×

মুক্তচিন্তা

পরিবহন ভাড়া বাড়ল, লাভ কার হলো?

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৭ নভেম্বর ২০২১, ০১:২৬ এএম

ধানমন্ডি টু গুলশান-১। সিএনজি অটোরিকশাচালক ভাড়া হাঁকলেন ৫০০ টাকা। আকাশ ভেঙে পড়ল মাথায়। চালকের ভ্রæক্ষেপ নেই যাত্রীর কী হয়, না হয় তাতে। কেউ তো কেউ যায়, যাবেই। তা না হলে এত টাকা ভাড়া চাইবে কেন। ৫০০ টাকা ভাড়া চাওয়ার কারণ, জ¦ালানির দাম বৃদ্ধি হওয়ার প্রতিবাদে পরিবহন ধর্মঘট। ‘যাইলে যাইবেন, না যাইলে যাইবেন না। প্যাঁচাল পাড়নের সময় নাই’- কথাটা বলে উত্তরে অপেক্ষায় সে। ঘর থেকে ৫০০ টাকা নিয়ে বের হওয়া মানুষের ঘরে ফেরার উপায় কী ভেবে সিএনজি অটোতে চড়ে বসার নিরুৎসাহিত বোধ করা। দ্বিতীয় সিএনজি অটোরিকশাচালক চাইলেন ৪০০ টাকা। দর কষাকষিতে অবশেষে সাড়ে ৩০০ টাকা ভাড়া ঠিক হলো। চালক আবদার করলেন, রাস্তায় পুলিশ জিজ্ঞেস করলে বলবেন মিটারে যাচ্ছেন। ভাড়া বেশি দিতে হবে, তার ওপর আবার মিথ্যা বলে তাকে বাঁচাতে হবে। অন্যায়কে মিথ্যা দিয়ে জয় করাতে হবে। জিম্মি হয়ে পড়া যেন। রাস্তায় পথচারী চোখে পড়ার মতন। হেঁটে যাচ্ছে। কেউবা হালকা দৌড়ে পৌঁছাতে চাইছেন গন্তব্যে। ট্রাফিক জ্যামে অটো দাঁড়াতে বাধ্য হলে জানা গেল, দৌড়ে ছুটে যাওয়া ব্যক্তিরা সময়মতো পরীক্ষা হলে প্রবেশ করতে চাইছেন। চাকরির পরীক্ষা। বাস চলে না। অন্যকিছুতে চড়ে গন্তব্যে পৌঁছিয়ে চাকরির যোগ্যতা প্রমাণ করা কঠিন। তাই দুই পা’কে সম্বল করে ছুটছেন। ‘কী সর্বনাশ বলেন তো? গার্মেন্টসে সময়মতো না পৌঁছালে ঢুকতে পারব না। একদিন অনুপস্থিত দেখাবে। গাড়ি চলে না। কী করে কামে যাই!’ একজন নারী পোশাক শ্রমিক আক্ষেপ করে বলছিলেন। কেউবা আবার হেঁটে ক্লান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে জিরিয়ে নিচ্ছেন। অধিকাংশ বাসযাত্রী। তারপরও প্রাইভেটকার, উবার, সিএনজি অটোতে জ্যাম কম নয়। বিকালে গুলশান টু ধানমন্ডি একই অভিজ্ঞতা। সাধারণ মানুষের জীবনে নেমে এসেছে দুর্ভোগ- পরিবহন ধর্মঘট। সরকার হঠাৎ করে জ¦ালানি মূল্য বাড়িয়ে দেয়ায় পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনের এই বিরূপ আচরণ ধর্মঘট। পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠন অতীতেও জনগণের বিপরীতে দাঁড়িয়ে তাদের স্বার্থ উদ্ধার করেছে। এটা নতুন কিছু নয়। যাই হোক ধাক্কাটা লাগল প্রচণ্ডভাবে যখন জানা হলো, সরকার ইন্ডিয়ায় জ¦ালানি পাচার রোধে এই মূল্য বৃদ্ধি করেছে। ইন্ডিয়া থেকে বাংলাদেশে জ¦ালানির মূল্য কম। তাই পাচার হয়ে যাচ্ছে জ¦ালানি। এই পাচার রোধেই সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু এ কেমন যুক্তি? জ¦ালানি পাচাররোধের ব্যর্থতা না খতিয়ে, দায়িত্বশীলদের দায়ী না করে এবং পাচাররোধে কঠিন অবস্থান না নিয়ে শাস্তির রায়টা চাপিয়ে দেয়া হলো সাধারণ মানুষের ওপর, যাদের জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে প্রতিদিন ছুটে যেতে হয় বাস, টেম্পো, সিএনজি অটোতে চড়ে কর্মস্থলে এবং রাষ্ট্রের আমদানি-রপ্তানির অর্থনীতির চাকার ওপর! সমুদ্র বন্দরে আটকা পড়েছিল শত শত কন্টেইনার। বন্দর থেকে কাঁচামাল পৌঁছতে পারেনি বিভিন্ন শিল্প কলকারখানায়। শিল্প কলকারখানা থেকে বন্দরে পৌঁছতে পারেনি বিভিন্ন ধরনের পণ্য। বিশেষ করে পোশাক শিল্প মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। এমনকি মাল না নিয়েই ফেরত গেছে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্যবাহী জাহাজ। শত শত কোটি টাকার লোকসান হয়েছে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে। মিডিয়ায় তা ফলাও করে প্রচারও করা হয়েছে। কৃষকও ক্ষতি গুনেছেন পরিবহন ধর্মঘটে। মানুষের কৃষিপণ্যের চাহিদা পূরণে ব্যর্থ কৃষক নিজের ক্ষতির হিসাব কষেছেন। এসব ক্ষতির দায় কেউ বা কারা নেবেন কিনা জানি না। নেয়া তো উচিত দায়িত্বশীলদের। দায় না নিলে তো জবাবদিহিতা থাকবে না। আর জবাবদিহিতা না থাকলে তো স্বচ্ছতা আসবে না। অস্বচ্ছতায় অনাস্থা, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়, মানি তো? মানতে হবে। আস্থা, বিশ্বাস, ভরসা এই জাতীয় বোধ মানুষ তার জীবন-জীবিকার স্বস্তি, শান্তি, নিরাপত্তার ভেতর খুঁজে ফেরে। সাধারণত মানুষ তার প্রয়োজন মেটায় বেঁচে থাকবার শর্তে। জ¦ালানির দাম বাড়িয়ে কি পাচাররোধ করা যাবে, নাকি গেছে কখনো? নিশ্চয়ই না। কী হলো তাতে? হলো তো অবশ্যই জয় এবং সেটা পরিবহন মালিক-শ্রমিকের। একদিকে সরকার আর অন্যদিকে পরিবহন মালিক-শ্রমিক লাভবান হলেন পালাক্রমে জ¦ালানি ও ভাড়া বৃদ্ধির কারণে। সমালোচকরা বলছেন, এটা আসলে সরকার ও পরিবহন মালিক-শ্রমিকের খেলা। জনগণের ওপর ভর করে খেলেছেন, খেলা শেষ করেছেন। অতীতে তারা এমন অনেক খেলা খেলেছেন বলে অনেকেই তা মনে করেন। তাই কী? আবার পাচাররোধ করবার জন্য সীমান্তরক্ষীরা থাকেন সেটা কিন্তু কমবেশি সবাই জানেন। অগোচরে এই সত্য রেখে নতুন কিছু বুঝ দেয়া কতটা যৌক্তিক তা কিন্তু ভেবে দেখা দরকার। জনরোষে জনগণের দুর্ভোগ কমাতে সরকার অকটেন, সিএনজি ও ডিজেল ব্যবহারকারী যানবাহনের ভাড়া ঠিক করে দিয়েছে। পরিবহন মালিকদের অনেকেই তা অনুসরণ না করায় মিডিয়ায় দেখা গেল পরিবহনগুলোতে স্টিকার লাগানো হচ্ছে কোন পরিবহন কোন ধরনের জ¦ালানিতে চলছে তা বুঝানোর জন্য। স্টিকার লাগিয়ে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের নিয়মে আনা সম্ভব কিনা, অতীতের অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা করে তা বুঝা সম্ভব। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেও কিন্তু অপরাধ, দুর্নীতি রোধ করা যায়নি আশানুরূপভাবে। অপরাধী ও অপরাধপ্রবণতা রয়ে যায় সমাজে কোনো না কোনো কারণে। এই কারণগুলো সঠিকভাবে অনুধাবন না করলে সমস্যার সমাধান হবে না, হয়নিও। এটা ঠিক যে, যে কোনো সিদ্ধান্ত জনগণের মতামতে নেয়া শ্রেয়। বিশেষত যা জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এই জনগণের মধ্যে আছেন সরকারি-বেসরকারি কর্মজীবী, শ্রমজীবী মানুষ, কৃষক, ব্যবসায়ী, ছাত্র-শিক্ষক ইত্যাদি পেশাজীবী মানুষ। আছেন বিভিন্ন মতাদর্শের রাজনীতিবিদ, সুশীল সমাজ, সমাজবিজ্ঞানী। রাষ্ট্রের ভেতর একটা নিয়ম প্রচলিত করবার আগে তা জনমত যাচাইয়ে নিলে ক্ষতির ভার সাধারণ মানুষের ওপর যেমন পড়ে না, তেমন পড়ে না রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিতে। যদিও এমন চর্চা দেখা যায় না সচরাচর। তবে এমন চর্চার সময় এসেছে যদি না জনগণের কাছে জবাবদিহিতার বিষয়টি রাজনৈতিক সদিচ্ছার বদৌলতে দৃশ্যমান করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করা হয় এবং প্রকৃতার্থে উন্নয়ন ত্বরান্বিত করবার তাগাদা থাকে। করোনার ছোবল এখনো কাটেনি। নতুন করে দরিদ্র হয়েছে প্রায় ৩ কোটি মানুষ। অনেকের মতে আরো বেশি। আশপাশ তাকালে করোনার আঘাত চোখে পড়ে। কর্মসংস্থান হারানো, ব্যবসা-বাণিজ্যের ঝাপি টেনে দেয়া, বেকারত্ব এবং এমন অবস্থা থেকে উত্তরণের প্রবল আকাক্সক্ষায় যখন মানুষ ব্যতিব্যস্ত, উন্মুখ ঠিক তখন হুট করে এমন সিদ্ধান্ত অত্যন্ত অমানবিক বলে ভুক্তভোগীরা মনে করছেন। করোনার মৃত্যু ভয় কাটিয়ে উঠলেও বেঁচে থাকবার আকুল তাড়নায় মানুষ এখন দিশাহারা। করোনার ভয় থেকেও যেন না খেয়ে মরে যাবার ভয়টা এখন তীব্র। একটা কথা বাজারে বেশ অনেকদিন ধরে আছে আর তা হলো, সরকার সব পারে, শুধু পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের সঙ্গে পেরে উঠে না, উঠতেও চায় না। সেই সঙ্গে সীমান্তটাও যেন কেমন অরক্ষিত হয়ে আছে। কথা দুটি যদি ভুল হয়, তাহলে তা প্রমাণিত হওয়া দরকার। সরকারকেই তা প্রমাণ করতে হবে। রাষ্ট্র ও জনগণের স্বার্থসংরক্ষিত হয় এমন সিদ্ধান্তই নেয়া উচিত। জনগণকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রের কথা ভাবা, সেওবা কেমন! স্বপ্না রেজা : কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App