×

মুক্তচিন্তা

খালেদা জিয়া : শেষ পর্যন্ত কি অপরাজনীতির শিকার হবেন?

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ৩০ নভেম্বর ২০২১, ০১:১৯ এএম

খালেদা জিয়া : শেষ পর্যন্ত কি অপরাজনীতির শিকার হবেন?

বাংলাদেশে এখন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সবচেয়ে আলোচিত খবর হচ্ছে এভারকেয়ার হাসপাতালে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসা নেয়ার দাবিকে কেন্দ্র করে বিএনপির বিভিন্ন নেতার নানা ধরনের বক্তব্য, নানা গুজব ছড়ানো, সরকারের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ, ক্ষমতাচ্যুত করার হুমকি এবং আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আইনি উপায়ে সমস্যার সমাধানে বিএনপির প্রতি আহ্বান জানানো। প্রতিদিনই বিএনপি নেতাদের পক্ষ থেকে যেসব বক্তব্য দেয়া হচ্ছে তা রাজনৈতিক ভাষায় উচ্চারিত দলীয় বক্তব্যের বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার সঠিক ধারণা একমাত্র বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরাই দিতে পারেন। কিন্তু সে কাজটি তারা করছেন না। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে মেডিকেল টিম কেন বেগম জিয়ার স্বাস্থ্যের সর্বশেষ পরিস্থিতি দেশবাসীকে জানাতে গণমাধ্যমের সম্মুখে হাজির হয় না? এ নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে যে তথ্য পাওয়া গেছে তাতে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এবং খালেদা জিয়ার জ্যেষ্ঠ পুত্র লন্ডনে অবস্থানকারী তারেক রহমানের কঠোর নির্দেশনা রয়েছে বলে নিশ্চিত করে বলা হয়েছে। শুধু তাই নয়, তারেক রহমান দলের নেতাকর্মীদেরও এভারকেয়ার হাসপাতালের আশপাশে না ভেড়ার নির্দেশ দিয়েছেন বলেও পত্রপত্রিকায় সংবাদ ছাপা হয়েছে। সে কারণে বিএনপির মহাসচিব ছাড়া আর কোনো সিনিয়র নেতা বিএনপির চেয়ারপারসনের খোঁজখবর নিতে এভারকেয়ার হাসপাতালে যেতে পারছেন না। তার শারীরিক অবস্থা সম্পর্কেও সর্বশেষ ডাক্তারি তথ্য গণমাধ্যমে দিতে পারছেন না। এ নিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। তাদের প্রতি নির্দেশ রয়েছে দেশে খালেদা জিয়ার ইস্যুতে সরকারের বিরুদ্ধে জনমত ও আন্দোলন সৃষ্টির মাধ্যমে সরকার পতনের পরিস্থিতি তৈরি করা। অথচ খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে বাধা নেই জনসমর্থনহীন অপরিচিত বা কম পরিচিত রাজনৈতিক দলের নেতাদের। এমনকি গণঅধিকার পরিষদ, নাগরিক ঐক্য এবং গণসংহতি আন্দোলনের জুনায়েদ সাকিরও। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী সাক্ষাৎ করে গণমাধ্যমে বক্তব্য দিয়েছেন। অথচ বিএনপির সিনিয়র নেতারা তাদের দলীয় প্রধানকে দেখতে কিংবা খবরাখবর জানতে এভারকেয়ার হাসপাতালের ধারেকাছে ভিড়তে পারছেন না। তারা জাতীয় প্রেস ক্লাব, রিপোর্টার্স ইউনিটি কিংবা কোনো নামসর্বস্ব দলের অনুষ্ঠানে যার যার অবস্থান থেকে বক্তব্য প্রদান করছেন। কয়েকটি বিষয়ে বিএনপি নেতাদের বক্তব্য ঘুরপাক খাচ্ছে। সর্বশেষ মির্জা ফখরুল ইসলাম দুই-তিনটি বক্তব্য খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য সম্পর্কে দিয়েছেন। যা নিয়ে দেশব্যাপী নানা প্রশ্নের জন্ম নিয়েছে। তিনি দাবি করেছেন যে সরকার খালেদা জিয়ার জেলে থাকা অবস্থায় সেøা পয়জনিং করেছে। সে কারণে তিনি ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে যাচ্ছেন। তার এই বক্তব্য গণমাধ্যমে উচ্চারিত হওয়ার পর সব মহলেই প্রশ্ন উঠেছে। খালেদা জিয়া ২০২০ সালের ২৫ মার্চ থেকে সরকারি আদেশে বাসায় অবস্থান করছেন। প্রায় ২১ মাস আগে থেকেই তিনি সরকারের তত্ত্বাবধান থেকে মুক্ত আছেন। সরকার যদি সেøা পয়জনিং করত তাহলে এর প্রতিক্রিয়া অনেক আগেই হয়তো দেখা যেত। মির্জা ফখরুলের এমন অভিযোগটি অত্যন্ত মারাত্মক। সরকারের বিরুদ্ধে তার কাছে এমন সুনির্দিষ্ট প্রমাণ থাকলে কেন সেটি দেশবাসীর সম্মুখে হাজির করানো হচ্ছে না? কেন আদালতে সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করা হচ্ছে না? গুরুতর এই অভিযোগটির সামান্যতম সত্যতা পাওয়া গেলে শুধু দেশের ভেতরেই নয়, বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতিম সব রাষ্ট্র থেকেই সরকারের বিরুদ্ধে বড় ধরনের সমালোচনার ঝড় তৈরি হতো, সরকার আন্তর্জাতিক মহলেই সমালোচিত হতো। সেক্ষেত্রে সরকারের পক্ষে ক্ষমতায় টিকে থাকা অনেকটাই অসম্ভব হয়ে পড়ত। কিন্তু মির্জা ফখরুলের এই অভিযোগের পর কোনো সরকার বা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা কোনো ধরনের বিবৃতি বা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে দেখা যায়নি। আবার এটিও প্রশ্ন উঠে যে এমন একটি অভিযোগ বিএনপির মহাসচিবের মুখ থকে উচ্চারিত হওয়ার পর তার দলের কোনো নেতাকর্মীও বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলছেন না কেন? তিনিই বা কেন আর এ নিয়ে গণমাধ্যমের সম্মুখে কথা বলছেন না? বিএনপির কোনো কোনো নেতা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন যে খালেদা জিয়ার মৃত্যু হলে শেখ হাসিনাকে এক নম্বর আসামি করা হবে। মির্জা ফখরুল সর্বশেষ যে তথ্যটি দিয়েছেন তা হচ্ছে তার পাকস্থলী থেকে যে রক্তক্ষরণ হচ্ছে সেটি নির্ধারণ করার মতো উন্নত প্রযুক্তি বাংলাদেশে নেই। তাই তাকে বিদেশে না পাঠানো হলে তার পাকস্থলীর ক্ষতস্থল নির্ধারণই করা যাবে না। এই বক্তব্যটি যদি মেডিকেল টিম গণমাধ্যমের সম্মুখে জাতিকে জানানোর জন্য প্রচার করত তাহলেও তথ্যটি জনমনে এবং সরকারের মধ্যে বিশেষভাবে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করার যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য বলে মনে হতো। কিন্তু বিএনপি সে পথে হাঁটছে না। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান শুধু লন্ডনে বসে যে নির্দেশনা প্রদান করবেন তার বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা বিএনপির কোনো নেতার নেই- এটি এখন শতভাগ নিশ্চিত। গত প্রায় ৩ বছর ধরে খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য নিয়ে বিএনপির বক্তব্য দেশবাসী শুনে আসছে। তিনি জেলে থাকা অবস্থায় বলা হয়েছিল যে তার শরীর এতটাই খারাপ যে তিনি দাঁড়াতে পারছেন না। তারা তার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানো এবং একটি বিশেষ বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করাতে দাবি করছিল। সরকার তার শারীরিক চিকিৎসার জন্য বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবস্থা করার উদ্যোগ নিলে বিএনপি সেটির বিরোধিতা করে। বিরোধিতার সেই সময়ে কয়েক মাস এ নিয়ে বিএনপি ও সরকার পক্ষের বাদানুবাদ দেশবাসী শুনেছে। সরকার বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করলে বিএনপি থেকে প্রতিদিনই সেই চিকিৎসার নানা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়েছে। মেডিকেল টিমে বিএনপিপন্থি ডাক্তার থাকার পরও টিমের বক্তব্য নিয়ে বিএনপি সন্দেহ প্রকাশ করত। গত ২১ মাস খালেদা জিয়া সরকারি নির্বাহী আদেশে বাসায় অবস্থান করছেন। অসুস্থতা বেড়ে গেলে এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে ভর্তি হচ্ছেন। এখানে বিএনপি পছন্দের ডাক্তারদের দিয়ে চিকিৎসা করাচ্ছেন। পছন্দের মেডিকেল বোর্ডও রয়েছে। এমনকি উন্নত দুনিয়ার ডাক্তারদের পরামর্শও নেয়া হচ্ছে। কিন্তু মেডিকেল টিম অথবা বিদেশি ডাক্তারদের পরামর্শের কোনো তথ্য গণমাধ্যম কিংবা সরকারের কাছে তাকে বিদেশে নেয়ার জন্য তথ্য প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করছে বলেও কখনো শোনা যায়নি। ফলে ক্রমাগত তাকে বিদেশে নেয়ার জন্য যে দাবিটি বিএনপি করে আসছে, সেটি নিয়ে সব মহলের মধ্যেই নানা ধোঁয়াশা বিরাজ করছে। তিনি যদি দেশের সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক কারাদণ্ডপ্রাপ্ত না হতেন, তাহলে তার বিদেশে চিকিৎসা নেয়া না নেয়ার ওপর সরকারের হস্তক্ষেপ করার কোনো অধিকারই থাকত না। সেটি সরকার করত বলে কারো কাছে মনেও হয় না। কিন্তু যেহেতু তিনি সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক কারাদণ্ডপ্রাপ্ত, তাই তার বিদেশ গমনাগমনের বিষয়ে আইনের বেশ কিছু নিষেধাজ্ঞা, বিধান রয়েছে এটি এখন দেশবাসী জানে। সরকারের কাছে বেগম জিয়ার কারাদণ্ড স্থগিতের আবেদনটি এ পর্যন্ত তার ভাই-বোনদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতেই সরকার করেছে এবং তিনবার বর্ধিতও করেছে। বিষয়টি নিয়ে বিএনপির এখন আদালতের কাছে কিংবা রাষ্ট্রপতির কাছে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। সেক্ষেত্রে বিএনপি মেডিকেল রিপোর্টসহ সর্বোচ্চ আদালতকে বিদেশে চিকিৎসা নেয়ার জন্য জামিনের আবেদন করতেই পারে। আদালত কী সিদ্ধান্ত দেবে না দেবে সেটি তো আমরা কেউ বলতে পারি না। তবে সর্বোচ্চ আদালত কাগজপত্র বিবেচনা করে চিকিৎসার বিষয়ে বিদেশে একান্ত প্রয়োজন থাকলে একেবারেই বিবেচনা করবে না এমনটি ধরে থাকার কোনো কারণ আছে বলে মনে হয় না। সর্বোচ্চ আদালত দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর জীবন রক্ষার বিষয়টি মানবিক দৃষ্টিতে দেখতে পারেন। সেখানে বিএনপি কেন যাচ্ছে না তা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমাভিক্ষার কথা যেভাবে উচ্চারিত হচ্ছে তার বাইরেও রাষ্ট্রপতি খালেদা জিয়ার বিদেশের সুনির্দিষ্ট হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার মাধ্যমে সুস্থ হওয়ার সুযোগ থাকলে একেবারেই তা অগ্রাহ্য করবেন এমনটিও ধরে রাখার কোনো কারণ থাকতে পারে না। বিএনপি যদি মনে করে যে তার দেশে চিকিৎসা নেয়ার আর কোনো ব্যবস্থা নেই তাহলে দেশি-বিদেশি চিকিৎসক ও হাসপাতালের সম্মতির সব কাগজপত্রসহ হয় উচ্চ আদালতে নতুবা রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করে দেখতেই পারে। খালেদা জিয়া কারাদণ্ডপ্রাপ্ত হলেও তিনি বা তার দল সঙ্গত কারণেই অপরাধ স্বীকার করতে যাবেন না। এটিও সবাই কমবেশি বুঝেন, সরকারও জানে না তা নয়। কিন্তু তার প্রাণরক্ষার বিষয়টি যখন একেবারেই সুনির্দিষ্ট ও সুনিশ্চিত হয়ে যায় তখনই কেবল রাষ্ট্রপতির মানবিক উদাহরণ সৃষ্টির বিষয়ে অবস্থান নিতে পারেন। কিন্তু বিএনপি সে ধরনের কোনো উদ্যোগও নিচ্ছে না। তাহলে দুর্বলতা কোথায়? তথ্য-উপাত্ত তো আগে থেকেই দেয়া হচ্ছে না। ফলে বেগম জিয়াকে বিদেশে নেয়ার জন্য যে চাপাচাপিটি বিএনপির পক্ষ থেকে করা হচ্ছে সেখানে সরকারের দিক থেকে বিএনপির প্রতি সন্দেহ করার নানা কারণ থাকাটা স্বাভাবিক। বিএনপি তো প্রথম থেকেই খালেদা জিয়ার অসুস্থতা নিয়ে নানা ধরনের কথা বলছে, তথ্য দিচ্ছে না। এটি দেশের সাধারণ মানুষও কমবেশি স্বীকার করে। সরকারের কাছে বেগম জিয়ার শারীরিক অবস্থা কিংবা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানসহ নেতাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে সঠিক তথ্য-উপাত্ত নেই কিংবা ঘাটতি আছে এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। সরকার খালেদা জিয়া ও বিএনপির সবকিছুই গভীর পর্যবেক্ষণে রেখে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে বা নেবে সেটি ধরেই নেয়া যায়। প্রতিদিন বেগম জিয়ার স্বাস্থ্য নিয়ে বিএনপি নেতারা এবং গণমাধ্যমে যা বলা হচ্ছে তার সঙ্গে বাস্তবতার মিল-অমিলগুলো নিশ্চয়ই সরকারের নানা মহল খতিয়ে দেখছে। তাছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার স্বাস্থ্য এবং মৃত্যু নিয়ে যেসব গুজব প্রায়ই ছড়ানো হচ্ছে তা শুধু আমরাই গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছি তা নয়। সরকারও হয়তো এসব নিয়ে নানা অবস্থান থেকে হিসাব-নিকাশ করছে। ভেতরের অনেক কিছুই যেহেতু আমরা জানি না তাই বেগম জিয়ার জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণের দাবিটি কি সত্য নাকি এখনো রহস্যাবৃত সেটি আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারছি না। বিএনপির নানা কথায় মনে হচ্ছে স্বচ্ছ রাজনীতি নয়, খালেদা জিয়া এই মুহূর্তে কারো না কারো অপরাজনীতির শিকার হচ্ছেন কিনা? এমনটি ঘটলে তা হবে খুবই নিষ্ঠুর এবং দুর্ভাগ্যজনক। আমরা চাই তার শারীরিক অবস্থার সঠিক তথ্য এবং সুচিকিৎসা। সেটি যদি দেশে একেবারেই সম্ভব না হয় তাহলে পৃথিবীর কোন প্রান্তে তাকে নেয়া সম্ভব, নিলে যথার্থ চিকিৎসা মিলবে সেটিই যেন করার তার সুযোগ ঘটে।

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App