×

মুক্তচিন্তা

জনস্বার্থে পরিবহন সমস্যার যুক্তিসঙ্গত সমাধান জরুরি

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৯ নভেম্বর ২০২১, ০১:০০ এএম

জনস্বার্থে পরিবহন সমস্যার যুক্তিসঙ্গত সমাধান জরুরি

পরিবহন খাতে ক’দিন ধরে চরম নৈরাজ্য চলছে। নিয়মকানুনের কোনো বালাই নেই। খুশিমতো বাস চলাচল (সাধারণ পরিবহন) বন্ধ, ভাড়া বাড়ানো, আবার চালু করা, আবার একবেলা বন্ধ- মানুষের চরম হয়রানি। রাস্তায় যাত্রীদের বেজায় ভিড়। অফিসফেরত মানুষ থেকে সাধারণ যাত্রী- সবার চরম ভোগান্তি। এর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ- নিম্নবিত্ত, বিত্তহীন থেকে মধ্যবিত্ত, বিশেষ করে আটপৌরে মধ্যবিত্ত ও চাকরিজীবী। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবহন ব্যবস্থা যদি বাস মালিকদের খেয়াল-খুশি ও মুনাফাবাজির শিকার হয় তাহলে তিনবার ভাবতে হয়, সমাজব্যবস্থাটা কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থবিত্তের দৌলতে ও দাপটে বাস মালিকরা এখানে সমাজে অন্যতম রাজার ভূমিকায়। তাদের দ্বিতীয় শক্তি পরিবহন শ্রমিক ও শ্রমিক ইউনিয়নের দুর্নীতিবাজ মালিকের সেবাদাস শ্রমিক নেতারা। ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন তার ঐতিহ্য ভুলেছে। ভুলেছে বাংলাদেশের একশ্রেণির শ্রমিক- যাদের আজ সর্ববার শ্রেণির বলতে লজ্জা হয়। মার্কস-এঙ্গেলস তাদের কবরে পাশ ফিরে শোবেন মেনিফেস্টোতে এমন কথা লেখার জন্য : ‘শৃঙ্খল ছাড়া তোমাদের পাবার কিছু নেই।’ বাংলাদেশের পরিবহন খাতের শ্রমিকদের সিংহভাগের কর্মকাণ্ড দেখলে তারা লজ্জায় মাথা নিচু করতেন। যে মালিকের শোষণ ও অনাচারের বিরুদ্ধে তাদের অর্থাৎ সাধারণ হিসেবে শ্রমিক শ্রেণির সংগ্রাম, তারা এখন পরোক্ষে তাদের আজ্ঞাবহ, সুবিধাবাদী শ্রমিক ইউনিয়ন নেতাদের স্বার্থপরতা ও চালবাজির শিকার হয়ে শ্রমিকরা মালিক ও নেতাদের স্বার্থ পূরণে পথে নামে, সহিংস ধর্মঘট বা কথিত আন্দোলনে। তারা তখন সাধারণ মানুষের স্বার্থবিরোধী কাজে লিপ্ত। শ্রমিক রাজনীতির নিয়ম ভেঙে তারা তখন আত্মস্বার্থকেও বলি দিচ্ছে, গুটিকয় ট্রেড ইউনিয়ন নেতার বেইমানি ও চাতুর্যের কাছে হার মেনে। গুটিকয় নীতিবাদী হয়তো বলতে পারতেন চিরন্তনী প্রবাদ বাক্য অনুসরণে : ‘হে পরিবহন শ্রমিক, তোমরা পথ হারাইয়াছ।’ সে কথা বললেও কে কার কথা শোনে। পরিবহন শ্রমিকদের কয়েকটি সহিংস ঘটনার রাজপথে/হাইওয়েতে সংঘর্ষের বিবরণ সংবাদপত্রে পড়ে আমি শ্রমিক আন্দোলনের মতাদর্শের আংশিক পরিণাম দেখে এ দেশে তাদের আদর্শের কথা ভেবে নিজেকে ধিক্কার দিয়েছি। দিয়েছি আরো বহু ঘটনা দেখে।

দুই. রবীন্দ্রনাথ একদা, কী উৎসে জানি না, পরম উৎসাহভরে লিখেছিলেন তার একটি গানের চমৎকার কম্পোজিশনে : ‘তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার সোনার হরিণ চাই।’ তিনি মনের আনন্দে যাই লিখে থাকুন, আদর্শিক প্রশ্নে তার সোনার হরিণ পাওয়ার স্বপ্ন তার চিতাভস্মে মিশে গেছে। একাত্তরে আমরা এমনই এক সোনার হরিণের স্বপ্ন দেখেছিলাম, তার কতটা পূরণ হয়েছে তা ভুক্তভোগীমাত্রই জানেন, কলকারখানায় শ্রমিক শ্রেণির অংশবিশেষ কতটা আদর্শচ্যুত হয়েছে তার বহু প্রমাণ সর্বঘটে, যেমন মানুষের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় তেমনি সংবাদপত্রের পাতায় পাতায় নানা কলামে ধৃত। সে আদর্শচ্যুতি দুর্নীতিতে সর্বঘটে, সর্বশ্রেণিতে। আগেই বলেছি এর সর্বোত্তম উদাহরণ পরিবহন শ্রমিক। তাদের শক্তিমান অংশ মালিকের স্বার্থ পূরণে নিজ স্বার্থ বিকিয়ে দিয়েছে। দেখে-শুনে মনোকষ্টে ভুগি- মালিক তাদের যথেচ্ছ ব্যবহার করছে। বিষয়টি নিয়ে এত কথা লেখার কারণ তাদের স্বস্বার্থ ও জনস্বার্থের সম্মিলিত আন্দোলনের ওপর বড় ভরসা ছিল। স্বপ্ন ছিল, শ্রমিক-কৃষক যৌথ আন্দোলনে মুক্তির ঠিকানার ওপর। এখন দেখছি, সবকিছুর নিয়ন্ত্রক সুবিধাবাদী সুবিধাভোগী শ্রেণি। এর মধ্য দিয়ে যে খুদকুঁড়ো ভাড়াটে শ্রমিকরা পায়, তাতেই তারা সন্তুষ্ট। সাধারণ মানুষ তাতে যত দুর্ভোগই পোহাক না কেন। যখনই জ¦ালানির দাম বাড়ে সঙ্গে সঙ্গে সে সুযোগ নেয় পরিবহন মালিকরা- পাঁচ টাকার ভাড়া দশ টাকা বা তারো বেশিতে নির্ধারণ করতে তাদের বিবেক বাধে না। আসলে মুনাফার বিপরীতে বিবেক বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব তাদের নেই।

তিন. এবারের ধর্মঘটি নৈরাজ্যের লক্ষ্য ছিল বাসের ভাড়া বাড়ানো। কাজেই দিন তিনেকের পরিবহন ধর্মঘট শেষে লক্ষ্য অর্জন অর্থাৎ ইচ্ছামতো বাস বাড়া বৃদ্ধি, যাত্রীদের প্রতিবাদ গায়ে না মেখে। ছোট্ট একটি উদাহরণ দিই : মিরপুর থেকে গুলিস্তানের ভাড়া এসব ঘটনার আগে ২৫ টাকা, এখন মালিকের ইচ্ছায় তা ৩০ টাকা, ভাবা যায়? এতে সংশ্লিষ্ট বাসের নাম বিহঙ্গ, শিকড়, খাজাবাবা, বিকল্প ইত্যাদি। অথচ আল মক্কা মিরপুর থেকে ভিন্ন পথে গুলিস্তান যেতে ভাড়া নেয় এখন ৪০ থেকে ৫০ টাকা। মজাটা হলো এদের ভাড়া বৃদ্ধির নৈরাজ্যে কারো কাছে জবাবদিহির কিছু নেই। একটি গণতান্ত্রিক দেশে কি এমন অবস্থা চলতে পারে? কিন্তু চলছে তো। যেহেতু অসহায় যাত্রীদের স্বার্থ রক্ষায় কোনো বলিষ্ঠ সংগঠন নেই, প্রতিবাদ নেই সংঘবদ্ধভাবে, তাই নৈরাজ্যিক রাজার রাজত্ব চলছে আমাদের পরিবহন খাতে। এ ব্যাপারে বাস-মিনিবাস একাকার। প্রথম আলোর ১৮.১১.২০২১ তারিখের একটি সংবাদ বিবরণে প্রকাশ শিরোনাম : ‘বেশি ভাড়া আদায় চলছেই’ : এ খাতে চলছে আরেক ধরনের প্রতারণা। প্রতিবেদকের মতে, ‘গেটলক সার্ভিসের নাম দিয়ে স্বল্প দূরত্বের ক্ষেত্রেও পুরো পথের ভাড়া আদায়। মিরপুর ১০ নম্বর সেকশন থেকে একজন যাত্রী কাজীপাড়া যাবেন মিনিবাসে, তার ভাড়া হওয়া উচিত ৮ টাকা। কিন্তু সিটিং সার্ভিসের নামে যাত্রীর কাছ থেকে ভাড়া আদায় করা হয় মিরপুর থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত দূরত্বে ২০ টাকা।’ এসব দেখার বা প্রতিকারের কোনো ব্যবস্থা নেই। কাজেই অবাধে চলছে অবৈধ মুনাফাবাজি। আগেই বলেছি, এসব ক্ষেত্রে মালিকের পক্ষে পরিবহন শ্রমিক, যাদের জনবান্ধব রাজনীতির ভাষায় বলা হয় ‘সর্বহারা’- যারা মার্কসবাদীদের ভাষায় সমাজ বদলের নায়ক। যাই হোক, পরিবহন নৈরাজ্য সম্পর্কে পূর্বোক্ত পত্রিকার কাটছাঁট মন্তব্য উল্লেখযোগ্য : ‘ঢাকার বাস বন্ধের ঘোষণা দেয়ার পরও চালাচ্ছে সিটিং সার্ভিস। হাতাহাতিতে লিপ্ত হতে হচ্ছে যাত্রীদের। বাস চালানো বন্ধ রাখছেন শ্রমিকরা।’ স্বভাবতই কিছুসংখ্যক যাত্রী প্রতিবাদী। তাদের আপত্তির পরিণামে যাত্রী বনাম বাস-শ্রমিকে হাতাহাতি। কিন্তু শ্রমিকের সঙ্গে ওরা পেরে ওঠেন না। কারণ অধিকাংশ যাত্রী শান্তিবাদী, তারা সংঘাতে জড়াতে নারাজ। কাজেই অব্যাহত বিক্রমে চলছে ইচ্ছামতো ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য। অবস্থাদৃষ্টে সংবাদপত্রে পরিস্থিতির মূল্যায়ন যাত্রীদের পক্ষে ‘ঢাকার বিশৃঙ্খল বাস সেবার সুফলভোগী একটি গোষ্ঠী, যারা নেতৃত্বে রয়েছে তাদের নিয়ন্ত্রণ করা বিআরটিএর পক্ষে সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক উদ্বেগ দরকার।’ আমরা মনে করি উদ্বেগ প্রকাশই যথেষ্ট নয়। অবস্থার যুক্তিসঙ্গত সমাধান ঘটাতে হলে তাদের সক্রিয় তৎপরতা প্রয়োজন। আমরা স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, পরিবহন খাতের নৈরাজ্য বন্ধ করতে শ্রমিক স্বার্থ, মালিক স্বার্থ এবং যাত্রী স্বার্থের সমন্বয় ঘটিয়ে সমাধানে পৌঁছাতে রাজনৈতিক শক্তি ও সরকারকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। প্রয়োজনে বসতে হবে পরিবহন শ্রমিক ও মালিকদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে। দিনের পর দিন অন্যায়, অনাচার ও অনিয়ম চলবে- একটি সুস্থ সমাজে এমনটা হতে পারে না, চলতে দেয়া ঠিক নয়। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, পরিবহন খাতে অনিয়মই দিনের পর দিন নিয়ম হিসেবে চলছে। এ অবস্থার আশু নিরসন জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আশা করি, উল্লিখিত সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ জনস্বার্থে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করবেন এবং দেশ ও সমাজের স্বার্থে সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসবেন।

আহমদ রফিক : লেখক, গবেষক ও ভাষাসংগ্রামী।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App