×

তথ্যপ্রযুক্তি

হাজার কোটি টাকা বাঁচাবে জাতীয় ডাটা সেন্টার

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২২ নভেম্বর ২০২১, ০৯:১৬ এএম

হাজার কোটি টাকা বাঁচাবে জাতীয় ডাটা সেন্টার

ফাইল ছবি

  • সংরক্ষণ করা হচ্ছে দেশের নানা তথ্য উপাত্ত
  • আগ্রহ দেখাচ্ছে বিদেশি কয়েকটি কোম্পানি

তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে আমরা ইন্টারনেটে কী করছি, কোথায় বিচরণ করছি এসব ডাটাই সংরক্ষণ হচ্ছে। ফলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রূপকল্পে পাল্টে যাওয়া ডিজিটাল বাংলাদেশের পথ চলাতেও তৈরি হচ্ছে কোটি কোটি ডাটা। দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে সেগুলো সংরক্ষণ ও নিরবচ্ছিন্ন গুণগত মানসম্পন্ন ই-সেবা নিশ্চিত করার জন্য দেশেই তৈরি করা হয়েছে জাতীয় ডাটা সেন্টার বা তথ্যভাণ্ডার। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সব ডাটা এখন সংরক্ষণ করা হচ্ছে এই ফোর টায়ার ডাটা সেন্টারে। ফলে দেশের ডাটার নিরাপদ থাকার পাশাপাশি সাশ্রয় হচ্ছে শত শত কোটি টাকা। একই সঙ্গে বাড়তি আয় করারও সুযোগ তৈরি হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আন্তর্জাতিক মান ও নিরাপত্তা বলয় ঠিক রেখে তৈরি এ ডাটা সেন্টারটি বিশ্বের সপ্তমতম ডাটা সেন্টার হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। ডাটা সংরক্ষণে দেশি-বিদেশি বেসরকারি কোম্পানিগুলোর আগ্রহ বাড়াতে আন্তর্জাতিক রেটের তুলনায় ২৬ শতাংশ কম মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। ফলে ডাটা সংরক্ষণে আগ্রহ প্রকাশ করেছে ফেসবুক ও অ্যামাজনসহ খ্যাতনামা বেশ কয়েকটি কোম্পানি।

জাতীয় ডাটা সেন্টার কর্তৃপক্ষ জানায়, জনপ্রশাসনে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে কাজের দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বাড়ানো, তথ্য সংরক্ষণ ও জনগণের দোরগোড়ায় ডিজিটাল সেবা পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে এ ডাটা সেন্টার তৈরি করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ যেমন শুধু একটি প্রতিষ্ঠান নয়, মর্যাদা ও নিরাপত্তার অনুসঙ্গ; তেমনি ডাটা সেন্টারটিকেও শুধু একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না।

কারণ হাইটেক পার্ক, শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং এন্ড ইনকিউবেশন সেন্টার, সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক কিংবা ডিজিটাল সেবা সেন্টার যদি ডিজিটাল বাংলাদেশের হাত-পা চোখ-কান হয়, তাহলে ডাটা সেন্টার হচ্ছে ‘হার্ট অফ ডিজিটাল বাংলাদেশ’। বাংলাদেশের সব ধরনের তথ্য বা ডাটা জমা এবং আদান প্রদান করা হবে এখান থেকেই।

কর্তৃপক্ষ আরও জানায়, ২০১৯ সালে ২৮ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক মানের সর্বাধুনিক এই ডাটা সেন্টার উদ্বোধন করেন। প্রথমে ২ পেটাবাইট ধারণক্ষমতা নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও এখন ধারণক্ষমতা ২২ পেটাবাইট। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি এটুআই এর ই-নথি ও উন্নয়নকৃত সব সেবাসহ সরকারের ১০টি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করেছে। ভবিষ্যতে সরকারের সবগুলো মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠানের ডাটা এখানে সংরক্ষণ করা হবে। পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়ের দেশি-বিদেশি ১২টি কোম্পানি চুক্তি সম্পাদনের পর্যায়ে রয়েছে। বর্তমানে যে পরিমাণ ডাটা সংরক্ষণ করা আছে, তাতে সরকারের ৩৫৩ কোটি টাকা সাশ্রয় হচ্ছে। ভবিষ্যতে চাহিদা অনুযায়ী ডাটা সেন্টারের সক্ষমতা ২০০ পেটাবাইটে উন্নতি করা হবে। তখন দেশের হাজার কোটি টাকারও বেশি সাশ্রয় হবে।

জাতীয় ডাটা সেন্টারের সার্বিক দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ ডাটা সেন্টার কোম্পানি লিমিটেডের কর্মকর্তারা বলেন, এ ডাটা সেন্টারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো- নিরবচ্ছিন্ন অপারেশন ও মেইন্টেনেন্স নিশ্চিত করতে বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সংযোগসহ সব গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে রিডাডেন্সি। এছাড়া এখানে ক্লাউড কম্পিউটিং, ক্লাউড ডেস্কটপ, ক্লাউড স্টোরেজ, ডাটা স্টোরেজ ও ব্যাকআপ, ডাটা সিকিউরিটি ও কো-লোকেশন সার্ভিস রয়েছে। ৯৯ দশমিক ৯৯৫% অপটাইম বিশিষ্ট এই ডাটা সেন্টার থেকে ২৪ ঘণ্টা নিশ্চিতের লক্ষ্যে প্রশিক্ষিত ও দক্ষ জনবল দ্বারা ডাটা সেন্টার পরিচালনার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সেই সঙ্গে রাখা হয়েছে ৫ স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। পুরো ডাটা সেন্টারে বিভিন্ন কাজ নিয়ন্ত্রণের জন্য লাগানো হয়েছে দুই লাখেরও বেশি সেন্সর।

সরজমিন দেখা যায়, গাজীপুরের কালিয়াকৈরে বঙ্গবন্ধু হাই-টেক সিটিতে ৭ একর জমির ওপর নির্মাণ করা হয়েছে জাতীয় ডাটা সেন্টারটি। ২ লাখ স্কয়ার ফিট বিশিষ্ট ডাটা সেন্টারের মূল ভবন দ্বিতল, দুই পাশে দুটি ইউটিলিটি ভবন এবং সামনে রিসিপশন ভবন। বাইরে থেকে দৃষ্টিনন্দন হলেও এর ভেতরের কার্যক্রম কারো পক্ষেই অনুমান করা সম্ভব নয়। রিসিপশন থেকে সিঁড়ি দিয়ে গ্রাউন্ড ফ্লোরে নামলেই গা ছমছম করা শুরু হবে। যদিও আগে থেকে রিসিপশন থেকেই বলে দেয়া হয়েছে, কোনো রকম অস্বস্তি বোধ হলে সঙ্গে সঙ্গে অবগত করতে, এজন্য ভয়টা আরো বেশি। লিফটে এক ফ্লোর উপরে উঠে করিডোর দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেই অবাক হতে হবে। হলিউড বা বলিউটে সার্ভার থেকে ডাটা চুরির জন্য যে ধরনের ডাটা সেন্টার দেখানো হয়, তার চেয়েও বিশাল পরিসরে সারিবদ্ধভাবে সাজানো রয়েছে সার্ভার আর সার্ভার।

সার্ভার ঠাণ্ডা রাখার জন্য এয়ার কুলিং ও ওয়াটার কুলিং ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সার্ভার যাতে কখনো ক্রাশ না করে, সেজন্য বিদ্যুতের সরাসরি কানেকশন দেয় হয় না। অন্য একটি ফ্লোরে বিশাল জায়গা নিয়ে ব্যাটারি স্থাপন করা হয়েছে। ব্যাটারির রুমে প্রবেশ করতেই ডাটা সেন্টারের কর্মীরা বললেন, ফ্লোরের কোণে থাকা হাই ভোল্টেজ তার থেকে সাবধান। এর পাশেই রয়েছে অক্সিজেন রুম। পুরো ভবনটি এয়ার টাইট হওয়ায়, সামগ্রিক অক্সিজেন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করা হয় স্বয়ংক্রিয়ভাবে। কোনো কারণে আগুন লাগলে যেন সার্ভারের কোনো ক্ষতি না হয়, সেজন্য সেন্সরের মাধ্যমে ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে আগুন নিয়ন্ত্রণের অত্যাধুনিক ব্যবস্থা। ডাটা সেন্টার থেকে বের হওয়ার পর সাময়িকভাবে মনে হবে, অন্যকোনো জগতে থেকে ফিরে এলাম। যেটি বাস্তবিক অর্থেই বাংলাদেশের মস্তিষ্ক বা ব্রেইন হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশ ডাটা সেন্টার কোম্পানি লিমিটেডের সেক্রেটারি এ কে এম লতিফুর কবির ভোরের কাগজকে বলেন, বিশ্বমানের এ ডাটা সেন্টার স্থাপনের ফলে বিদেশি ডাটা সেন্টারের নির্ভরতা ও অর্থ ব্যয় পরিহার করা সম্ভব হচ্ছে। এখানে সরকারি দপ্তরের ডাটা ছাড়াও ভাড়া দেয়ার জন্য আলাদা স্পেস রাখা হয়েছে। সেক্ষেত্রে গ্রাহক ইচ্ছা মতো আইটি যন্ত্রপাতি স্থাপন করে কাক্সিক্ষত সেবা পেতে পারবেন। তিনি আরো বলেন, ওরাকল প্রযুক্তির জি-ক্লাউড স্থাপন সম্পন্ন হলে ইনফ্রাসট্রাকচার, প্ল্যাটফর্ম ও সফটওয়্যার এই ৩ ধরনের সার্ভিস দেয়া সম্ভব হবে। ওরাকল ক্লাউড সিস্টেমে স্টান্ডালোন ব্যাকআপ ব্যবস্থাও থাকবে। ফলে বিশ্বমানের এই ডাটা সেন্টার থেকে মানসম্পন্ন সেবা নিতে সবাইকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ভোরের কাগজকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তার আইসিটি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ডিজিটাল বাংলাদেশের ব্রেইন হচ্ছে জাতীয় ডাটা সেন্টার। দেখে গুদাম ঘরের মতো মনে হলেও, এর মধ্যে ৫৫ হাজার ওয়েবসাইট হোস্ট করা। পাশাপাশি ১১ কোটি এনআইডি কার্ড, ই-নথি ও সুরক্ষা অ্যাপসের সব তথ্য সংরক্ষণ করা রয়েছে। ইতোমধ্যে ডাটা সেন্টার কয়েকশ কোটি টাকা সাশ্রয় করার পাশাপাশি আয় শুরু করেছে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি জায়ান্ট কোম্পানি ডাটা সংরক্ষণের জন্য চুক্তি করতে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে বিশাল অঙ্কের টাকা সাশ্রয়ের পাশাপাশি সাইবার ক্রাইম থেকে দেশকে রক্ষা করবে এই ডাটা সেন্টার।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App