×

মুক্তচিন্তা

শেখ হাসিনার ইউরোপ বিজয় ও দেশীয় অন্যান্য প্রসঙ্গ

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৪ নভেম্বর ২০২১, ০১:২৯ এএম

প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ইউরোপের বিভিন্ন দেশ সফর করছেন। আন্তর্জাতিক জলবায়ু পরিবর্তন শীর্ষ সম্মেলন কপ ২৬-এ বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় করণীয় সম্পর্কে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ও যুগান্তকারী ভাষণ দিয়েছেন এবং প্রস্তাবনা রেখেছেন। কপ সম্মেলন থেকে শেষ পর্যন্ত প্রাপ্তি কী ঘটবে জানি না। তবে শেখ হাসিনার বক্তব্যে আগামী প্রজন্মকে পৃথিবীর সহনীয় পরিবেশের মধ্যে সুরক্ষায় তার সুচিন্তার প্রকাশে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ অভিভূত হয়েছেন। এছাড়া বর্তমান সফরে ইউরোপের তিনটি দেশে পেয়েছেন উষ্ণ অভিবাদন ও লালগালিচা সংবর্ধনা। এই সফরে ওই সব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে মর্যাদার সঙ্গে আরো উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। প্রতিটি দেশের সঙ্গে স্বাক্ষরিত বিভিন্ন চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকে শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, প্রজ্ঞাপূর্ণ দূরদর্শী চিন্তার প্রকাশ ঘটেছে। এ সফরে তার নেতৃত্বে বিভিন্ন দেশের কাছে বাংলাদেশের সক্ষমতার বিষয়টিও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি যেমন উজ্জ্বল হয়েছে তেমনি মর্যাদাপূর্ণ আসনটিও সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অর্থাৎ সাম্প্রতিক কালের ইউরোপ সফরকে আমরা নিঃসন্দেহে ‘শেখ হাসিনার ইউরোপ বিজয়’ বলেও অভিহিত করতে পারি। জননেত্রী শেখ হাসিনা যেখানেই যান সেখান থেকেই সাফল্যের স্বর্ণখণ্ড নিয়ে দেশে ফেরেন। কিন্তু আমাদের ঘরের ভেতরকার সমস্যা দায়িত্বপ্রাপ্তরা কেন মোকাবিলা করতে পারেন না তাই বিস্ময়ের সঙ্গে মাঝেমধ্যে ভাবি- ভাবি আর কিছুটা হলেও হতাশ বোধ করি। ‘দল বড় হলে সমস্যা থাকবেই’- বলে রাজনৈতিকভাবে অনেক সমস্যা আওয়ামী লীগকে জিইয়ে রাখতে দেখি। কিন্তু এই সমস্যায় যখন একের পর এক বিদ্রোহী প্রার্থী সৃষ্টি হয় তখন কিছুটা হলেও মনে অস্বস্তি জাগে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে চারদিকে আওয়ামী লীগের কেন এত বিদ্রোহী প্রার্থী থাকবে তা কেন্দ্রের ভাবা উচিত, প্রয়োজনে গবেষণা করে হলেও এসব সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধান করা উচিত। আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যের বাড়িতেও বিদ্রোহী প্রার্থীর খবর আমাদেরকে দলের সাংগঠনিক শৃঙ্খলা সম্পর্কে উদ্বিঘœ করে। কিন্তু কেন্দ্র এসব বিষয়ে মুখ না খুললে, সক্রিয় পদক্ষেপ না নিলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এরূপ ছিদ্র থেকেই বৃহত্তর ফাঁক তৈরির আশঙ্কা থাকে। আর সেই ফাঁক দিয়েই শত্রæ পক্ষের অনুপ্রবেশ সহজ হয়ে ওঠে। আওয়ামী লীগের তো এমনিতেই মনে রাখা প্রয়োজন ‘তোমাকে বধিবে যে, গো-কুলে বাড়িছে সে’! একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক গোষ্ঠী দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে আছে। তাদের সম্মুখে অহেতুক কেন ‘সুযোগ’ সৃষ্টি করে দেয়া হয় জানি না! আমরা এর সদর্থকও খুঁজে পাই না। ‘বড় দল’ বলে উদাসীনতায়ও তাদের বড় হতে হবে এর কোনো মানে আছে? ২০২৩ সালের নির্বাচনের কথা মাথায় রাখতে হবে। সবচেয়ে বেশি মাথায় থাকা দরকার ২০৪১ সালের মধ্যে জননেত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষা দেশকে ‘উন্নত ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্রে’ পরিণত করতে হবে। সব কিছু মাথায় রাখার পাশাপাশি বর্তমান বাজারের প্রতিও আওয়ামী লীগ বিশেষত সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নজরদারি বাড়ানো দরকার। সুনির্দিষ্টভাবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কেই সাধারণ মানুষের পাশে থাকা দরকার, থাকতে হবে। যদি ভাবতে চাই কোভিড মহামারির দ্বিতীয় ঢেউ সামলিয়ে আমরা সত্যিকার অর্থে কেমন আছি? কেমন আছি বর্তমান বাজারে? বাজারের কথা বললে বাজারের পণ্যসামগ্রীর মুখগুলো আমাদের করুণ চেহারার দিকে তাকিয়ে ভ্রƒ-ভঙ্গিতে যেন হেসে ওঠে! সেই হাসির অর্থ আমাদের পকেটের দিকে ঈষৎ ব্যঙ্গের, ঈষৎ বিদ্রুপের! এমনটি হতে পারে- আবার নাও হতে পারে! কিন্তু মধ্যবিত্ত-স্বভাবী মনের মধ্যে কেবলই একটা খোঁচা লেগে যায় বাজারের এ প্রান্ত থেকে সে প্রান্ত পর্যন্ত! মাছ, মাংস, ডিম, ডাল, সবজি, তেল, চিনি, নুন, আটা, ময়দা, সুজি, মসলা সর্বত্রই সেই বিদ্রুপের ভ্রƒ-ভঙ্গি! সর্বত্রই সেই নিদারুণ ব্যঙ্গ! বাজারের সঙ্গে, বাজারের পণ্যসামগ্রীর মূল্যমানের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে আমাদের মধ্যবিত্ত জীবন কেবলই হোঁচট খায়, মুখোমুখি সংঘর্ষে কেবলই বিধ্বস্ত হয়, থমকে দাঁড়ায়! দ্রব্যমূল্যের সমান তালে তাল মিলিয়ে চলতে পারি না আমরা। মধ্যবিত্তেরই যখন এই হাল তখন নিম্ন-মধ্যবিত্ত বা সূচকের নিম্নতর দিকে আরো যেসব ধাপে মানুষের বসবাস তাদের অবস্থা বর্তমান বাজারে যে আরো কতটা নাকাল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু বাজার, পণ্যসামগ্রীর ঊর্ধ্বমুখী মূল্যের গতি হ্রাস করার কথা, তাকে সামলানোর কথা আমাদের সংশ্লিষ্ট মহল ন্যূনতম ভাবনার মধ্যেও আনছে না, আনতে পারছে না। আবার আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই আমাদের চোখের সামনে নিষেধাজ্ঞার বিশাল এক সাইনবোর্ড হয়ে দাঁড়ায়। কোনো পণ্যের দাম আমাদের দেশে একবার বেড়ে গেলে পরবর্তী সময়ে আমরা আর আন্তর্জাতিক বাজারেরও খোঁজ-খবর রাখি না, প্রয়োজনও বোধ করি না। আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য হ্রাস পেতে পেতে নিম্নতম পর্যায়ের তলানিতে চলে এলেও আমাদের দেশের কোনো বাজারের কোনো নিত্যপণ্যের কাঁধ থেকে সেই মহার্ঘ্য মূল্য কমাতে বেমালুম ভুলেই যাই! উচ্চমূল্যে আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়ি, অভ্যস্ত হয়ে যাই। অভ্যস্ত হয়ে পড়ি মধ্যবিত্তসহ সব স্তরের ভোক্তারাই! সম্প্রতি গুটিকতক জ্বালানি তেল যথা- ডিজেল, কেরোসিন এবং ফার্নেস অয়েলের মূল্য বৃদ্ধি জনজীবনকে ব্যাপক প্রভাবিত করেছে। জনজীবনে এক ধরনের ত্রাহি অবস্থারও সৃষ্টি হয়েছে। জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির অজুহাতে বাস ভাড়া বেড়েছে প্রায় ২৭ শতাংশ, লঞ্চ ভাড়া বেড়েছে ৪৩ শতাংশ! এটি ভাবা যায়! পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতে কোনো পণ্যের মাত্র এক টাকা মূল্য বৃদ্ধির কারণেই জনবিক্ষোভ দেখা দেয়। আমাদের দেশে একলাফে লিটারপ্রতি জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যায় ১৫ টাকা, আশ্চর্য! সভ্য দেশে পণ্য মূল্য বাড়ানোরও একটি ভদ্রস্থ পন্থা থাকা দরকার। সাধারণ মানুষকে আগেই বলে দেয়া প্রয়োজন আগামী ‘অমুক দিন’ থেকে ‘তমুক পণ্যের’ মূল্য ‘এত টাকা’ বাড়ানো হবে। কিন্তু না, সেই সামান্য ভদ্রতাটুকুও আমরা জ্বালানি মন্ত্রণালয় থেকে পেলাম না! এটি শুধু অন্যায় নয়- অনৈতিকও বটে! বর্তমান বাংলাদেশে শিক্ষিতের হার প্রায় ৭৫ শতাংশ (২০২০ সালের সূত্র)। যাদের মধ্যে এখনো শিক্ষার আলো পড়েনি তাদের কথা বাদ দিলেও এই ৭৫ শতাংশ শিক্ষিত মানুষের আত্মমর্যাদা ও আত্মসম্মান বলে কি কিছুই থাকতে নেই! দেশের এত বড় একটি খবর তারা অন্তত একটি সপ্তাহ আগে জানতে পারবেন না, সে অধিকারও কি তারা রাখেন না? এটি সাধারণ মানুষকে অপমান ছাড়া কিছু নয়! আর এই অপমানের গায়ে ঘি ঢেলে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো তাদের ‘আখের’ গোছাবে। এটাই তো ফাঁক, এরূপ ফাঁকই তো তারা খোঁজে! আমাদের সরকার বা তার কোনো মন্ত্রণালয় বা সংস্থা কেন এরূপ ফাঁক সৃষ্টির অবকাশ তৈরি করবে, তৈরি করে চলবে অহরহ? নির্দিষ্ট কিছু জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়ার ফলে এখন শুধু ডিজেলচালিত যানবাহনের ভাড়াই বৃদ্ধি পেয়েছে তা কিন্তু নয়। সিএনজিচালিত যানবাহনের ক্ষেত্রে ভাড়া বৃদ্ধি ঘটেছে। আর এ নিয়ে যাত্রী ও পরিবহনকর্মীদের মধ্যে কাজিয়া-ফ্যাসাদ নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায়ও পরিণত হয়েছে। ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধিতে সিএনজিচালিত বাস বা ট্রাকের ভাড়া বৃদ্ধির যৌক্তিক কোনো কারণই নেই। তবু ‘সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে’ বলে যে প্রবাদ প্রচলিত তারই কিছুটা বাস্তবায়ন আমরা সম্প্রতি বিভিন্ন ঘটনায় দেখতে পাচ্ছি। সব যানবাহন একই সড়কে চলবে অথচ ভাড়া ভিন্ন হবে কেন! পরিবহন ক্ষেত্রের কথা ছেড়ে দিলেও আরেকটি বিরাট ক্ষেত্র আমাদের চোখে পড়বে। তা হলো কৃষি। আসন্ন শুষ্ক মৌসুমে ডিজেলচালিত সেচ যন্ত্রের ব্যবহার বৃদ্ধি পাবে। অতএব কৃষি ক্ষেত্রেও আমরা জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব টের পাব- প্রথমত চাষিরা টের পাবেন এবং পরবর্তী পর্যায়ে টের পাবেন কৃষিজাত পণ্যসামগ্রীর ভোক্তারা, আমরা, সাধারণ মানুষ। অর্থাৎ মূল্যবৃদ্ধির ঘেরাটোপ থেকে সাধারণ মানুষের পরিত্রাণের উপায় নেই! সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট মহলের মধ্যে কোনো তাড়নাও দেখতে পাচ্ছি না। যারা সরকারে আছেন এবং এসব বিষয় দেখভাল যাদের দায়িত্ব তারা সক্রিয় হলে জননেত্রীর মুখটি উজ্জ্বল হয়। অথচ এ কাজটিতে কাউকেই সক্রিয় দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা কি নিজেদের সেই দায়টুকু থেকে নির্বাসনেই থাকবেন? না মাঠে-ময়দানে এসে সাধারণের পাশে দাঁড়াবেন? তারা কি অসাধু ব্যবসায়ী চক্রের গোপন ‘সিন্ডিকেট’ ভাঙার চেষ্টাটাও করবেন না? আওয়ামী লীগের মন্ত্রী ও নেতাকর্মীদের উদ্দেশে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলতে চাই আপনারা মাঠ ছাড়বেন না। মাঠ ছেড়ে দিলে তা কিন্তু বে-দখল হয়ে যাবে- ওঁৎ পেতে বসে আছে কতজন, মনে রাখবেন কতজনই না ‘গো-কুলেও বাড়ছে’! বর্তমান সরকার এবং জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রতি সাধারণ মানুষের যে অগাধ আস্থা তার জন্য সাধারণকেও ‘দক্ষিণা’ দিতে হবে। সরকার যে সাধারণের পাশে আছে তা দেখতে পেলেই মানুষ সেটাকেই সরকারের দক্ষিণা ভেবে সান্ত¡না পাবে। সাধারণকে খুশি করতে সরকারকে দৃশ্যমান উদ্যোগ নিতে হবে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারের সাফল্য যে কোনো রাজনৈতিক দলের জন্য ঈর্ষণীয়। অন্তত যারা দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে আছে তারা সরকারের নানামুখী সমালোচনায় মত্ত, কখনো কখনো তারা যে উন্মত্ত তাও তো দেখতে পাই। সুতরাং সব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখার পাশাপাশি বাজার নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের তৎপরতা দৃশ্যমান হোক। শেখ হাসিনার ইউরোপ বিজয়ে আমরা যেমন আপ্লুত তেমনি দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারের অন্যদের কাজেও সাফল্য প্রত্যাশা করি। আহমেদ আমিনুল ইসলাম : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App