×

জাতীয়

বাস মালিক-শ্রমিকরা বেপরোয়া

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ নভেম্বর ২০২১, ০৮:৫৭ এএম

বাস মালিক-শ্রমিকরা বেপরোয়া

ফাইল ফটো

* এখনো অতিরিক্ত ভাড়া আদায়

* গেটলক-সিটিং সার্ভিস বহাল

*বিআরটিএর তৎপরতা লোক দেখানো

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর সারাদেশে গণপরিবহনে আবারো নৈরাজ্য শুরু হয়েছে। একদিকে সরকারের প্রতিষ্ঠান বিআরটিএ মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে লোক দেখানো অভিযান চালাচ্ছে। অন্যদিকে যাত্রীদের কাছ থেকে বাড়তি ভাড়া আদায় অব্যাহত রয়েছে। তথাকথিত ‘সিটিং সার্ভিস’ ও ‘গেটলক সার্ভিস’ বন্ধের ঘোষণা দিয়েও আবার তা বহাল রাখার জন্য অঘোষিত ধর্মঘট পালন করছে মালিক-শ্রমিকরা। বাস ভাড়া নিয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের নির্দেশনাও এখন উপেক্ষিত।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাস ভাড়া বাড়ানোর প্রায় দুই সপ্তাহ পরও সড়কে ভাড়া নিয়ে নৈরাজ্য থামছে না। প্রতিদিন পরিবহনকর্মী ও যাত্রীদের মধ্যে ঝগড়া লেগেই আছে। করোনার বিপর্যয়ের পর জ্বালানি তেলের অযৌক্তিক দাম বাড়ানোয় বাস ভাড়া নতুন উপদ্রব হিসেবে দেখা দিয়েছে। সরকারের এই সিদ্ধান্তে সারাদেশে সব মহলে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। সরকারের নির্ধারিত ভাড়া পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা মানছে না। দেশের সাধারণ মানুষ মালিক-শ্রমিকদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। ৫ টাকার ভাড়া এখন ১০ থেকে ১৫ টাকায় দাঁড়িয়েছে। বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ ভাড়া নিয়ে নৈরাজ্য বন্ধে মোবাইল কোর্ট চালালেও তার দৃশ্যমান প্রতিফলন এখনো পরিবহন সেক্টরে পড়েনি।

বাস ভাড়ার নৈরাজ্য থামাতে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি বেশ কিছু সুপারিশ দিয়েছে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত যাত্রীবান্ধব জোরাল পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এখনো বাসচালক ও তার সহযোগীদের সঙ্গে মারামারি হচ্ছে। গত মঙ্গলবার মিরপুরে মারধরের ঘটনার পর মালিক-শ্রমিকরা বাস ধর্মঘট করে। এতে মিরপুর থেকে বেশ কিছু রুটের বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। চরম ভোগান্তিতে পড়েন যাত্রীরা। মালিকরা একদিকে তথাকথিত ‘সিটিং সার্ভিস’ ও ‘গেটলক সার্ভিস’ বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে; আবার অন্যদিকে মালিকদেরই একটি অংশ আবার এসব অবৈধ সার্ভিস বহাল রাখার জন্য ধর্মঘট করছে। কম স্টপেজ ও সিটিং সার্ভিসের নামে অতিরিক্ত ভাড়া নেয়া হচ্ছে। আবার সিটিং সার্ভিসের নামে চেকারকে বকশিশ দিয়ে দাঁড়িয়ে যাত্রী নেয়া হচ্ছে। মিরপুর থেকে গুলিস্তান ও আজিমপুরগামী বিহঙ্গ, বিকল্প, সেফটি, শিখর পরিবহনে সিটিং সার্ভিস বলা হলেও এখনো দাঁড় করিয়েও যাত্রী নেয়া হচ্ছে। সিটিং সার্ভিস বন্ধ হয়নি। গাজীপুরগামী তুরাগ পরিবহনের বেশিরভাগ বাসেই সিটিং সার্ভিস লেখা রয়েছে। বিআরটিএ নির্ধারিত ভাড়ার চার্ট একেবারেই মানা হচ্ছে না। ‘ডিজিলচালিত’ ও ‘সিএনজিচালিত’ বাসে লাগানো স্টিকার এখন অনেক কমে গেছে, ভাড়ার চার্টও অর্ধেক ছিঁড়ে গেছে। রজনীগন্ধা, মিডওয়ে, পরিস্তান, বসুমতি, ভূঁইয়া পরিবহনসহ অনেক বাসে এখনো ‘ওয়েবিল’ প্রতারণা বহাল রয়েছে।

ঢাকা কলেজের ছাত্ররা গতকাল বৃহস্পতিবারও বাস ভাড়া নিয়ে প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ মিছিল করেছে। তারা ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার এবং শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়ার ব্যবস্থা নিতে সরকারের কাছে আহ্বান জানিয়েছে। ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী রাশেদুজ্জামান জানান, ছাত্ররা নিয়ম অনুযায়ী হাফ ভাড়া পায়। কিন্তু বাসগুলো এখন আর হাফ ভাড়া নিতে চায় না। আগে থেকেই তারা ভাড়া বেশি নিত, এখন আরো বেশি নিচ্ছে।

কনজ্যুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেন, একদিকে জ¦ালানি তেলের দাম বাড়ানো একেবারেই অযৌক্তিক। এই মুহূর্তে বিশ্ববাজারে যে হারে জ¦ালানি তেলের দাম বেড়েছে, তাতে বাংলাদেশে দাম বাড়ানোর কোনো প্রয়োজনই ছিল না। সরকার নিজেদের ইচ্ছেমতো দাম বাড়িয়েছে, কারো সঙ্গে কোনো আলোচনা করেনি। আমরা জ্বালানি তেলের দাম প্রত্যাহারের জন্য সরকারের কাছে আহ্বান জানিয়েছি। সরকার এই বিষয়ে পদক্ষেপ না নিলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার কথা ভাবছি আমরা।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, সরকারের নীতিনির্ধারকদের মধ্য থেকেই জ্বালানি ও পরিবহন সেক্টরে নৈরাজ্য শুরু হয়েছে। শুধু ডিজেলের শুল্ক প্রত্যাহার করা হলেই তেলের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হতো না। ডিজেলের দাম প্রত্যাহার করতে হবে। পাবলিক ট্রান্সপোর্ট সেক্টরের পুনর্বিন্যাস করতে হবে। পাবলিক বাসের কোনো উন্নয়ন নেই। সরকার এখানেও মালিকদের স্বার্থকেই বেশি প্রাধান্য দেয়।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, পরিবহন মালিক-শ্রমিক ও সরকার মিলেমিশে বাসভাড়া বাড়িয়েছে। সুকৌশলে তারা যাত্রীদের পকেট কাটছে। সিটিং সার্ভিস, গেটলক সার্ভিস ও ওয়েবিলের নামে ভাড়া ডাকাতি করছে। বাস চলাচল বন্ধ করে অঘোষিত ধর্মঘট করছে। পরিবহন মালিক সমিতির নেতারা কথিত সিটিং সার্ভিস নিয়ে ইঁদুর-বিড়াল খেলা খেলছে। অবিলম্বে একচেটিয়াভাবে ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হবে। যাত্রী প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি ন্যায় ও গ্রহণযোগ্য ভাড়া নির্ধারণ করতে হবে। অযৌক্তিক অজুহাত দেখিয়ে গণপরিবহন চলাচল বন্ধ রেখে যাত্রীদের জিম্মি করছে। এ ব্যাপারে সরকার কঠোর কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। তারা যাত্রীদের অপমান অপদস্থ করছে।

বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, জ্বালানির দাম বাড়িয়ে সরকার জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। রাষ্ট্রের স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা না করেই মধ্য রাতে জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে দেয়া জনগণের সঙ্গে বড় ধরনের প্রতারণা। এই সেক্টরে সরকার ও পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের সুবিধা নিয়ে কাজ করছে। মানুষের অধিকার নিয়ে তাদের কোনো ভাবনা নেই। এটা বড় ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন।

এদিকে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের অঘোষিত ধর্মঘট প্রসঙ্গে সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, মালিক সমিতি থেকে সংবাদ সম্মেলন করে আমরা ‘সিটিং সার্ভিস’ ও ‘গেটলক সার্ভিস’ বন্ধের ঘোষণা দিয়েছি। কিন্তু কিছু মালিক-শ্রমিক আমাদের নির্দেশনা মানতে চাচ্ছে না। তারাই অঘোষিত ধর্মঘট করছে। আমরা এই বিষয়ে কিছুই জানি না। তবে এদের সংখ্যা খুবই কম। মালিক-শ্রমিকদের বৃহৎ অংশই নতুন ভাড়ার তালিক দেখে ভাড়া আদায় করছে। যারা আমাদের সহযোগিতা করবে না, তাদের আমরা চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বিআরটিএ এর কাছে সুপারিশ করব। ধীরে ধীরে সড়কে সব সমস্যার সমাধান হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App