×

অর্থনীতি

৬ কারণে রেমিট্যান্সে ধাক্কা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৫ নভেম্বর ২০২১, ০৯:০১ এএম

৬ কারণে রেমিট্যান্সে ধাক্কা

ফাইল ছবি

  • অব্যাহত আছে প্রণোদনা
  • বাড়ছে হুন্ডি
  • পাসপোর্ট নবায়ন জটিলতা

বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাস পরিস্থিতির উন্নতি হলেও দেশে রেমিট্যান্স কমে গেছে। তবে যাত্রী যাওয়া বেড়েছে আগের তুলনায় দ্বিগুণ। কেন রেমিট্যান্স আয় কমেছে এ নিয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, বিএমইটি এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের পদস্থ কর্মকর্তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেছেন। তাদের আলোচনায় উঠে এসেছে ছয়টি কারণ। এর মধ্যে বিমানের ফ্লাইট জটিলতা ও ভাড়া বৃদ্ধি, করোনা টিকা ও কোয়ারেন্টাইন বিড়ম্বনা, হুন্ডি বেড়ে যাওয়া এবং পাসপোর্ট নবায়ন জটিলতার কারণে রেমিট্যান্সে ধাক্কা লেগেছে বলে তারা চিহ্নিত করেছেন। সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা এমন তথ্য জানিয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) মহাপরিচালক মো. শহীদুল আলম বলেছেন, গত দুই মাস আগে মাসে দুই হাজার শ্রমিক যেতেন। এখন তা বেড়ে প্রতিমাসে পাঁচ হাজার শ্রমিক যাচ্ছেন। এই পরিসংখ্যান ঊর্ধ্বমুখী জানিয়ে তিনি বলেন, যাদের কাছে জমানো টাকা ছিল তারা পাঠিয়ে দিয়েছেন। আবার নতুন করে আয় করে পাঠাবেন। এজন্য রেমিট্যান্স কমতে পারে। নতুন করে শ্রমিকরা বিদেশে গিয়ে কাজ শুরুর পর রেমিট্যান্স বাড়তে পারে। এছাড়া হুন্ডি বেড়ে গেলে রেমিট্যান্স কমে বলেও জানান তিনি।

রেমিট্যান্স কমায় উদ্বেগের কোনো কারণ নেই বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম। ভোরের কাগজকে তিনি বলেন, স্বাভাবিকভাবে ঈদ বা পূজা পার্বণের সময় নগদ টাকার চাহিদা মেটাতে প্রবাসীদের দেশে অর্থ পাঠানোর তাগিদ থাকে। এ কারণে সারা বছরের মধ্যে ঈদের সময় রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স আসে। করোনাকালেও প্রবাসীরা জমানো অর্থ পরিবার পরিজনের কাছে পাঠিয়েছেন। ফলে ওই সময়ও রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স দেশে এসেছে। এখন কিছুটা কম থাকলেও ভবিষ্যতে তা বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সিরাজুল ইসলাম বলেন, ফ্লাইট ছিল না, যাতায়াত করতে পারেনি।

রেমিট্যান্স বাড়ানোর বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো উদ্যোগ আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের প্রণোদনা অব্যাহত রয়েছে। যারা ৫০০ ডলার পাঠাবে, অর্থাৎ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে ৩ শতাংশ প্রণোদনা দেয়ার জন্য আমরা ইতোমধ্যে মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ পাঠিয়েছি। পাশাপাশি ব্যাংকগুলোকে বলা হয়েছে, রেমিট্যান্স যারা পাঠায় তাদের রেট কন্সিডারের পাশাপাশি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যেন তা তাদের আত্মীয়দের কাছে পৌঁছানো যায়, সে ব্যবস্থা করতে হবে।

একাধিক রিক্রুটিং এজেন্সি মালিক জানিয়েছেন, রেমিট্যান্সের বড় অংশ আসে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে। মধ্যপ্রাচ্য ও মালেশিয়া থেকে বড় আয় হয়। করোনার টিকা এবং ফ্লাইট জটিলতার পাশাপাশি বিমানের টিকেটের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় অনেক শ্রমিক দেশে এসে আটকা পড়েছেন। আগে ঢাকা-রিয়াদ, ঢাকা- জেদ্দা, ঢাকা-দাম্মাম টিকেটের মূল্য ছিল ২২-৩০ হাজার টাকা। করোনাকালে তা বেড়ে এক লাখ টাকা পর্যন্ত উঠে। এখনো টিকেটের মূল্য ৮০-৯০ হাজার টাকা। এর মধ্যে টিকা না দিলে কোয়ারেন্টাইন করতে হচ্ছে। সরকার তিন মাস কোয়ারেন্টাইন খরচ দিলেও পরে তা বন্ধ। এজন্য যাত্রীর ব্যয় ৫০০ ডলার বেড়েছে। আবার যাত্রীর চাপ বেড়ে যাওয়ায় বিমানের টিকেট সংকট দেখা দিয়েছে। এক মাস আগে বুকিং দিয়েও মিলছে না টিকেট। অন্যদিকে এমআরপি পাসপোর্টধারীরা নানা কারণে ই-পাসপোর্ট পাচ্ছেন না। দেশে এসে তারাও আটকা পড়ে আছেন। এসবের প্রভাব পড়ছে রেমিট্যান্সে।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, করোনা মহামারির সময়ে দেশে রেমিট্যান্স আয় অনেক বেড়েছিল। পরে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় আন্তর্জাতিক চলাচল শুরু হওয়ার পরে রেমিট্যান্স কমতে শুরু করেছে। অন্যদিকে আমদানি ব্যয়ও বাড়তে শুরু করেছে। করোনা চলাকালে শিল্পের কাঁচামাল ও মেশিনারিজ আমদানি কম ছিল। স¤প্রতি তা বাড়তে শুরু করেছে। মহামারি চলাকালে প্রবাসীরা বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠালেও এখন অবৈধ পথেও (হুন্ডি) কিছু আসছে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের। আর আমদানির ক্ষেত্রেও এ পথের আশ্রয় নেয় অনেক আমদানিকারক। অবশ্য ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় যারা রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন তাদের জন্য সুবিধাজনক হচ্ছে। একইভাবে ডলারের দাম বাড়ায় সুবিধা পাচ্ছেন রপ্তানিকারকরা।

বাংলাদেশ ব্যাংক রেমিট্যান্সের সাপ্তাহিক তথ্যমতে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী এক কোটির বেশি প্রবাসী চলতি নভেম্বর মাসের ১৮ দিনে ১০৬ কোটি ৫৭ লাখ ৪০ হাজার ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের নি¤œমুখী ধারা অব্যাহত রয়েছে। চলতি নভেম্বর মাসের প্রথম ১৮ দিনে ব্যাংকিং চ্যানেলে ১০৬ কোটি ৫৭ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছেন তারা। গত বছরের নভেম্বরের এই ১৮ দিনে ১২৫ কোটি ডলারের মতো দেশে পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। রেমিট্যান্স কমায় বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভেও টান পড়েছে, নেমে এসেছে ৪৫ বিলিয়ন ডলারের নিচে। প্রতি মাসে ৭ বিলিয়ন ডলার আমদানি খরচ হিসেবে এই রিজার্ভ দিয়ে ছয় মাসের কিছু বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। অথচ দুই মাস আগেও বাংলাদেশের রিজার্ভ দিয়ে ১০ মাসের বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো যেত। সে সময় অবশ্য প্রতি মাসে আমদানিতে খরচ হতো চার-সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার।

আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রার মজুত থাকতে হয়। মহামারির মধ্যেও অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গত ২০২০-২১ অর্থবছরে ২ হাজার ৪৭৭ কোটি ৭৭ লাখ (২৪.৮ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। ওই অঙ্ক ছিল আগের বছরের চেয়ে ৬ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার বা ৩৬ দশমিক ১ শতাংশ বেশি। রেমিট্যান্স কমায় বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয় বা রিজার্ভও কমছে, নেমে এসেছে ৪৫ বিলিয়ন ডলারের নিচে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ৩৬৮ কোটি ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে যেখানে এসেছিল ৪৫৬ কোটি ডলার। এ হিসাবে দুই মাসে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স কমেছে ১৯ দশমিক ৩০ শতাংশ। গত অর্থবছর রেমিট্যান্সে যেখানে প্রবৃদ্ধি হয় ৩৬ দশমিক ১০ শতাংশ। এর আগে কোনো অর্থবছর রেমিট্যান্সে এত বেশি প্রবৃদ্ধি হয়নি।

রেমিট্যান্সের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, আগে যেসব দেশ থেকে বেশি রেমিট্যান্স আসতো সে সব দেশ থেকেই রেমিট্যান্স কমছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য থেকে হ্রাসের হার তুলনামূলকভাবে কম। যুক্তরাষ্ট্র থেকে গত অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে রেমিট্যান্স এসেছিল ৫৬ কোটি ৫৩ লাখ ডলার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে এসেছে ৫৬ কোটি ডলার। আর যুক্তরাজ্য থেকে ৩৩ কোটি ডলার থেকে কমে ৩০ কোটি ডলারে নেমেছে। রেমিট্যান্স আহরণের শীর্ষ দেশ সৌদি আরব থেকে ১৭ দশমিক ৪০ শতাংশ কমে ৮৯ কোটি ডলারে নেমেছে। বৈশ্বিক বিনিয়োগ পরিস্থিতির কারণে হুন্ডি চাহিদা কম থাকায় পুরো অর্থ আসছিল ব্যাংকিং চ্যানেলে। গত অর্থবছরে রেমিট্যান্স বেড়েছিল ৩৬ শতাংশ। কিন্তু হঠাৎ করে গত দুই মাস রেমিট্যান্স কমেছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App