×

মুক্তচিন্তা

ইউপি নির্বাচন : আওয়ামী লীগ কী নীতি-কৌশল পুনর্মূল্যায়ন করে দেখবে?

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৭ নভেম্বর ২০২১, ০১:২৬ এএম

স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় নির্বাচন হচ্ছে ইউনিয়ন কাউন্সিল নির্বাচন। নির্বাচনটি দেশব্যাপী একদিনে অনুষ্ঠিত করা সম্ভব নয়। সে কারণে নির্বাচন কমিশন ৩-৪ ধাপে এই নির্বাচন সম্পন্ন করে থাকে। এবারের নির্বাচনের দুটি ধাপ এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। আগামী ২৮ নভেম্বর তৃতীয় ধাপে ১ হাজার ৭টি ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তাতেও নির্বাচন শেষ হবে না। প্রয়োজন দেখা দিয়েছে চতুর্থ ধাপের। সেটি অনুষ্ঠিত হবে ডিসেম্বর মাসের ২৩ তারিখ। সেদিন ৮৪০টি ইউপির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। এরই মধ্যে প্রথম ধাপে ২০৪ এবং দ্বিতীয় ধাপে ৮৪৮টি নিয়ে মোট ১ হাজার ৫২টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে এবারের নির্বাচনের অভিজ্ঞতা কোনো পক্ষের জন্যই মনে হয় সুখকর নয়। নির্বাচনে ব্যাপক মানুষ ভোট প্রদান করলেও সবকিছু মøান করে দিয়েছে সহিংসতা, দ্ব›দ্ব, সংঘাত, মারামারি, হানাহানির ঘটনা। এতে প্রাণহানি ঘটেছে মোট ৩০ জনের, আহত হয়েছেন শত শত। নির্বাচনের আগে প্রার্থীদের সমর্থকদের মধ্যে দেশীয় এবং আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের মাত্রা অতীতের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। সে কারণে বাকি দুই ধাপের নির্বাচন নিয়ে এখনই দ্ব›দ্ব, সংঘাত, হানাহানির আশঙ্কা সবার মধ্যে বৃদ্ধি পেয়েছে। দ্বিতীয় পর্বে হতাহতের শঙ্কা, সংঘাত, সহিংসতা এবং ক্ষমতার দ্ব›েদ্বর তীব্রতা সব মহলকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পরিবেশকে কতটা সংঘাতপূর্ণ করে তুলেছে সেটি নিয়ে গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। গণমাধ্যমে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোর নানা বিষয় আলোচনায় আসছে। এই নির্বাচনে বিএনপি দলীয়ভাবে অংশগ্রহণ করেনি। তবে সীমিতসংখ্যক ইউনিয়ন কাউন্সিলে চেয়ারম্যান ও সদস্যপদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করেছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আওয়ামী লীগের মনোনীত এবং বিদ্রোহী প্রার্থীদের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ফলে দ্ব›দ্ব, সংঘাত, হানাহানি হয়েছে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের মধ্যেই। এ কারণে ইউপি নির্বাচনে হতাহত ও সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা যেসব কেন্দ্রে ঘটেছে তার সঙ্গে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের নাম উচ্চারিত হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ গণমাধ্যমে যেসব বক্তব্য দিয়েছেন তা নির্বাচনে যারা আওয়ামী লীগের মনোনীত বা বিদ্রোহী কিংবা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আছেন তাদের কাউকে এসব শৃঙ্খলাবিরোধী কাজ থেকে খুব একটা নিবৃত্ত করতে পারেনি। সংঘাত-সংঘর্ষ তাই এড়ানো যায়নি। সে কারণে ইউপি নির্বাচনের এবারের পরিবেশ নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের বক্তব্যের মধ্যেও হতাশার সুর শোনা গেছে। এরই মধ্যে তৃতীয় ধাপের নির্বাচনে ফরম সংগ্রহের ক্ষেত্রে আগের নীতি-কৌশলে পরিবর্তন ঘটানোর প্রমাণ গণমাধ্যমে উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে, সামনের দুই পর্বের নির্বাচনে আগের মতো দলীয় মনোনয়ন নাও থাকতে পারে, প্রতিদ্ব›িদ্বতা যে কেউ করতে পারবেন। এ ধরনের পরিবর্তন নির্বাচনের মধ্য অবস্থায় এসে যদি ঘটানো হয়ে থাকে তাহলে আগে করা হলো না কেন- এই প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই করা যায়। প্রতিদ্ব›িদ্বতা সবার মধ্যে উন্মুক্ত করেই দিলেই যে ইউপি নির্বাচনে সংঘাত, হানাহানি থাকবে না এমন নিশ্চয়তা কতটা ঘটবে তা দেখার জন্য ২৮ নভেম্বর ও ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। যদি আগামী দুই পর্বের নির্বাচন উন্মুক্ত প্রতিদ্ব›িদ্বতার কারণে হানাহানিমুক্ত হয় তাহলে বিষয়গুলো একভাবে ভাববার রয়েছে। আবার যদি সংঘাত এড়ানো বা রোধ করা সম্ভব না হয় তাহলে বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করা দরকার বলে মনে হচ্ছে। বলা হয়ে থাকে যে, ইউপি নির্বাচনের চেয়ারম্যান পদে দলের প্রতীক প্রদানের ফলে এই নির্বাচনের আমেজ অনেকটা হারিয়ে গেছে। আগে ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বার পদে যারা প্রতিদ্ব›িদ্বতা করতেন তারা স্থানীয়ভাবে পরিচিত এবং জনগণের কাছে শ্রদ্ধেয় ছিলেন বলেও কেউ কেউ দাবি করে থাকেন। এটি একটি আপেক্ষিক বক্তব্য। কেননা স্থানীয় সরকার এবং গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থা স্বাধীনতার এই ৫০ বছরে অনেকটাই বদলে গেছে। গ্রামে প্রভাব-প্রতিপত্তি ও শাসন আগের মনোবৃত্তিতে নেই। একসময় হয়তো সেবা ও জনহিতকর কাজ করার জন্যই কেউ কেউ বারবার ইউনিয়ন কাউন্সিলর, চেয়ারম্যান নির্বাচিত হতেন। কিন্তু সেই যুগে ইউনিয়ন কাউন্সিলের জনহিতকর কাজের পরিধিও খুব বেশি ছিল এমনটি বলার মতো নয়। কটা রাস্তা বা পুল একটি ইউনিয়নে ৫ বছরে হতো সেই প্রশ্ন করা হলে মনে হয় মাথার চুলে হাত দিয়ে স্মরণ করতে হবে যে তখন ওই প্রতিষ্ঠানের একজন চেয়ারম্যান ৫ বছরে কী করতে পেরেছিলেন। এখন তো সেই যুগ নেই। সুতরাং আগের ইউপির উন্নয়ন গতি এবং বর্তমান ইউপির কর্মকাণ্ডের গতিধারার মধ্যে এখন ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। গ্রামীণ সমাজেরও বিরাট পরিবর্তন এসেছে। ফলে আগের অবস্থা দিয়ে বর্তমান এবং ইউনিয়ন কাউন্সিলকে দেখা বা বোঝা বোধহয় যথাযথ হবে না। গ্রামীণ সমাজ ও মানসিকতার যে পরিবর্তন তাতে নীতি-নৈতিকতা, আদর্শ, রাজনীতি ইত্যাদি ব্যাপকভাবে মিশ্রিত হয়ে গেছে। এখন রাস্তাঘাট, পুল-কালভার্ট, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মানুষের জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন, এনআইডি, সরকারি নানা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, বয়স্ক, বিধবা ভাতা, কাবিখা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা ইত্যাদি নানা ধরনের অর্থ-সংশ্লিষ্ট কাজ এই সংস্থার মাধ্যমে হয়ে থাকে। সুতরাং এখন যদি আমরা ৬০-৭০ বা ১০০ বছর আগের ইউনিয়ন কাউন্সিল এবং সেই সময়কার চেয়ারম্যান-মেম্বারদের জনদরদি ভাবনা দিয়ে বোঝার চেষ্টা করি তাহলে নস্টালজিয়ার বেশি কিছু দিতে পারবে না। অথচ সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রতিষ্ঠানকে যুগোপযোগী করার জন্য যে মানের জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার আইন ও বিধান থাকা প্রয়োজন ছিল তার বিষয়ে আমাদের কি কোনো ভাবনা-চিন্তা কখনো পরিলক্ষিত হয়েছে? রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এই ধরনের প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান-মেম্বার হওয়ার জন্য শিক্ষাগত যোগতা, রাজনৈতিক দীক্ষা, ব্যক্তিগত সততা, যোগ্যতা ইত্যাদি বিবেচনার যে অপরিহার্যতা দাবি করে সেটি কি দলগুলো বিবেচনায় নিয়েছে? অবশ্য শুধু ইউনিয়ন কাউন্সিল কেন, এর উপরের জনপ্রতিনিধি হওয়ার সংস্থাগুলোতেও এখন যাদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে কিংবা যারা নির্বাচিত হয়ে আছেন তাদেরই বা শিক্ষাগত যোগ্যতা, রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত সততা, যোগ্যতা, দক্ষতা ইত্যাদি কতটা মনোনয়ন ও ভোটের জন্য বিবেচিত হয়ে থাকে সেটিও একটি মস্ত বড় প্রশ্ন। সর্বত্রই শিক্ষা, যোগ্যতা, সততা, দক্ষতার বিষয়গুলো উপেক্ষিত থাকছে, প্রাধান্য পাচ্ছে অর্থবিত্ত, সমর্থকগোষ্ঠী এবং প্রভাব-প্রতিপত্তিতে। এটি ইউনিয়ন কাউন্সিলর একজন মেম্বার পদ থেকে মহান জাতীয় সংসদ পর্যন্ত সব স্তরের জনপ্রতিনিধির সংস্থার ব্যাপারেও ঘটছে। ইউনিয়ন কাউন্সিলের নির্বাচনে দলীয় প্রতীক বরাদ্দ দেয়ার ব্যবস্থা না করাই ভালো ছিল। কিন্তু না দিলেও বা খুব বেশি হেরফের হতো এমনটি নিশ্চিত করে বলা যায় কিনা জানি না। তাতে চেয়ারম্যান পদ ও দলের একজনকে মনোনয়ন প্রদানের বিষয়টি এবার কাজে লাগেনি এই কারণেই যে, অন্যতম প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এই নির্বাচনে অংশ নেয়নি। সুতরাং আওয়ামী লীগ এমন অবস্থায় একজনকে মনোনয়ন দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ায় চেয়ারম্যান পদে বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় নির্বাচিত হওয়ার একচেটিয়া সুবিধা সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে দলীয় মনোনয়ন পেতে অনেকেই মরিয়া হয়ে উঠেছিল। এই মরিয়া হওয়াটি দলের অন্যদের ক্ষেত্রেও তদবিরের প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করেছে। সেখানে মন্ত্রী-এমপিদের পছন্দ-অপছন্দের সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের পছন্দ-অপছন্দের দ্ব›দ্ব ঘটেছে। ফলে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে অনেকেই দাঁড়িয়েছেন। বিপুলসংখ্যক বিদ্রোহী প্রার্থী জয়লাভও করেছেন। এই জয়ের পেছনে প্রভাব-প্রতিপত্তি, অর্থবিত্ত, গ্রুপিং ইত্যাদি যেমন কাজ করেছে, নেপথ্যের কোনো কলকাঠিও কেউ কেউ নেড়ে থাকতে পারেন। খোঁজ নিলে দেখা যাবে ত্যাগী অনেকেই মেম্বার পদেও দলের সমর্থন খুব একটা পাননি। তাছাড়া এক যুগ ধরে ক্ষমতায় থাকার কারণে আওয়ামী লীগের তৃণমূলে এখন পদ-পদবি নিয়ে আদর্শের চেয়েও প্রভাবশালী ও বিত্তশালীদের প্রতি আনুগত্যের বিষয়টি অধিকতর গুরুত্ব পেয়ে বসেছে। অনেকের মধ্যে এখন উচ্চাকাক্সক্ষাও বেড়ে গেছে। দল তাদের কাছে একটি সাইনবোর্ড, আদর্শ নয়, শৃঙ্খলা মেনে চলাও নয়। যোগ্যদের মূল্যায়ন করাও এখন তৃণমূল থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। ফলে দলের তৃণমূল পর্যায়ে যারা নিজেদের পরিচিত করছে তাদের বেশিরভাগেরই ভাবমূর্তি লোকালয়ে খুব বেশি নেই। কিন্তু তারা ভাবমূর্তিসম্পন্ন কাউকে দলীয় কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়ার সুযোগ দিতেও রাজি নয়। এর ফলে আওয়ামী লীগের তৃণমূলে এখন মেধাবী, যোগ্য, প্রতিশ্রæতিশীল, আদর্শবান, সুশিক্ষিত তরুণদের খুব বেশি সংযোজন ঘটছে না। দলে এখন সংখ্যায় অনেককে দেখলেও যোগ্যতায় প্রতিযোগিতা করার ক্ষেত্রে বিরাট শূন্যতা বিরাজ করছে। রাজনীতির এই নীতিহীনতা, আদর্শহীনতা, বিত্তবৈভবের প্রতি লোভ-লালসা, ক্ষমতাকেন্দ্রিক দ্ব›দ্বকে হানাহানি-মারামারিতে টেনে নিয়ে যায়। সেটি ঘটতে দেখা গেছে এবারের ইউপি নির্বাচনের দ্বিতীয় পর্বে। এখনই যদি এটির রাশ টেনে না ধরা হয়, মেধাবী, যোগ্য, শিক্ষিত এবং দলীয় আদর্শের প্রতি নিষ্ঠাবানদের তুলে আনার ব্যবস্থা না করা হয় তাহলে দলের ভবিষ্যৎই শুধু নয়, জাতির অস্তিত্বও সংকটের মুখে পড়তে পারে। যেসব নেতা এরই মধ্যে আদর্শের প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হয়েছেন তাদের বোধহয় গুডবাই বলার দিন এসে গেছে। অন্যদিকে যারা কমবেশি দলের প্রতি অনুগত থেকে এখনো নীরবে কাজ করে যাচ্ছেন তাদেরই ওয়েলকাম করার সময় এসেছে। আওয়ামী লীগ কি এভাবেই ভাববার প্রয়োজন মনে করছে? মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App