×

মুক্তচিন্তা

রোহিঙ্গা সংকট : জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৩ নভেম্বর ২০২১, ১২:৪১ এএম

মিয়ানমারের সামরিক জান্তার প্রতি গণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের পাশাপাশি রোহিঙ্গা সংকট অবসানের আহ্বান জানিয়ে একটি প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের তৃতীয় কমিটিতে প্রথমবারের মতো গৃহীত হয়েছে। এই প্রস্তাবটি ওআইসি ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন যৌথভাবে উত্থাপন করলে সর্বোচ্চ সংখ্যক ১০৭টি দেশ সহপৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে। এই প্রস্তাব পাসটি এ কারণে গুরুত্বপূর্ণ যে, অতীতে অনেক দেশ এ প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দিলেও এবার কেউ বিরোধিতা করেনি। এর পাশাপাশি, আরেকটি কারণেও এই প্রস্তাবটি ঐতিহাসিক মিয়ানমার ইস্যুতে অধিকাংশ সদস্য দেশের সঙ্গে দৃশ্যত দ্বিমত প্রকাশকারী দেশ চীন ও রাশিয়াও অন্যান্যবারের মতো এবার বিপক্ষে দাঁড়ায়নি। এমন এক সময়ে এই প্রস্তাবটি পাস হয়েছে যার কিছু দিন আগে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের ৭৬তম সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর প্রতি ‘অতি জরুরি’ ভিত্তিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন জোরদার করার দাবি জানিয়ে এসেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি সেখানে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে এ সংকট প্রশ্নে প্রধান আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর নিষ্ক্রিয়তায় বাংলাদেশের মর্মাহত হওয়ার প্রসঙ্গ টেনে এনে বলেছিলেন- ‘চার বছর ধরে আমরা এই উচ্চাশাই পোষণ করে আসছিলাম যে এসব স্থানচ্যুত লোকজন নিজেদের দেশ, তাদের মাতৃভূমি মিয়ানমারে নিরাপদে, সুরক্ষিতভাবে সসম্মানে ফেরত যেতে পারবে। আমরা তাদের নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনের জন্য আন্তর্জাতিক সমাবেশে এবং আন্তর্জাতিক সমাজের প্রতি আস্থা রেখেছিলাম। আমাদের কথা শোনা হয়নি, আমাদের আশা অপূর্ণই থেকে গেছে।’ তিনি আরো বলেছিলেন, প্রত্যাবাসনে অগ্রগতির ঘাটতির কারণে হতাশা বৃদ্ধি পাওয়া রোহিঙ্গাদের অনেকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে এবং তারা অতি সহজে জঙ্গি মতাদর্শের শিকার হচ্ছে। এটি পুরো অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। এ ব্যাপারে অতি দ্রুত কিছু করতে ব্যর্থ হলে সামগ্রিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা মহাবিপদে পড়বে। মূলত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই আহ্বানের পরেই আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে গুরুত্ব হারাতে বসা রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান আবারো নতুন করে আলোচনায় আসে। এবং তারপরই সাধারণ পরিষদে সর্বসম্মতভাবে পাস হলো এ প্রস্তাবটি। কিন্তু এই প্রস্তাব পাসের কারণে মিয়ানমার কতখানি চাপের মুখে পড়ল, এ নিয়ে সন্দেহ কিছুটা রয়েই গেছে। কারণ সাধারণ পরিষদে গৃহীত প্রস্তাব দিয়ে কোনো বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া যায় না। এজন্য প্রয়োজন নিরাপত্তা পরিষদে সর্বসম্মত প্রস্তাব। দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটাই সত্যি যে, এতদিন চীন ও রাশিয়া সেখানে মিয়ানমারের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করার কারণে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়নি। তবে এবার যেহেতু দেশ দুটি সাধারণ পরিষদে বিরোধিতা করেনি সেক্ষেত্রে নিরাপত্তা পরিষদের ক্ষেত্রেও হয়তো আগের অবস্থান পর্যালোচনা করতে পারে। এবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আহ্বানের পর একটি জোরালো পদক্ষেপ এলেও প্রশ্ন আসতে পারে এতদিনেও কেন প্রত্যাশিত সাফল্য আসেনি? এর কারণ হচ্ছে, জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো রোহিঙ্গাদের ওপর চলা জাতিগত নিধন নিয়ে সোচ্চার হলেও আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা ও বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলো যারা রোহিঙ্গা ইস্যুতে মোটাদাগে ভূমিকা রাখতে পারত তারা বাংলাদেশকে আশ্বাস দিলেও আশানুরূপ সহযোগিতা করেনি। বিশেষ করে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে মাঠে রেফারির ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া চীনের ভূমিকা বাংলাদেশকে বরাবরই হতাশ করেছে। দেশটি শুরু থেকেই বিষয়টি আন্তর্জাতিক ফোরামে উপস্থাপনের পরিবর্তে দ্বিপক্ষীয় সমাধানের পক্ষে কাজ করেছে। নিরাপত্তা পরিষদে তারা বারবার ভেটো প্রয়োগ করেছে, প্রকাশ্যে বিরোধিতা করেছে। অন্যদিকে কেবল তাদের আশকারা পেয়েই মিয়ানমার নানা অজুহাতে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ঝুলিয়ে রেখেছে। এক পর্যায়ে চাপ দিয়ে চুক্তি করিয়েছে, অন্তরালে থেকে প্রত্যাবাসন নাটকও করিয়েছে। তদুপরি জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেও চীন ও রাশিয়ার ভূমিকার কারণে নিরাপত্তা পরিষদ কোনো রকম ব্যবস্থা নিতে পারেনি। যদিও গাম্বিয়ার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতনের বিষয়টি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল শুনানিতে সম্মতি দেয়। তবে হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অন্তর্র্বর্তী আদেশ দেয়ার সময়টাতে মিয়ানমারকে সাহস জোগাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দেশটি সফর করেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। অন্যদিকে এই অঞ্চলের অন্য দেশগুলোর ওপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টায় চীনের পাশাপাশি ভারতও সম্প্রতি এক চরম প্রতিযোগিতার লিপ্ত হয়েছে। এটাও আমাদের জন্য দুর্ভাগ্য বয়ে এনেছে। এর ফলে রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীনের মতো ভারতের মতো বন্ধুদেশকেও কখনো পাশে পায়নি বাংলাদেশ। চীন ও ভারত চিরপ্রতিদ্ব›দ্বী দেশ হলেও রোহিঙ্গা ইস্যুতে দুটি দেশই কৌশলগতভাবে বাংলাদেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। সীমান্ত নিয়ে চীনের সঙ্গে ভারতের বিরোধ দীর্ঘদিনের। দেশ দুটি কয়েকবার যুদ্ধেও জড়িয়েছে। ভারতের আকসাই চিন অঞ্চল ও অরুণাচল প্রদেশকে চীন নিজেদের এলাকা মনে করে। সে কারণে দেশটি লাদাখ ও সেভেন সিস্টার্স নিয়ে চরম নিরাপত্তা ঝুঁকিতে থাকে। এ ঝুঁকি আরো বাড়িয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ও নেপালের মধ্যে থাকা শিলিগুড়ি করিডর। এ করিডরটি ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সেভেন সিস্টার্সে যোগাযোগের একমাত্র পথ। চীনের দোকলাম থেকে যার দূরত্ব মাত্র ১৩০ কিলোমিটার।দুর্যোগপূর্ণ সময়ে চীনের চুম্বী ভ্যালিতে মোতায়েন থাকা সেনাবাহিনী শিলিগুড়ি করিডরের নিয়ন্ত্রণে নিতে পারলে পুরো সেভেন সিস্টার্স ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। ফলে নিরাপত্তা ও যোগাযোগের কথা চিন্তা করে ভারত কালাদান প্রকল্পের মাধ্যমে সেভেন সিস্টার্সে প্রবেশের বিকল্প একটি পথ তৈরিতে উদ্যোগী হয়। এটার ফলে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে দ্রুত সংযোগ স্থাপনের জন্য বাংলাদেশ রুট ছাড়াও অন্য একটি বিকল্পও তৈরি থাকল ভারতের কাছে। এ কারণে ভারতের কাছে দেশটি খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আর রাশিয়ার ব্যাপার হচ্ছে, দেশটি মিয়ানমারের অস্ত্রের বাজার দখলে নেয়ার চেষ্টা করছে। নজর আছে খনিজসম্পদের দিকেও। ইতোমধ্যে রাশিয়ার তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ‘গ্যাসপম’ মিয়ানমারে অফিস খুলেছে। অন্যদিকে বঙ্গোপসাগরকে ঘিরে সৃষ্ট নতুন ভূ-রাজনৈতিক ইকুয়েশনের কারণে চীনও মিয়ানমারের ওপর নির্ভরতা দিন দিন বাড়িয়েছে। বিশ্বে প্রভাব বিস্তারে চীনের বিআরআই প্রকল্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ ধরা হয় মিয়ানমারকে। এটা হচ্ছে, ভারত মহাসাগরে চীনের প্রবেশদ্বার। এর বিনিময়ে মিয়ানমার যা চেয়েছে, তা-ই দিয়েছে চীন। বলা হচ্ছে, চীনা অর্থনীতির লাইফলাইন হয়ে উঠতে পারে এই প্রবেশদ্বার। এসবের মাধ্যমে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং বঙ্গোপসাগরে অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তির ভারসাম্য চীনের পক্ষে রাখা হবে। এসব ইকুয়েশনের কারণে মিয়ানমারও হয়তো ভেবেছে, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত করতে পারলেই রোহিঙ্গা সংকটের ওপর থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগ কমে যাবে। এ কারণে তারা দিনের পর দিন ছলচাতুরি করে গেছে। চীন তার ভূ-রাজনীতির স্বার্থে উত্তর কোরিয়ার মতো মিয়ানমারকেও যা খুশি তা করার লাইসেন্স দিয়ে দিলেও মিয়ানমার ধীরে ধীরে পশ্চিমাদের সঙ্গেও সখ্য বাড়িয়েছে। মিয়ানমারের এই চালাকি চীন-রাশিয়া বুঝতে পারছে। বাংলাদেশের জোরদার কূটনৈতিক প্রচেষ্টা এবং চীনের এই বোধোদয়ের সম্ভবত যোগফলই হচ্ছে, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে চীনের বিরোধিতা না করা। আর মিয়ানমার প্রসঙ্গে চীন যেদিকে রাশিয়াও সেদিকে এই নীতির কারণে রাশিয়াও বিরোধিতা করেনি। তবে বাংলাদেশকে এইটুকুতে সন্তুষ্ট থাকলে চলবে না। চীন ও রাশিয়ার এই পদক্ষেপ তখনই ইতিবাচক হিসেবে গণ্য হবে যখন নিরাপত্তা পরিষদেও দেশ দুটি একই অবস্থান ধরে রাখবে। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আগ্রহ কমেনি বরং তারা আগের চেয়ে আরো বেশি জোরালোভাবে এ বিষয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। এখন চীন, রাশিয়াসহ ভারতের মতো আঞ্চলিক শক্তিগুলোও যাতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করে, সে কৌশল নিতে হবে। বিশেষ করে চীনের সঙ্গে রোহিঙ্গা ইস্যুতে কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রাখতে হবে। আমরা প্রত্যাশা করি, ক্যারিশম্যাটিক বিশ্বনেতা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকারের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব গ্রহণের সফলতাও নিয়ে আসবে অচিরেই।

মর্তুজা হাসান সৈকত : কবি ও লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App