×

আন্তর্জাতিক

সিডনি স্ট্রিটে স্বমহিমায় বঙ্গবন্ধু

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৯ নভেম্বর ২০২১, ০৮:৩০ এএম

সিডনি স্ট্রিটে স্বমহিমায় বঙ্গবন্ধু

সিডনি স্ট্রিটের লাল দেয়ালের বাড়িটির সামনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্যটি যেন লন্ডনের ধানমন্ডি-৩২ নম্বর প্রাঙ্গণ।

৫ নভেম্বর। স্থানীয় সময় ৪টা বেজে ৪০ মিনিট। তাপমাত্রা জানান দিচ্ছে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বাতাসে আর্দ্রতা ১১ দশমিক ৭। হুহু করে বাতাস বইছে। এখুনি ঝুপ করে অন্ধকার নামবে। রাস্তায় নিয়ন আলোগুলো একসঙ্গে জ¦লে ওঠার অপেক্ষায়। ভারী ওভারকোট, মাফলারে মাথা-কান ঢেকে, হাতে একটি করে লাল গোলাপ নিয়ে সিডনি স্ট্রিটের ই ওয়ান, টু ই এল বাড়িটির সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন দুই বাঙালি প্রৌঢ়- ডা. সুবল দে ও এনামুল হক। সবুজে ঘেরা লাল দেয়ালের বাড়িটি এখানকার অন্য বাড়িগুলো থেকে ভিন্ন রকমের। লাল গোলাপ, ক্যাকটাসসহ নানা রকম পাতাবাহারে ঘেরা ছোট্ট সাজানো বাগানের মাঝখানে সগৌরবে স্বমহিমায় হাস্যোজ্জ্বল ভঙিতে মাথা উঁচু করে রয়েছেন বাঙালির জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যেন বাংলা থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে ব্রিটিশ মুলুকে সদর্পে জানান দিচ্ছেন ১৮ কোটি বাঙালির প্রাণের অস্তিত্ব।

এখানে এই সিডনি স্ট্রিটের লাল দেয়ালের বাড়িটির সামনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্যটি যেন লন্ডনের ধানমন্ডি-৩২ নম্বর প্রাঙ্গণ। বাঙালির বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, পনেরো আগস্ট জাতীয় শোক দিবস, ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ও জাতীয় শিশু দিবস ছাড়াও প্রতিদিন বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য পরিদর্শনে আসেন অসংখ্য বঙ্গবন্ধু ভক্ত। জাতীয় দিবসে হাইকমিশনের পক্ষে ও দলের পক্ষে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। শনিবার ও রবিবার দর্শনার্থীর ভিড় বেশি থাকে। বিদেশি পর্যটকরা বেশি আসেন রবিবার। টুরিস্ট গাইড ব্লæবেইজ হেরিজেকসনে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ইংল্যান্ডের দর্শনীয় স্থান।

যেভাবে লন্ডনে ব্যক্তি উদ্যোগে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য : একটু ভালো করে বাঁচব বলে আর একটু বেশি রোজগারের আশায় কিংবা বহির্বিশ্বে বসতি গড়ার হাতছানিতে ১৯৯৩ সালে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার এম এ খান ইঞ্জিনিয়ারের ছেলে ছাত্রলীগ নেতা আফছার খান সাদেক। ২৪ বছরের তরুণ সাদেকের চোখেমুখে হাজারো স্বপ্ন। লন্ডনের রাস্তাঘাটে, পার্কে, পার্লামেন্ট স্কয়ারে বিশ্বের নানান গুণীজনের ভাস্কর্য তাকে মুগ্ধ করত। বিশ্বনেতাদের ভাস্কর্যের ভিড়ে তার দুচোখ খুঁজে বেড়াতো বঙ্গবন্ধুকে। কোথাও নেই বঙ্গবন্ধু। বিষয়টি তাকে হতাশ করে। একদিন তিনি যান বিশ্ববিখ্যাত জাদুঘর মাদাম তুসোতে।

বিশ্ববরেণ্য নেতানেত্রী, বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, আর্টিস্টের ভাস্কর্য শোভা পাচ্ছে কিন্তু বঙ্গবন্ধুর কোনো ভাস্কর্য কোথাও নেই। তিনি জাদুঘরের কার্যালয়ে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য আছে কিনা, জানতে চান। তারা নেই জানালে ভীষণ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয় সাদেকের মনে। তার ভাষায়, মাও সে তুং না হলে চীন হতো না, মহাত্মা গান্ধীর জন্ম না হলে ভারত হতো না, তেমনি বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে বাংলাদেশ হতো না। এটি ধ্রæব সত্য। আমরা গরিব দেশ। সেজন্য হয়তো আমাদের জাতির পিতাকে ইংল্যান্ড মূল্যায়ণ করেনি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তো সারা বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের জন্য যুদ্ধ করেছেন। এমনকি সদ্য বিজয়ী দেশের পিতাকে নিজে

গাড়ির দরজা খুলে ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে স্বাগত জানিয়েছিলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী। এটি বিশ্বে বিরল। তা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নেই। এরপর পণ করি যদি কোনো দিন স্বাবলম্বী হতে পারি, আমি জাতির পিতার ভাস্কর্য করব। সেই থেকে শুরু। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য ২০০৯ সালে স্থানীয় সরকারের কাছে প্লানিং পারমিশনের জন্য আবেদন করেন তিনি। কিন্তু কোনো উত্তর পাননি। ২০১৪ সালে আবারো আবেদন করেন। স্থানীয় সরকার সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের মতামত নিতে চিঠি পাঠায়। কারো কোনো আপত্তি না থাকায় তার আবেদন মঞ্জুর হয়। অনুমতি পাওয়ার পর তিনি বঙ্গবন্ধুর ছোট কন্যা শেখ রেহানার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। প্রধানমন্ত্রী তার অর্থের উৎসের স্বচ্ছতা জানতে চান। লন্ডন আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সম্পাদক সাদেক বঙ্গবন্ধু কন্যার কাছে তার আয়ের স্বচ্ছতা তুলে ধরেন। সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে শেখ হাসিনা ভাস্কর্য করার অনুমতি দেন। পরে তিনি ভারতে গিয়ে ভাস্করদের সঙ্গে কথা বলেন। মাটি থেকে ৯ ফুট উচ্চতার ভাস্কর্যটি তৈরি করতে পুরো দুবছর সময় লাগে। ভাস্কর্য লন্ডনে পৌঁছায় এয়ার কার্গোর মাধ্যমে ২০১৬ সালের জুন মাসে। ২০১৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর ভাস্কর্যটি উদ্বোধন করেন তৎকালীন রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত।

তবে এর তিন মাস পর অবৈধভাবে ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে এবং ভাস্কর্য বড় হয়ে গেছে অভিযোগে কাউন্সিল থেকে নোটিস আসে সাদেকের বিরুদ্ধে। ভাস্কর্য তুলে ফেলতে ১ মাস সময় দেয়া হয়। তিনি নোটিসটিকে অবৈধ দাবি করে এর বিপরীতে কাউন্সিলে আপিল করেন। একই বছরের ২৮ নভেম্বর কাউন্সিলের প্ল্যানিং ইন্সপেক্টর সরজমিন পরিদর্শন করে রিপোর্ট দেন। তদন্তে স্থাপিত ভাস্কর্যের সঙ্গে কাউন্সিল অনুমোদিত প্ল্যানিংয়ের কোনো অমিল খুঁজে না পাওয়ায় বঙ্গবন্ধু ভাস্কর্য আজীবন থাকার অনুমতি দেয়া হয়। সেই থেকে বাঙালির প্রাণের স্পন্দন হয়ে ওঠে সিডনি স্ট্রিটে আফছার খান সাদের বাড়িটি। ভবিষ্যতে বাড়িটি বঙ্গবন্ধু জাদুঘর করার ইচ্ছা রয়েছে তার। বললেন, আমার আর কোনো চাওয়া নেই। আমার দুই ছেলে জয় (১৭) ও বিজয় (১১) এবং দুই মেয়ে ঊষা (১৬) ও আশা (১৩) বঙ্গবন্ধুকে খুব ভালোবাসে। তারা আমার ইচ্ছায় কখনোই বাধা দেয়নি, দেবেও না। ভবিষ্যতে বঙ্গবন্ধু জাদুঘর করতে যা লাগে আমি সব করব।

প্রতিবেশী ব্যবসায়ী আফরোজ মিয়া বলেন, বর্তমানে এটি হেরিটেজ হয়ে গেছে। প্রতিদিন দর্শনার্থী দেখতে আসে। অন্তত একবার বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা পরিদর্শনে আসেন- এটি আমাদের ইচ্ছা।

গুণীজনের পদচারণায় মুখরিত বঙ্গবন্ধু ভাস্কর্য প্রাঙ্গণ : প্রতিষ্ঠার পর থেকেই গুণীজনদের পদচারণায় মুখরিত বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য প্রাঙ্গণ। অমর একুশে গানের রচয়িতা আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী, প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী, পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন, তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, বন ও পরিবেশ বিষয়কমন্ত্রী শাহাব উদ্দিন, হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, সংসদ সদস্য সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ, অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান, অধ্যাপক ও আবৃত্তিশিল্পী রূপা চক্রবর্তী, ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটনসহ অসংখ্য গুণীজন বঙ্গবন্ধর ভাস্কর্যটি দেখতে এসে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর পাশাপাশি দর্শনার্থী বইয়ে নিজের অনুভূতি তুলে ধরেছেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App