাণীর মতো পক্ষীকুলও একদিন বিলুপ্তির পথে চলে যাবে।

গোপাল নাথ বাবুল : দোহাজারী, চট্টগ্রাম। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App