×

মুক্তচিন্তা

প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড আইন বিতর্ক

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৬ নভেম্বর ২০২১, ০১:৪৮ এএম

প্রাথমিক শিক্ষা হলো একজন শিক্ষার্থীর জীবনের মূল ভিত্তি। সেটি যদি মুখস্থনির্ভর হয়, সৃজনশীল না হয়, তবে আগামী দিনে আমাদের আর্থ-সামাজিকসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে তারা কীভাবে অর্থপূর্ণ অবদান রাখবে? এতে সমাজে বৈষম্য ও বিশৃঙ্খলা বেড়ে যাবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমরা একের পর এক শিক্ষার্থীদের প্রতিযোগিতামূলক পড়াশোনার দিকে ঠেলে দিয়েছি। ভালো জিপিএ অর্জনের জন্য একজন শিশুর সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে পড়াশোনা শুরু হয়। রিকশায় মায়ের সঙ্গে যাওয়ার সময় পড়াশোনা চলতে থাকে, স্কুলে পড়া চলতে থাকে। স্কুল থেকে কোচিং, তারপর কোচিং থেকে বাড়ি না ফিরতেই গৃহশিক্ষক অপেক্ষা করেন শিশুর জন্য। শিশুর সঙ্গে বাড়ির লোকজনও দৌড়াতে থাকে। এ বিষয়গুলো থেকে শিশুদের মুক্ত রাখতে সরকার পরীক্ষার চাপমুক্ত সৃজনশীল ভবিষ্যৎ গড়ার কথা বলছে এবং যার অংশ হিসেবে প্রস্তাবিত শিক্ষাক্রমে প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত মূল্যায়ন ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে, শ্রেণিকক্ষে মূল্যায়নের ওপর জোর দিচ্ছে, যা চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে ৭০ শতাংশ হবে শ্রেণিকক্ষভিত্তিক এবং ৩০ শতাংশ হবে সামষ্টিক, ষষ্ঠ থেকে অষ্টম পর্যন্ত ৬০ শতাংশ শ্রেণিক্ষকভিত্তিক এবং ৪০ শতাংশ সামষ্টিক, এসএসসিতে ৫০ শতাংশ শ্রেণিভিত্তিক এবং বাকি ৫০ সামষ্টিক। কিন্তু প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবিত আইনের খসড়া চূড়ান্ত পরস্পরমুখী সিদ্ধান্ত মনে হচ্ছে। ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষা নীতিতেও জাতীয়ভাবে সমাপনী পরীক্ষা পরিচালিত হওয়ার কথা ছিল না। পিএসসি পরীক্ষা শুরুর পেছনের দিকে তাকালে দেখা যায় ২০০৯-এর আগে পঞ্চম শ্রেণির পর বার্ষিক পরীক্ষা এবং একটি বৃত্তি পরীক্ষা হতো। বৃত্তি পরীক্ষার জন্য কিছু ভালো শিক্ষার্থীকে চিহ্নিত করে তাদের দিকে বিশেষ নজর দেয়া হতো বলে অন্যরা অনেক সময় অবহেলিত থাকত। তাদের মনে হতো যে, তারা নিম্নমানের শিক্ষার্থী, বিদ্যালয়ে তাদের সেভাবেই দেখা হতো। যারা বৃত্তি পরীক্ষা দেবে, বিদ্যালয় তাদের আলাদা চোখে দেখত, তাদের প্রতি ছিল আলাদা আচরণ। এগুলো শিশুমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে যা পরবর্তী জীবনেও থেকে যায়। এজন্য ওই সময়ের শিক্ষা নীতি প্রণয়ন কমিটি বৃত্তি পরীক্ষা বাতিল করে উপজেলা বা জেলাভিত্তিক অভিন্ন প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার কথা বলে। বলা হয়, ওই পরীক্ষায় সংশ্লিষ্ট সব শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করবে এবং ওই পরীক্ষার ভিত্তিতে বৃত্তি প্রদান করা হবে। পরে সেই প্রস্তাবিত পরীক্ষাটিই শেষ পর্যন্ত জাতীয় সমাপনী পরীক্ষায় পরিণত হয়। সাধারণ বিষয়কে অসাধারণ করে তুলে যেভাবে পিইসিকে জাতীয়ভাবে নেয়া শুরু হলো, সেটি এক ধরনের বিস্ময়। প্রাথমিক সমাপনীর পরীক্ষায় শিশুদের শারীরিক-মানসিক চাপ, অসুস্থ প্রতিযোগিতা, পড়াশোনার প্রকৃত আনন্দ হারিয়ে ফেলা ছাড়াও পরীক্ষার্থীদের মধ্যে নকলের প্রবণতাও দেখা গেছে। এমনকি শিক্ষকদের নকল সরবরাহ, পরীক্ষার হলে অসৎ সহযোগিতা ও নম্বর বাড়িয়ে পাসের সংখ্যা ও জিপিএ বাড়ানোর অঘোষিত নির্দেশনার বিষয়টিও উল্লেখযোগ্য ছিল শেষের দিকে। এসব কারণেও পিইসি পরীক্ষা পুরোপুরি প্রশ্নবিদ্ধ। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক ‘প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড আইন-২০২১’ প্রণয়নের বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন দেশের ৩৬ বিশিষ্টজন। তাদের মতে, এই সিদ্ধান্ত হবে আত্মঘাতী। তাই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার জোর দাবি জানিয়েছেন তারা। তারা বলছেন, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশ শিক্ষাক্ষেত্রে বেশ কিছু মাইলফলক অর্জন করেছে। প্রায় শতভাগ শিশুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি নিশ্চিতকরণ, ঝরে পড়ার হার কমিয়ে আনা, প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে ভর্তির ক্ষেত্রে ছেলেমেয়ের সমতা, উপবৃত্তি এবং বছরের প্রথম দিনে উৎসব আয়োজন করে নতুন বই প্রদান যার মধ্যে অন্যতম। এগুলো প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য পদক্ষেপ। জাতীয় শিক্ষা নীতি ২০১০-এর পঞ্চম শ্রেণির পরীক্ষাকে ‘পাবলিক পরীক্ষা’ হিসেবে ধরা হয়নি। এর পরিবর্তে বলা হয়েছে স্থানীয়ভাবে উপজেলা, পৌরসভা বা থানা পর্যায়ে অভিন্ন প্রশ্নপত্রে সমাপনী পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। প্রস্তাবিত আইন আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের কাঁধে বইয়ের বোঝা বাড়াবে এবং করোনার মতো মহাবিপর্যয়ের পর অভিভাবকদের কোচিং ও গাইড বইয়ের জন্য অতিরিক্ত ব্যয় বাড়াবে। আমরা লক্ষ্য করেছি আমাদের প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন সময় সঙ্গত কারণেই শিক্ষার্থীদের ওপর থেকে পরীক্ষা ও বইয়ের বোঝা কমানোর নির্দেশনা দিয়েছেন। সেই নির্দেশনার প্রতিফলন দেখা গেছে ২০২১ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রণীত ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখায়’, যেখানে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা রাখা হয়নি। এদিকে গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি আইন-২০২১-এর খসড়ার ওপর মতামত ও সুপারিশ জানতে তা বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে পাঠানো হয়। সেসব সুপারিশের ওপর গত ২৫ অক্টোবর আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় এ আইনের খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে আইনের খসড়াটি তুলে ধরা হয়েছে জনমত যাচাইয়ের জন্য। মন্ত্রণালয় বলছে জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি আইন ২০২১-এর খসড়ার ওপর মতামত সুপারিশ ২১ নভেম্বরের মধ্যে ইমেইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে হবে সংশ্লিষ্টদের। আমাদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার কারণে আমাদের শিশু-শিক্ষার্থীরা শৈশবের চঞ্চলতা হারিয়েছে, হারিয়েছে তাদের বয়স উপযোগী স্বতঃস্ফূর্ততা ও সুষমভাবে বেড়ে ওঠার অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়। পাঠ্যপুস্তকের চাপে ভারাক্রান্ত হয়ে তারা খেলাধুলাসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এরই ফলে সমাজে মাথাচাড়া দিচ্ছে অসহিষ্ণুতা, যা বিজ্ঞানমনস্ক আধুনিক জাতি গঠনের অন্তরায়। শিক্ষার্থীদের এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে তারা আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষমতার পরিচয় দিতে পারে। এ প্রেক্ষাপটে শিক্ষার কোনো স্তরে এমন কোনো ব্যবস্থাকে উৎসাহিত করা ঠিক হবে না, যার ফলে মুখস্থনির্ভরতা, গাইড বইয়ের প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বৃদ্ধি পায় আর সৃজনশীলতা চাপা পড়ে যায়। শিশুদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশে প্রতিভার উন্মেষ ঘটানোর জন্য শুধু পরীক্ষানির্ভর, সনদসর্বস্ব ব্যবস্থার পরিবর্তে সহ-পাঠক্রমিক কার্যক্রমে বেশি গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত আমাদের ভবিষ্যৎ নাগরিকদের সৃজনশীল মেধা বিকাশে আনন্দমুখর পরিবেশে শিক্ষা গ্রহণের পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড হতে পারে শিশু-শিক্ষার্থীদের ধারাবাহিক মূল্যায়ন কীভাবে হবে সেটি বৈজ্ঞানকিভাবে চালু করার জন্য। শিক্ষার্থীরা যাতে কোনোভাবে বুঝতে না পারে যে, তাদের পারফরম্যান্স মূল্যায়ন করা হচ্ছে। তারা বিদ্যালয়ে ও শিক্ষাজীবনে সব কিছুতেই যাতে আনন্দ উপভোগ করে সেই বিষয়টি প্রস্তাবিত বোর্ড সফলভাবে চালু করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর জাতীয় শিক্ষার্থী মূল্যায়নের (এনএসএ) কাজটি করে থাকে। এটি দক্ষতার সঙ্গে শিক্ষা বোর্ড করতে পারে। প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ডে শিশু শিক্ষা ও শিশু-শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিষয়ে সফল গবেষণা পরিচালিত হতে পারে। সেসব গবেষণার ওপর ভিত্তি করেই শিশুদের জন্য শিশুশিক্ষাবান্ধব অনেক সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য বোর্ড কাজ করতে পারে। শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়নের পুরো বিষয়টিই বোর্ডের কাছে থাকতে পারে। বোর্ডে থাকবে সত্যিকারের শিক্ষাবিদরা, রাজনৈতিকভাবে চিহ্নিত শিক্ষাবিদরা নন। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর শুধু প্রশাসনিক কাজগুলো করবে। আলাদাভাবে ‘নেপ’ (ন্যাশনাল একাডেমি ফর প্রাইমারি এডুকেশন) থাকার প্রয়োজন নেই। যদি থাকেও সেটি উন্নততর ও পুরোপুরি শিশুশিক্ষা ও শিক্ষাবিজ্ঞানভিত্তিক কার্যাবলি পরিচালিত করবে, শুধু প্রচলিত পদ্ধতিতে শিশুদের মূল্যায়ন নয়। এভাবে প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড শিক্ষার উন্নয়নে অনেক কিছু করতে পারে, শুধু সমাপনী পরীক্ষা পরিচালনার জন্য নয়। মাছুম বিল্লাহ : শিক্ষক ও লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App