×

মুক্তচিন্তা

রাষ্ট্রধর্ম বিতর্ক

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৯ নভেম্বর ২০২১, ১২:৫৯ এএম

বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ গঠনের পেছনের কারণ ছিল এইচ এম এরশাদ কর্তৃক ১৯৮৮ সালে সংবিধানে ‘ইসলাম’কে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে অন্তর্ভুক্তির প্রতিবাদ। এই সংগঠনটি এখনো সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্মকে বাতিলের দাবিতে অনড় রয়েছে। পঞ্চম ও অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানকে যেভাবে ইসলামীকরণ করা হয়েছিল, উচ্চ আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বর্তমান সরকার ৭২-এর সংবিধানে পুরোপুরি না ফিরলেও কাছাকাছি পৌঁছতে পেরেছে। কী কারণে পঞ্চদশ সংশোধনীতে সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম রেখে দেয়া হলো তা অনেকের কাছে প্রশ্ন হয়ে থাকবে। ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্তির পর ‘স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটির’ পক্ষে সাবেক প্রধান বিচারপতি কামাল উদ্দিন হোসেন, বেগম সুফিয়া কামাল, খাঁন সরওয়ার মুর্শেদ, মেজর জেনারেল (অব.) চিত্ত রঞ্জন দত্ত বীর উত্তম, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ড. বোরহান উদ্দিন খাঁন জাহাঙ্গীর, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, বদরুদ্দিন উমর, অধ্যাপক কবির চৌধুরী, সাংবাদিক ফয়েজ আহম্মেদ, সৈয়দ ইশতিয়াক আহমদ, কলিম শরাফী, অধ্যাপক ড. মোশারফ হোসেন, বিচারপতি কে এম সোবহান, বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্যসহ ১৫ জন বিশিষ্ট নাগরিক সংবিধানে রাষ্ট্রধর্মের অন্তর্ভুক্তিকে চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে রিট করেছিলেন। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে আরপিওর অধীনে রাজনৈতিক দল হিসেবে বৈধতা দেয়াকে চ্যালেঞ্জ করা এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৩ সালের ১ আগস্ট জামায়াতে ইসলামীকে রাজনৈতিক দল হিসেবে অবৈধ ঘোষণার পাশাপাশি বিচারপতি এম মোয়াজ্জেম হুসাইন, বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম এবং বিচারপতি কাজী রেজা-উল-হকের সমন্বিত বেঞ্চ রায়ের পর্যবেক্ষণে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন, অষ্টম সংশোধনী হোক বা পঞ্চদশ সংশোধনী হোক সংবিধানে রাষ্ট্রধর্মের অন্তর্ভুক্তি সংবিধানের প্রস্তাবনার বিপরীত এবং সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এবং রাষ্ট্রধর্ম রাষ্ট্রের মূলনীতি আর্টিকেল ৮ ও ১২-এর পরস্পরবিরোধী। এর আগে ১৯৮৮ সালে ১৫ বিশিষ্ট নাগরিকের রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ১১ জুন ২০১১ তারিখে ১৯৮৮ সালে করা রিটের রুল জারি করা হয়। সরকারের পক্ষ থেকে রুলের জবাব না দিয়ে ২০১১ সালের ৩০ জুন পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করা হলো। বিচারপতি নাইমা হায়দার, বিচারপতি কাজী রেজা-উল-হক এবং বিচারপতি মোহাম্মদ আশরাফুল হকের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ দীর্ঘ ২৮ বছর পর ২০১৬ সালের ২৮ মার্চ পিটিশন দায়ের করা কমিটির রিট দায়েরের এখতিয়ার নেই বিধায় রিট পিটিশনটি খারিজ করে দেন। স্বাভাবিকভাবে ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে সংবিধানে থেকে গেল। সম্প্রতি সরকারের তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান বলেন, ‘ইসলাম আমাদের রাষ্ট্রীয় ধর্ম না। এটি বিশ্বাস করি না। বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র এবং বঙ্গবন্ধু প্রণীত ৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাবে।’ অন্য কেউ না বললেও জাতীয় সংসদে তিনি এ বিষয়টি উপস্থাপন করবেন। প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য বিভিন্ন মিডিয়ায় ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে ২০২১ সালের ১২ নভেম্বর। ‘ঘৃণ্য আইন ইনডেমনিটি’ শীর্ষক জাতীয় প্রেস ক্লাবের এক আলোচনা সভায় পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান এরশাদ সরকারের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করার পদক্ষেপকে বাঙালি জাতির মূল উদ্দেশ্যের পথে ‘কাঁটা’ বলে মন্তব্য করেছেন। ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করে সংবিধানের মূল বাণী অসাম্প্রদায়িকতায় ঘা দেয়া হয়েছে। মন্ত্রিসভার দুজন সদস্যের বক্তব্যে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা ৭২-এর সংবিধানে ফেরত যাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী হতে পারেন। অবশ্য জাতীয় পার্টির জি এম কাদের, বিএনপির রিজভী আহমেদসহ কয়েকটি ইসলামী দল তথ্য প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্যের বিরোধিতা করেছেন, যা তাদের জন্য স্বাভাবিক হিসেবে ধরে নেয়া যায়। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র সাঈদ খোকনও এদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করেছেন। ১৫ নভেম্বর জাতীয় সংসদের অধিবেশনে বিএনপি দলীয় এমপি ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা সংবিধানের ২(ক) ও ৮ ধারা উল্লেখ করে রাষ্ট্রধর্মের পক্ষে সাফাই গাইলেন। তবে তিনি পত্রিকান্তরে প্রকাশিত সংবাদের সূত্র ধরে দেশে ৭৫ লাখ হিন্দু কমে যাওয়া, বর্তমান সরকারের আমলে দেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলা, এবারের শারদীয় দুর্গাপূজায় সাম্প্রদায়িক হামলা এবং বিচার না হওয়ার বিষয়ে সরকারের সমালোচনা করে জোরালো বক্তব্য রেখেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ তার বক্তব্যের প্রশংসা করছেন। যারা প্রশংসা করছেন তারা হয়তো বর্তমান সরকারের আমলে সংগঠিত সাম্প্রদায়িক ঘটনাগুলোর বিষয়ে রুমিন ফারহানার বক্তব্যকে গুরুত্ব দিয়ে তার রাষ্ট্রধর্মের পক্ষে বক্তব্য রাখার বিষয়টি বিবেচনায় নেননি, যা বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ ধর্মভিত্তিক দলের রাজনৈতিক এজেন্ডা এবং যে দুই দল অসাম্প্রদায়িক সংবিধানকে ৫ম ও ৮ম সংশোধনীর মাধ্যমে সাম্প্রদায়িকীকরণ করেছে এবং তাদের সরকারের আমলে ১৯৯০-৯২ বা ২০০১-২০০৬ সালে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন, নিপীড়নের বিষয়টি হয়তো স্মৃতিতে নেই। রাজনৈতিক দল দুটির মধ্যে একটির প্রতিনিধিত্ব করেছেন রুমিন ফারহানা। তবে ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে যে জিয়াউর রহমান সংবিধানকে ইসলামীকরণের সূচনা করেছিলেন সেই নেতার হাতে গড়া বিএনপি ১৯৮৮ সালেই সংবিধানে রাষ্ট্রধর্মের অন্তর্ভুক্তির বিরোধিতা করেছিলেন। সেই সময়ে রাজপথে ‘যার ধর্ম তার কাছে, রাষ্ট্রের কি বলার আছে’ সেøাগানে প্রতিবাদ করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগ সংসদে রাষ্ট্রধর্মের বিরোধিতা করে বলেছিল, ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলেই এই সংশোধনী বাতিল করবে।’ বিএনপি নেত্রী বলেছিলেন, ‘সংবিধানের এই সংশোধনী জাতিকে বিভক্ত করবে, এই সংশোধনী গ্রহণযোগ্য নয়।’ জামায়াতে ইসলামী একে ‘ভণ্ডামী’ বলে বর্ণনা করেছিল। সব রাজনৈতিক দল এ বিষয়ে একমত ছিল যে এটি একটি রাজনৈতিক পদক্ষেপ। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ৭ দলীয় জোট এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ৮ দলীয় জোট এবং বাম রাজনীতির ৫ দলীয় জোট প্রতিবাদে আধাবেলা হরতালও আহ্বান করেছিল। সময়ের স্রোতে রাজনৈতিক দলগুলো অজ্ঞাত কারণে তাদের প্রতিবাদ ও প্রতিশ্রæতির জায়গায় থাকতে পারেনি। ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা জাতীয় সংসদে তার বক্তব্যে সংবিধানের ২(ক) উল্লেখ করে বলেছেন, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করিবেন।’ এতে হয়তো অনেকে মনে করেন ইসলামের পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সমমর্যাদায় রাখা হয়েছে। ‘তবে’ শব্দটি মাঝখানে অন্তর্ভুক্ত করাতে সব ধর্ম সমমর্যাদার জায়গায় থাকে কি? ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলো কি জাতীয় মর্যাদায় পালিত হয়? নিশ্চয়ই বিজ্ঞজনরা ভেবে দেখবেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘আমি মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখি। আমার কাছে মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান বলে কিছু নেই। সবাই মানুষ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা-১৯১)।’ ‘বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি বিশেষ কোনো ধর্মভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা (১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি)’। সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম রেখে আমরা কি বঙ্গবন্ধু থেকে দূরে সরে গেলাম? নাকি বঙ্গবন্ধুকে দূরে ঠেলে দিলাম?

মিলন কান্তি দত্ত : লেখক ও সমাজকর্মী।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App