×

জাতীয়

যোগ্যরা নৌকা পাননি যে কারণে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২২ নভেম্বর ২০২১, ০৮:৫৩ এএম

  •  ‘বিদ্রোহী’ তকমায় মনোনয়ন পাচ্ছেন না জনপ্রিয়রা, আর্থিক কারণেও যোগ্যদের নাম আসছে না কেন্দ্রে

তৃণমূলে দলের নেতাকর্মীদের সমর্থনে প্রথম বা দ্বিতীয় হয়েও ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বঞ্চিত হচ্ছেন জনপ্রিয় প্রার্থীদের অনেকেই। উপজেলা, জেলার শীর্ষ নেতা, স্থানীয় সাংসদ ও মন্ত্রীদের আস্থাভাজন না হওয়া এর একটি অন্যতম কারণ। মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে তৃণমূল থেকে অত্যন্ত গোপনে কেন্দ্রে নাম পাঠানো হচ্ছে অজনপ্রিয়দের। যাদের মধ্যে কেউ কেউ নব্য আওয়ামী লীগার ও হাইব্রিড শ্রেণীর নেতা। তাদের পেছনে রয়েছে দলটির প্রভাবশালীদের হাত। সাধারণ নেতাকর্মীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে নামকাওয়াস্তে তৃণমূল থেকে পাঠানো হচ্ছে যে রেজ্যুলেশন, তা থেকেই চূড়ান্ত হচ্ছে দলীয় মনোনয়ন। বঞ্চিত হচ্ছেন তৃণমূলের পরীক্ষিতরা। ক্ষোভে-অভিমানে বিদ্রোহী প্রার্থী হচ্ছেন তারা। তাদের পেছনেও আছে প্রভাবশালী সাংসদ বা মন্ত্রীদের হাত।

জানা গেছে, সারাদেশে ইউনিয়ন পরিষদের সংখ্যা ৪ হাজার ৫৬৯টি। অনেকগুলোর নির্বাচন হয়ে গেছে। বিশেষ করে প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে নির্বাচন শেষ হয়েছে। আগামী ২৮ নভেম্বর তৃতীয়, ২৩ ডিসেম্বর চতুর্থ ধাপে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আগামীকাল সোমবার ঘোষণা হবে পঞ্চম ধাপের তফসিল। গতকাল থেকে ঘোষণা শুরু হয়েছে তৃতীয় দফার মনোনয়ন। দুই দফার নির্বাচনে ছিল আওয়ামী লীগের অসংখ্য বিদ্রোহী প্রার্থী। মনোনয়ন ঘোষণার আগে ও পরে তৃণমূলের নেতারাই একে অন্যকে রাজাকার, হাইব্রিড, দুর্নীতিবাজ ও অজনপ্রিয় উল্লেখ করে আওয়ামী লীগ অফিসে অভিযোগ জমা দিয়েছেন। এসব অভিযোগ স্তূপাকারে জমা পড়েছে। সব অভিযোগ আমলে নেয়া সম্ভব না হলেও কিছু কিছু অভিযোগ নিয়ে আলোচনা করা হয়। যার সমাধানও মিলে দলটির হাইকমান্ড থেকে। তবে এই সংখ্যা খুবই নগণ্য।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও তৃণমূল পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চলমান ইউপি নির্বাচনে সাংগঠনিক সব ধরনের যোগ্যতা আছে; অথচ তৃণমূলের কিছু নেতার অর্থলিপ্সার কারণে নৌকার মনোনয়ন বঞ্চিত হচ্ছেন। মনোনয়ন পাচ্ছেন নতুন, সুবিধাবাদী ও অজনপ্রিয়রা। যারা উপজেলা, জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা, স্থানীয় সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীদের আর্শীবাদপুষ্ট এবং তাদের ব্যক্তিগত পছন্দের ব্যক্তি। তৃণমূল থেকে কেন্দ্রে নাম পাঠানোর ক্ষেত্রে তাদের থাকে হস্তক্ষেপ। ফলে ইউনিয়ন পর্যায়ে বর্ধিতসভায় তৃণমূলের যারা জনপ্রিয়, কোনো না কোনো অজুুহাতে উপজেলা ও জেলার তালিকায় তাদের নাম দেয়া হচ্ছে না। বড় অঙ্কের আর্থিক লেনদেনে অজনপ্রিয়দের নাম পাঠানো হচ্ছে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় হিসেবে। তাদের সঙ্গে থাকছে এমপি ও সাংসদদের প্রভাবও। যা শুধু জানতে পারছেন ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলার সভাপতি-সম্পাদকরা। অনেক ক্ষেত্রে চাপ সৃষ্টি করেই রেজ্যুলেশনে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি-সম্পাদকদের সাদা কাগজে ফাঁকা স্বাক্ষর নিয়ে নেন উপজেলা নেতারা। তারাও জানতে পারেন না কার নাম পাঠানো হচ্ছে কেন্দ্রে। অনেকটা গোপনীয়ভাবে নিজেরা প্রার্থী চূড়ান্ত করে কেন্দ্রে তালিকা পাঠিয়ে দিচ্ছেন। আর তাদের থেকেই একজনকে চূড়ান্ত করে কেন্দ্র। কেন্দ্রে নাম না আসায় দলের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করলেও বঞ্চিত হচ্ছেন অনেক যোগ্য, ত্যাগী, জনপ্রিয় ও পরীক্ষিতরা। তারাও স্থানীয় নেতাদের প্রতি ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশস্বরূপ বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন। তাদেরকে অনেকটা প্রকাশ্যে সমর্থন দিচ্ছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের বড় একটি অংশ।

দেখা গেছে, এবারের পৌর ও ইউপি নির্বাচনে বিদ্রোহীদের জয়জয়কার। বিদ্রোহীদের বড় একটি অংশ বর্তমান মেয়র বা চেয়ারম্যান। বিদ্রোহীদের জয়জয়কারের অন্যতম কারণ হলো বিগত পৌর ও ইউপি নির্বাচনে তারা দলের মনোনয়ন না পেয়েও বিজয়ী হয়েছেন। যাদের অধিকাংশ আবার দলীয় প্রতীকে স্থানীয় নির্বাচন হওয়ার আগে থেকেই বিজয়ী হয়েছিলেন। বিগত নির্বাচনে দলের মনোনয়ন চেয়ে না পাওয়ায় স্বতন্ত্র বা বিদ্রোহী হিসেবে দাঁড়িয়ে বিজয়ী হলেও আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পদে তারা আছেন। পৌরসভা বা ইউনিয়ন প্রধান হিসেবে আওয়ামী লীগের হয়েই দায়িত্ব পালন করেছেন। এবারো নির্বাচনে সেসব জনপ্রতিনিধিই দলের মনোনয়ন চেয়েছেন। আওয়ামী লীগের তৃণমূলেও তাদের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। পৌর বা ইউনিয়নে বর্ধিতসভায় তাদের কারো কারো নাম ১ নম্বরে এসেছে। কিন্তু বিগত নির্বাচনে বিদ্রোহী তকমা থাকায় জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও এ রকম কাউকেই দলীয় মনোনয়ন দেয়নি আওয়ামী লীগ। ফলে তারা আবার বিদ্রোহী হিসেবে নির্বাচনে দাঁড়িয়ে গেছেন এবং বিজয়ীও হয়েছেন। তাদের অনুসরণ করেই দলের অন্য জনপ্রিয় নেতারা দলীয় প্রতীক না পেয়ে বিদ্রোহী হিসেবে দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন। আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারাও নানা ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ছেন। এই সুযোগে বিজয়ী হচ্ছেন বিদ্রোহীরা।

তবে গত শনিবার দিনভর অনুষ্ঠিত চতুর্থ ধাপের মনোনয়ন বাছাইয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করেছে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ড। ওইদিন রংপুর, রাজশাহী, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের মোট ৩৫৩টি ইউপির মনোনয়ন চূড়ান্ত করেছে দলটির মনোনয়ন বোর্ড। এসব মনোনয়নে দেখা গেছে প্রায় ৯০ ভাগই নৌকা প্রতীক দেয়া হচ্ছে দলটির বর্তমান মেয়র ও চেয়ারম্যানদের। সেক্ষেত্রে একাধিক গোয়েন্দা রিপোর্টও তাদের পক্ষে রয়েছে বলে জানা গেছে।

আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ইউপি নির্বাচনে শুধু চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী মনোনয়ন দেয় দলটি। তফসিল ঘোষণার পর ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা থেকে সমন্বিতভাবে কমপক্ষে তিনজনের একটি প্রার্থী প্যানেল মনোনয়ন বোর্ড কেন্দ্রে পাঠাবে। প্রার্থী প্যানেল তৈরির প্রাথমিক দায়িত্ব ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের। প্যানেল তৈরির জন্য ইউনিয়নের কার্যনির্বাহী সংসদ ও সব ওয়ার্ডের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকদের নিয়ে বর্ধিত সভা করবে। সভায় আলোচনার মাধ্যমে একটি প্যানেল সুপারিশের জন্য তৈরি করবে। জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকদের যুক্ত স্বাক্ষরে প্রার্থীদের যোগ্যতা, নেতৃত্বের গুণাবলি, জনপ্রিয়তা ইত্যাদি বিষয় উল্লেখ করে কমপক্ষে তিনজনের সুপারিশ মনোনয়ন বোর্ড পাঠাবে। ৬ জন সভাপতি-সম্পাদকদের মধ্যে কোনো মতপার্থক্য থাকলে তা সুপারিশে উল্লেখ করতে পারবে। এরপর স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ড আলোচনা করে একজন প্রার্থীর মনোনয়ন চূড়ান্ত করবে। বর্তমানে এই প্রক্রিয়ার ব্যত্যয় ঘটছে মারাত্মকভাবে।

এসব বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য কর্নেল (অব.) ফারুক খান ভোরের কাগজকে বলেন, তৃণমূলে নির্বাচনে প্রার্থী বাছাই নিয়ে অভিযোগেরও ফাইল রয়েছে। অভিযোগ নিয়ে মনোনয়ন বোর্ডে আলোচনা করা হয়। কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে। তবে এটাও ঠিক যখন কেউ মনোনয়ন পান না, তখন তিনি অন্যের বিরুদ্ধে নানা রকম অভিযোগ তোলেন। শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বেই এটি স্বীকৃত। তিনি বলেন, দলের পক্ষে অনেকেই মনোনয়ন চাইবেন, এটি স্বাভাবিক। প্রতিটি ইউনিয়নেই ৫ থেকে ১০ জন মনোনয়ন চান। অধিকাংশই খুব দক্ষ ও যোগ্য। আমাদের প্রধান লক্ষ্য নেতৃত্ব তৈরি করা। এতজনকে একসঙ্গে তো মনোনয়ন দেয়া সম্ভব নয়। তখন একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে বলতে থাকে। অধিকাংশই কল্পনাপ্রসূত।

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, নিঃসন্দেহে বিদ্রোহী প্রার্থী দলের জন্য সুখকর নয়। তৃণমূলে বিদ্রোহের কারণে দলের ত্যাগীদের মধ্যে বিভাজন বাড়ছে। যার নেতিবাচক প্রভাব আগামী জাতীয় নির্বাচনে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App