×

মুক্তচিন্তা

মৌলবাদের অন্তরাত্মা

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৯ নভেম্বর ২০২১, ০১:২৮ এএম

যে যুবক খুন করেছে কাউকে এবং ধরা পড়ে গেছে, জানে শাস্তি হবে, মৃত্যুদণ্ডই সম্ভবত, সে যদি প্রফুল্ল থাকে, মৃদু হাসি ফুটিয়ে রাখে মুখে, তাহলে তাকে আমরা কী বলব- বদ্ধ উন্মাদ, নাকি অন্য কিছু? ইগার আমীর নামে যে ইহুদি যুবক ইসরায়েলের অর্থাৎ তারই রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী ইসহাক রাবিনকে হত্যা করেছিল তাকে আমরা অবশ্যই পাগল বলতে পারি। যোগ করা যাবে যে সে সাধারণ উন্মাদ নয়। আদর্শপাগল। কৃতকর্মের পরে তার মুখে যে প্রসন্ন হাসি ছিল সেটা কোনো স্বাভাবিক মানুষের নয়, সেই রকম একজনের যে মনে করে যে তার জীবন সার্থক হয়েছে, পরম চরিতার্থতা লাভ ঘটে গেছে। প্রসন্নতাটা আত্মপ্রসাদের এবং অবজ্ঞার। প্রভু, তুমি এদের ক্ষমা করে দিয়ো, এরা জানে না আমি কত ভালো একটা কাজ করেছি, না বুঝে আমাকে আটক করেছে, ভাবছে শাস্তি দেবে। লোকটার ভাবটা ছিল এই রকমের। অনেকটা যিশুখ্রিস্টের মতো। তবে নিশ্চয়ই সে যিশু নয়। তার মন্ত্র ভালোবাসার নয়, ঘৃণার। এই যুবক ঘৃণার সন্তান। মৌলবাদ যখন জঙ্গি চেহারা নেয় তখন সেটা কেমন নৃশংস হতে পারে তার প্রমাণ সে দিয়েছে। সে একলা নয়, অনেকেই দিচ্ছে। ওই পথে ঘাতকের সন্ধান যখন-তখন পাওয়া যাবে। পাকিস্তানেও পাওয়া গিয়েছিল, সেখানকার মিসরীয় দূতাবাসে মৌলবাদী জঙ্গিরা বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল। নিহত হয়েছিল ১৬ জন, আহত ৬০। ইসরায়েলি যুবকটি ইহুদি, পাকিস্তানে তৎপর জঙ্গিরা মুসলমান। এক্ষেত্রে ইহুদি-মুসলমানে কোনো ব্যবধান নেই; অন্য বহু ক্ষেত্রে সেটা থাকলেও এবং ইহুদি-মুসলমান পরস্পরের শত্রæ হলেও। হিন্দু মৌলবাদীও কম পারে না, তাদেরই একজন হত্যা করেছিল মহাত্মা গান্ধীকে, একটা প্রার্থনা সভায় গিয়ে। বিজেপির শাসনামলে তো সাম্প্রদায়িকতা তুরুপের তাসে পরিণত সেখানে। এ ধরনের খুনিদের মনস্তত্ত্বে গবেষণার উপাদান আছে। তাদের ব্যক্তিগত ইতিহাস নিশ্চয়ই কৌতূহলোদ্দীপক হবে। তবে সাধারণভাবে বলা খুবই সম্ভব যে, এরা যে জঙ্গি হয় তার কারণ থাকে দুটি- একটি হচ্ছে প্ররোচনা, অপরটি চরিতার্থতা লাভের অত্যুগ্র আকাক্সক্ষা। দুটি আলাদা হয়ে থাকে না, এক হয়ে যায়, এক দেহে লীন। উভয়েরই অংশ একটি অভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের। হিটলারের শাসন গত শতাব্দীর ধ্বংসাত্মক রাজনৈতিক কার্যকলাপের মধ্যে নিকৃষ্টতম, বলা হয় মানব ইতিহাসের সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক কাজ ওই শাসনামলে ঘটেছে। কিন্তু হিটলার তো একা ছিল না, সঙ্গে ছিল অনেকে। হিটলার ইহুদিদের হত্যা করে জার্মানিকে বিশুদ্ধ করবে ভেবেছিল, আর এক তরুণ ইহুদি হিটলারের মতো একই বর্ণবাদী উন্মাদনায় তার নিজের রাষ্ট্রের ইহুদি প্রধানমন্ত্রীকে হত্যা করেছে। হিটলার মনে করত ইহুদিরা পবিত্র জার্মান ভূমিকে অপবিত্র করছে, তাদের নির্বংশ না করা গেলে জার্মানির মুক্তি নেই। গণহত্যার ওই অপরাধীদের আজো যখন ধিক্কার দেয়া হচ্ছে পৃথিবীময়, বৃদ্ধ ও মৃতপ্রায় অবস্থাতেও কাউকে পাওয়া গেলে যখন ধরে এনে বিচার করা হচ্ছে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে, তখন ওই একই অপরাধ করছে এক তরুণ ইহুদি। সেও একজন হিটলার। তারও ওই একই অভিযোগ, ইহুদিদের ঈশ্বর-প্রদত্ত পবিত্র ভূমির অংশ দিয়ে দেয়া হচ্ছে প্যালেস্তাইনীয় আরবদের। এর প্রতিকার করবে সে। প্রতিশোধ নেবে। হিটলারের প্রকৃত জন্মভূমি জার্মানি কিংবা ইসরায়েলে নয়, তার জন্ম একটি মনোভূমিতে। মনোভূমিটা সাংস্কৃতিক। ইগার আমীর কোনো বাউন্ডেলে যুবক নয়, সে শিক্ষিত, সে আইনের ছাত্র। হঠাৎ উন্মাদনায় সে খুনি হয়নি, ধীরে ধীরে প্রস্তুত হয়েছে। স্থির মস্তিষ্কে কাজ করেছে। হিটলারের নাৎসি বাহিনীতে কেবল যে ইহুদি-বিদ্বেষী ও অর্ধোন্মাদেরা ছিল তা নয়, সেখানে অতিশয় সভ্যভব্য, বুদ্ধিমান, সুশিক্ষিত মানুষরাও ছিল। শেষ দিকে ওই একনায়কের ঘনিষ্ঠ সহচরদের মধ্যে ছিলেন আলবার্ট স্পিয়র নামে অতিশয় মার্জিত এক ব্যক্তি। নাৎসি জার্মানির ওপর সবচেয়ে প্রামাণ্য গ্রন্থ লিখেছেন যে- ঐতিহাসিক- হিউ ট্রেভর রূপার- তিনি যাকে বলেছেন, ওই আমলের ‘আসল দুর্বৃত্ত’। এই স্পিয়র নিজে খুনি ছিলেন না। যুদ্ধশেষে তিনি আত্মহত্যা করেননি, ন্যুরেমবার্গ আদালতে যখন তার বিচার হয় তখন বরঞ্চ স্বীকার করেছেন যে, হ্যাঁ, তিনি অপরাধী। বিচারে তার কারাদণ্ড হয়েছিল। স্পিয়র ১৯৮১-তে মারা গেছেন। কারাগারে বন্দি অবস্থায় তিনি ডায়েরি লিখে গেছেন, সে-ডায়েরি প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বলেছেন নাৎসি বাহিনীতে যোগদানের পেছনে একটা স্বপ্ন ছিল তার। বার্লিনকে তিনি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শহর এবং ‘সারা বিশ্বের রাজধানী’ হিসেবে গড়ে তুলবেন এটাই ছিল সেই স্বপ্ন। তার পারিবারিক ইতিহাস অনুসন্ধানে জানা গেছে যে, স্পিয়র বড় হয়েছে মধ্যবিত্ত পরিবারে, সেই পরিবারে অভাব ছিল ভালোবাসার। হিটলারের মধ্যে তরুণ বয়সে তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন একজন পিতাকে। নিজের পরিবারে তিনি পিতার ভালোবাসা পাননি। রাজনীতিতে এসে সেই ভালোবাসা পেলেন এমন একজন মানুষের ভেতর যে-ব্যক্তি আসলে একজন নরঘাতক। স্পিয়র একা নয়, হাজার হাজার যুবক তখন জার্মানিতে বিদ্যমান হতাশা থেকে মুক্তির উপায় খুঁজছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর জার্মানির ওপর দিয়ে হতাশায় তীব্র শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে থাকে। একদিকে অর্থনৈতিক সংকট অন্যদিকে জাতিগত অসম্মান বড়ই পীড়িত করেছে বিশেষভাবে তরুণদের। তারা দেখছিল বেকারত্বের আশঙ্কা বাড়ছে, দেখছিল ভার্সাই চুক্তি জার্মানিকে নানাভাবে অপমানিত করেছে। পিতৃভূমির এলাকা গেছে ছোট হয়ে, তাকে মানতে হয়েছে পরাজিতের নানা শর্ত। তরুণের পক্ষে মেনে নেয়া কঠিন ছিল এই অবস্থা। সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল জার্মানিতে। কিন্তু সমাজতন্ত্র তো জাতিগত অপমানের প্রতিষেধক নয়। সমাজতন্ত্র মানুষে মানুষে সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়; সে তো বলে না জার্মানরাই সেরা, পৃথিবীতে তারা অদ্বিতীয়। হিটলারের ডাকটাই উন্মাদ করল তরুণদের। হিটলার বললেন, তিনি শোধ নেবেন জাতিগত অপমানের, জয় করবেন সারা বিশ্ব। তরুণ দেখল চরিতার্থতা লাভের সুযোগ তার সামনে উন্মুক্ত। সে প্ররোচিত হলো প্রচারের দ্বারা এবং অন্যের দৃষ্টান্ত অবলোকনে। ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে গিয়ে যোগ দিল নাৎসি বাহিনীতে। একইভাবে প্ররোচিত হয়েছে রাবিন-হত্যাকারী। ইসরায়েল জার্মানির প্রতিবেশী নয়। সময়ের ব্যবধান, ব্যবধান স্থানের। সর্বোপরি বর্ণের। কিন্তু ওই ঘাতক যুবক তো নাৎসি বাহিনীরই সদস্য একজন, যে নাৎসিরা একদিন তার আগের প্রজন্মের ইহুদিদের হত্যা করেছে। বর্ণের যে পবিত্রতার ধারণার ওপর হিটলার তার জার্মানিকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন, ইসরায়েল নামের রাষ্ট্রটি তো সেই বর্ণবাদের ওপরই প্রতিষ্ঠিত। হিটলারের প্ররোচনা সভ্যভব্য জার্মান তরুণদের ঘাতকে পরিণত করেছিল, ইসরায়েলের বর্ণবাদও সেই একই প্ররোচনা দিচ্ছে। ঘাতক যুবক নিজে বর্ণবাদ সৃষ্টি করেনি। সে তার রাষ্ট্রের অন্তর্গত বর্ণবাদকে চরম উৎকর্ষের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে, সে একটি আদর্শের অগ্রবাহিনীর সদস্য। ইসরায়েল একটি আধুনিক রাষ্ট্র। তার উন্নতি ঈর্ষণীয়, সেখানে বহুদলীয় রাজনৈতিক প্রথা বিদ্যমান, এমনকি কমিউনিস্ট পার্টিও পেয়েছে কাজ করার স্বাধীনতা, যে রকম সহনশীলতা তার আশপাশের কোনো আরব রাষ্ট্রে নেই। কিন্তু রাষ্ট্রের অন্তরে তো আছে একটি বর্ণবিদ্বেষ, আছে এই ধারণাও যে তারাই জগতের শ্রেষ্ঠ। সেই বিদ্বেষ ও ধারণাকে যদি তার নির্গলিতার্থে দেখা যায় তবে যে চেহারাটা ফুটে ওঠে সেটা ওই ইগার আমীরের, ওই যুবকের, যে তার রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীকেও হত্যা করেছে, এই অপরাধে অভিযুক্ত করে যে ইসরায়েলকে সে অপমান করেছে। শান্তিচুক্তি করেছে প্যালেস্তাইনিদের সঙ্গে এবং পবিত্র ভূমি দিয়ে দিয়েছে ওই শত্রæদের। সভ্য মানুষ মানেই সভ্য নয়। তার অন্তরে থাকে আদিম পশু; কেবল যে ব্যক্তিগত পর্যায়ে তা নয়, সমষ্টিগত পর্যায়েও, সমষ্টিগত পর্যায়েই সে অধিক মারাত্মক। বর্ণবাদ আবার ফিরে এসেছে ইউরোপে। নব্য নাৎসিরা জার্মানিতে, ইতালিতে, এমনকি ইংল্যান্ডেও মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে, আমাদের দেশের উগ্রবাদী ধর্মান্ধদের মতো। নব্য নাৎসিরা বিদেশিদের ওপর যখন-তখন আক্রমণ করছে। গণতন্ত্রের পীঠস্থান আমেরিকাতে, যেখানে সবাই আসলে বিদেশি, সেখানেও নবাগতদের তাড়িয়ে দেয়ার আয়োজন চলছে। চলছে কালোর ওপর সাদার নির্যাতন। তাদের টেলিভিশনেই শোনা যাচ্ছে সেসব খবর। একজন কালো পুরুষকে সাদা সাজিয়ে পাঠানো হয়েছিল রাস্তায়, দোকানে, বিশ্ববিদ্যালয়ে। সে মানুষটি দেখেছে যেন সে নতুন জীবন লাভ করেছে। এমন উষ্ণ আচরণ পাচ্ছে, যা জীবনে কখনো পায়নি। আবার যখন গেছে সে কৃষ্ণ পরিচয়ে তখন এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষ্ণবর্ণ দারোয়ানটি পর্যন্ত বিতৃষ্ণাভরে তাকিয়েছে তার দিকে, সাদা মনে করে আগেরবার যে তার সঙ্গে সম্ভ্রম দেখিয়ে কথা বলেছিল। হার্ভার্ড থেকে ল’ ডিগ্রি নিয়ে কৃষ্ণবর্ণের এক যুবক দেখে মক্কেল পায় না, এমনকি কৃষ্ণবর্ণের মক্কেলও তার কাছে আসে না। একজন পরামর্শ দিল শহরের বাইরে কান্ট্রি ক্লাবে ওয়েটারের চাকরি নাও, ভালো ভালো সম্ভাব্য মক্কেলের সঙ্গে পরিচয় হবে, পরে তাদের নিজের পরিচয় দিয়ে আকর্ষণ করতে পারবে। আকর্ষণ করবে কি, দেখে যে সে ঢুকতেই পারে না। টেলিফোনে গলা শুনে কালো বলে তাকে চিনতে পারে না। ম্যানেজার বলে হ্যাঁ, হ্যাঁ এসো, আমাদের ক্লাবে লোক লাগবে বৈকি। গিয়ে হাজির হলে আমতা আমতা করে। বলে তুমিই কি ফোনে কথা বলেছিলে? দুঃখিত, অন্যকে চাকরিটা দিয়ে ফেলেছি। হার্ভার্ডের ল’ গ্র্যাজুয়েট, কর্মঠ যুবক, ওয়েটারের চাকরি পাচ্ছে না। একজন ম্যানেজার বলল, বাসের কন্ডাক্টর হও। অন্তর্নিহিত দর্শনটা এই যে, বাসে নানা বর্ণের লোকের যাতায়াত, সেখানে ক্ষণস্থায়ী সম্পর্ক, ওখানে মানাবে তোমাকে, আমাদের এখানে তোমাকে নিয়ে উল্টো আমরা গ্রাহক হারাব। কেউ বলল, পাকের ঘরে ধোয়ামোছার কাজ দিতে পারি, টেবিল পরিষ্কার করবে সেও হতে পারে, কিন্তু খাবার হাতে নিয়ে গিয়ে হাজির হলে গ্রাহকদের খাবার রুচি বিনষ্ট হয়ে যেতে পারে। ভিরমি খাওয়াও বিচিত্র নয়। একজন শ্বেতাঙ্গ মহিলা কালো সেজে কয়েকজন কৃষ্ণাঙ্গ মহিলার সঙ্গে গির্জায় গিয়েছিলেন। তিনি আশা করেছিলেন পুরোহিত বলবেন, নতুন বন্ধুদের স্বাগত জানাই। পুরোহিত উল্টো বললেন, বন্ধুগণ, আমাদের সব পরিস্থিতির জন্যই প্রস্তুত থাকতে হবে। এই ঘটনা বর্ণবিদ্বিষ্ট বলে পরিচিত কোনো এলাকায় ঘটেনি, ঘটেছে রাজনীতির জন্য প্রসিদ্ধ কানেকটিকাতে। পুঁজিবাদী দেশে বর্ণবাদ অবলুপ্ত হওয়ার কথা। কেননা সেসব দেশ গণতন্ত্রী, অর্থাৎ সহনশীল; সেখানে মানুষ টাকা চেনে, বর্ণ দেখে না। কিন্তু আমেরিকার বর্ণবাদের তৎপরতা বিষয়ে কোনো আমেরিকানেরই সন্দেহ থাকার উপায় নেই। ওয়াশিংটনে ১০ লাখ কৃষ্ণকায় মানুষের শোভাযাত্রা এমনি এমনি সংঘটিত হয় না। বর্ণবাদও এক ধরনের আদর্শ। এও মৌলবাদ বটে। যখন উগ্র হয় তখন সে জঙ্গিরূপ ধারণ করে এবং ঘাতকের চরিত্র নিয়ে শত্রæ নিধনে বের হয়। ধর্মীয় মৌলবাদকে নানাভাবে উৎসাহিত করা হচ্ছে। ভারতে হিন্দু মৌলবাদীরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পর কখনো দেবতাকে দুধ খাওয়ায়, কখনো মসজিদ ভেঙে মন্দির গড়ে অহিন্দুদের ভারত-ছাড়া করতে একের পর এক আইনি তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। গো-মাংস ভক্ষণের অজুহাতে মানুষ হত্যা এবং দলিত নারীদের দৈহিক নির্যাতন তো নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে বিজেপি শাসনাধীন ভারতে। আলজেরিয়াতে মুসলিম মৌলবাদীরা মানুষ খুন করছে। মিসরেও তাই। রাষ্ট্র তাদেরকে উৎসাহিত করছে না। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যারা আছেন তারা ঘোরতর বিরোধী এই মৌলবাদীদের। কিন্তু ক্ষমতাসীনরা মৌলবাদীদের যে সাংস্কৃতিক মনোভূমি সেটিকে নষ্ট করতে পারছে না; সেখানেই তাদের ব্যর্থতা; এবং সেই ব্যর্থতার সুযোগেই মৌলবাদের জঙ্গিরূপ ধারণ। আলজেরিয়াতে শাসক শ্রেণি বিলাসী জীবনযাপনে অভ্যস্ত, তারা চালচলনে বলতে গেলে ইউরোপীয়। বঞ্চিত মানুষ এদের ঘৃণা করে। সেই ঘৃণাই ঠেলে দেয় তাদের ইউরোপীয় জীবনযাপনের বিপরীত দিকে, ধর্মীয় মৌলবাদের অভিমুখে। তাদের একাংশ জঙ্গি হয়ে ওঠে। মনে করে ওই পথেই রয়েছে চরিতার্থতা। পরকালে তারা চিরস্থায়ী সুখ পাবে, ইহকালে যদি ধর্মের জন্য প্রাণ দেয়। ইহুদি যুবক ইগার আমীর মনে করেছে মানুষ হত্যা করে সে ঈশ্বরের প্রেম লাভ করবে, মুসলিম মৌলবাদীরাও তেমনি মনে করে। ঈশ্বরের ধারণাটা স্বতন্ত্র হতে পারে, কিন্তু চরিতার্থতা লাভের স্বপ্নটা একই। মিসরেও দরিদ্র মানুষ প্রচুর। তারা মনে করে ধনীরা পাপী। দরিদ্ররা পাপের পথ পরিহার করে যেতে চায় মৌলবাদের পবিত্র পথে। পাকিস্তানও বিপদে পড়েছে মৌলবাদীদের নিয়ে। ওই রাষ্ট্রের ভিতটাই মৌলবাদী। একাত্তরে তারা হত্যা করেছে বাঙালিদের, কাফের মনে করে। জেনারেল জিয়াউল হক ভুট্টোকে ফাঁসি দিয়ে পবিত্র পাকিস্তানকে আরো পবিত্র করেছিল। আফগানিস্তনে কমিউনিস্ট শাসনের অবসান ঘটিয়ে সেখানে মুসলিম মৌলবাদীদের প্রতিষ্ঠিত করার কাজে মুজাহিদদের আশ্রয়ভূমি হিসেবে পাকিস্তান কাজ করেছে সানন্দে। এজন্য টাকাও পেয়েছে প্রচুর- আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে। মিসরীয় দূতাবাসে বোমা বিস্ফোরণে আতঙ্কের কারণ সৃষ্টি হয়েছিল, এ রকম ঘটনা আরো ঘটবে আশঙ্কায়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চোখ রগড়ে বলছে ইসলামাবাদে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় নামে যে প্রতিষ্ঠানটি আছে সেটি আসলে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই নয়; দেশি-বিদেশি মৌলবাদী জঙ্গিদের লালনভূমি বটে। পাকিস্তানের মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষা পেয়ে সুযোগ্য আফগান তালেবানরা যেভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নিল তাতে কর্তৃপক্ষ এখন মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার দিকেই সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। বাধ্য হয়ে। বাংলাদেশেও মৌলবাদীরা তৎপর ছিল একাত্তরে, ওই পাকিস্তানিদের ছত্রছায়ায়। আবারো তারা জঙ্গি তৎপরতা চালিয়েছিল। এখানেও হেফাজতিদের কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাকে অধিক উৎসাহ দেয়া হচ্ছে। তবে আমাদের শাসকশ্রেণি এদের বিপদ মনে করে না; শাসক শ্রেণি হয়তো ভাবে যে, তাদের ভবিষ্যৎ এদেশে নেই, রয়েছে বিদেশে। কিন্তু দেশবাসী তো আছে, তাদের তো ভাবতে হবে। তারা একাত্তরে একবার যা দেখেছে, আরেকবার তা দেখতে চায় না। মৌলবাদীদের প্রশ্রয় দিচ্ছে। এদেশে রাষ্ট্রধর্ম প্রবর্তন করেছে সামরিক শাসক এরশাদ। বর্তমান সরকার রাষ্ট্রধর্মকে সাংবিধানিক বৈধতা দিয়েছে। মৌলবাদীদের নিয়ন্ত্রণে বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর ভরসা করা সঙ্গত হবে না; এরা একে কোনো সমস্যাই মনে করে না, বরঞ্চ প্রশ্রয় দেয়। আসলে এরা একই প্রভুর ভৃত্য, যে প্রভুর নাম পুঁজিবাদ। এদের শাসনে দেশে যে হতাশা সৃষ্টি হচ্ছে ও হতে থাকবে সেই মনোভূমিতে সন্ত্রাসের জন্ম যেমন সহজ, জঙ্গি মৌলবাদের জন্মও তেমনি কঠিন নয়। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App