×

মুক্তচিন্তা

কেমন আছে ড্রয়িংরুমের বোকা-বাক্সটি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২১ নভেম্বর ২০২১, ১২:০৫ এএম

কেমন আছে ড্রয়িংরুমের বোকা-বাক্সটি

সৈয়দ আশিক রহমান

২১ নভেম্বর বিশ্ব টেলিভিশন দিবস। এ উপলক্ষে সর্বস্তরের দর্শক ও টেলিভিশন শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মীদের প্রতি অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা। সুস্থ বিনোদনের খোরাক জোগানোর পাশাপাশি, স্বদেশী কৃষ্টি-সংস্কৃতির সুষ্ঠু বিকাশ এবং মূল্যবোধের গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো। সোশ্যাল মিডিয়ার এই যুগে গুজব এবং অসত্য তথ্য ছড়িয়ে দেয়া খুব সহজ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা মানুষকে বিভ্রান্ত করছে, সংঘাত উসকে দিচ্ছে, সমাজ ও রাষ্ট্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। সত্য, প্রকৃত ও বস্তুনিষ্ঠ তথ্য গণমানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার মধ্য দিয়ে এসব গুজব এবং অসত্য তথ্যকে প্রতিরোধ করছে দেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো। অপসংস্কৃতি যখন আমাদের সমাজকে চারদিক থেকে গ্রাস করার চেষ্টায় লিপ্ত, তখন রুচিশীল, মননশীল ও নৈতিকতা উদ্দীপক অনুষ্ঠান প্রচারের মাধ্যমে দেশের টিভি চ্যানেলগুলো হয়ে উঠেছে সমাজের রক্ষাকবচ। বর্তমান সরকার দেশীয় টেলিভিশন শিল্পবান্ধব একটি সরকার। বাংলাদেশের টেলিভিশন শিল্পের সুরক্ষায় খাত সংশ্লিষ্টদের বহু দিনের দাবি ছিল ‘কেবল টেলিভিশন নেটওয়ার্ক পরিচালনা আইন-২০০৬’ এর যথাযথ বাস্তবায়ন করা হোক। কিন্তু কেউ এই দাবি আমলে নেয়নি। তবে বর্তমান তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এমপি এই আইন যথাযথ বাস্তবায়নে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। বেঁধে দেয়া ডেটলাইন পেরিয়েও দেশের আইন ও নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে অনুমোদনহীন চ্যানেল কিংবা বিজ্ঞাপনসহ বিদেশি চ্যানেল যারা সম্প্রচার করেছে তাদের জরিমানাও করা হয়েছে। শুরুতে ‘সম্ভব নয়’ বলা হলেও এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি অনেক বিদেশি টিভি চ্যানেলই বিজ্ঞাপন ছাড়া সম্প্রচার করা হচ্ছে। তবে এটাও ঠিক, কর্তৃপক্ষের যথাযথ অনুমোদন না নিয়েও কিছু কিছু বিদেশি টিভি চ্যানেল দেশে এখনো সম্প্রচার হচ্ছে। বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলোর জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে অনুমোদনহীন এসব চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধ করা জরুরি। সোশ্যাল মিডিয়ার জাগরণে অনেকেই ধারণা করেছিলেন, প্রচলিত মিডিয়াগুলো সম্ভবত বিলীন হয়ে যাবে। তাদের সেই ধারণা অমূলক প্রমাণিত হয়েছে। দেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো বরং সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করছে দর্শকদের কাছে তাদের অনুষ্ঠানগুলো পৌঁছে দেয়ার আরেকটি মাধ্যম হিসেবে। তবে একথাও মনে রাখতে হবে, এক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা অনেকখানি বেড়ে গেছে। হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের টেলিভিশন শিল্পকে এই প্রতিযোগিতায় কীভাবে এগিয়ে রাখা যায়, কীভাবে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড দেয়া যায় তার পথ খুঁজতে হবে। এজন্য একটি কৌশলী নীতিমালা প্রণোয়ন করতে হবে। অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিবেশী দেশগুলোর কনটেন্টের সঙ্গে তুলনা করে বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর কনটেন্টের মান নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। পর্যবেক্ষকদের এই পর্যবেক্ষণের যৌক্তিকতা আছে। তবে তুলনার সময় ‘সুবিধা এবং সীমাবদ্ধতাগুলো’ আমলে রাখলে যৌক্তিক বিচার অনেকখানি সহজ হয়ে যাবে। ভালো কনটেন্ট তৈরি করতে গেলে বিনিয়োগের প্রয়োজন পড়ে। প্রতিবেশী দেশের বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের একেকটি কনটেন্ট তৈরিতে যে খরচ করা হয়, তা বাংলাদেশের কিছু কিছু চ্যানেলের প্রায় সারা বছরের বাজেটের সমান। তারা বিনিয়োগ করতে পারছে, কারণ তাদের আয় আছে। তারা এক মিনিট বিজ্ঞাপন দেখিয়ে যে পরিমাণ আয় করে, সমপরিমাণ আয় করতে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলোকে অন্তত ১৮ থেকে ২০ মিনিট বিজ্ঞাপন দেখাতে হয়। মনে রাখা দরকার, দেশের টিভি চ্যানেলগুলোর আয়ের একমাত্র উৎস বিজ্ঞাপন। দর্শকরা টিভি চ্যানেল দেখা বাবদ প্রতি মাসে গ্রাহকপ্রতি ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা হিসেবে সম্মিলিতভাবে প্রায় ৬০০ থেকে ৮০০ কোটি টাকা পরিশোধ করেন। এর কিছু অংশ বিদেশি টিভি চ্যানেলগুলো সাবসক্রিপশন ফি বাবদ পেলেও দেশের টিভি চ্যানেলগুলো এক কানাকড়িও পায় না। এই অবিচার, বৈষম্য থেকে যতদিন না দেশের টিভি চ্যানেলগুলোকে রক্ষা করা যাবে, ততদিন রুগ্ণই থেকে যাবে বাংলাদেশের টেলিভিশন শিল্প। সুতরাং, দর্শকদের প্রদেয় ফি’র একটি অংশ যাতে দেশের টিভি চ্যানেলগুলো পায়, তার বন্দোবস্ত করতে হবে, পাশাপাশি বিজ্ঞাপনের বাজারকে সুসংহত ও সুশৃঙ্খল করতে হবে। স্বদেশী টিভি চ্যানেলগুলোর সুরক্ষায় দর্শকদেরও সোচ্চার হওয়ার সময় এসেছে। মনে রাখতে হবে, দেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো দুর্বল হয়ে গেলে অপসংস্কৃতি গ্রাস করবে আমাদের সমাজ ও আমাদের পরিবারগুলোকে। টেলিভিশন চ্যানেল দুর্বল হয়ে গেলে শক্তিশালী হয়ে উঠবে গুজব, ঝুঁকিতে পড়বে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা। পাশাপাশি কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে পড়বে টেলিভিশন শিল্পের ওপর সরাসরি নির্ভরশীল বিভিন্ন পর্যায়ের কয়েক হাজার কর্মী ও তার পরিবার। আরেকটি সমস্যা না বললেই নয়। একটা সময় ছিল যখন সৃজনশীল তরুণদের স্বপ্নই ছিল টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে কাজ করা। সেই স্বপ্ন এখন অনেকটাই ফিকে হয়ে গেছে। সাংবাদিকতা কিংবা মিডিয়া নিয়ে পড়াশোনা করেও অনিশ্চয়তার কারণে অনেকেই এখন মিডিয়ায় কাজ করতে চায় না। ফলে মিডিয়ায় এক ধরনের মেধাশূন্যতা তৈরির শঙ্কা রয়েছে। ইতোমধ্যে দক্ষ জনবলের ঘাটতি প্রকট হয়ে উঠতে শুরু করেছে এই খাতে। সব মিলিয়ে ক্রমাগতভাবে একটি দুষ্টু চক্রে আটকে যাচ্ছে দেশের টেলিভিশন শিল্প। এর থেকে বেরুতে হলে সরকারকেই অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। সরকার টেনে দাঁড় করিয়ে দিক, টেলিভিশন শিল্পসংশ্লিষ্টরা নিজেরাই তা চায় না। তারা শুধু চায় লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড। সরকার চাইলেই এটা করতে পারে। বিশ্ব টেলিভিশন দিবসে এর উত্তরোত্তর উৎকর্ষ ও সমৃদ্ধিই আমাদের সবার প্রত্যাশা। লেখক : প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, আরটিভি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App