×

জাতীয়

তারকা হোটেলে অবৈধ ডিজে পার্টিতে উড়ছে টাকা, নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষিত

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ নভেম্বর ২০২১, ১২:৪০ এএম

তারকা হোটেলে অবৈধ ডিজে পার্টিতে উড়ছে টাকা, নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষিত

ঢাকা ও টঙ্গির ছয়টি তারকা হোটেলে কোনো ধরনের অনুমোদন ছাড়াই ডিজে পার্টির নামে ফ্রি স্টাইলে চলছে উদ্দাম নৃত্য ও গান। সাতজন মিলে আয়োজন করে থাকেন এসব পার্টির। এসব বিষয় ওপেন সিক্রেট হলেও মাসোহারা চুক্তি থাকায় আইনশঙ্খলা বাহিনীর সবাই নিরব। আবার পুলিশের গুলশান জোন থেকে এসব বন্ধে চিঠি দেয়া হলেও তোয়াক্কা করছে না অনেক হোটেল কর্তৃপক্ষ। এসব হোটেল পরিচালনাকারীদের অনেকে মুদ্রাপাচার ও মাদকদ্রব্য আইনসহ একাধিক মামলার আসামি এবং অনেকের নামে আদালতের গ্রেপ্তারী পরোয়ানা থাকলেও দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। রাতের জলসায় হচ্ছেন অতিথি। সন্ধ্যা থেকে গভীররাত পর্যন্ত চলা এসব আসড়ে উড়ছে লাখ লাখ টাকা। মদের নেশায় বিভোর হয়ে বেসামাল লোকজন তরুণীদের মোহে পড়ে হচ্ছেন নি:স্ব। হিরো থেকে জিরো হওয়ার ঘটনা ঘটছে হরহামেশা। আলো আধারির খেলায় অনেকে হচ্ছেন সর্বশান্ত। যাদের মধ্যে উঠতি রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, মাছ ও কাঁচামাল ব্যবসায়ী ও জমি ব্যবসায়ী রয়েছে। এসব নিয়ে কেউ মুখ খুললে মামলা দিয়ে হয়রানির ঘটনাও কম না।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর কমিশনার (ডিএমপি) মোহা. শফিকুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেছেন, পুলিশ এসব বিষয়ে সোচ্চার রয়েছে। অভিযোগ পেলে বা নজরে আসলে ব্যবস্থা নেয়া হয়ে থাকে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আব্দুস সবুর মন্ডল বলেছেন, অভিযান চলামান প্রক্রিয়া। অধিদপ্তরের পুলিশ ও র‌্যাব অভিযান পরিচালনা করে থাকে। ডিজে পার্টি করার সুনির্দিষ্ট তথ্য পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

জানা গেছে, খিলক্ষেতের ঢাকা রিজেন্সী, লা-মেরিডিয়ান, বিজয়নগরের ফারস, পাঁচ তারকা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল ও সোনারগাঁও এবং রাজধানীর উপকন্ঠ টঙ্গীর জাভান হোটেল নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে চালাচ্ছে রাতের জলসা। ফারস হোটেলে নিশাত, ঢাকা রিজেন্সীতে শাহীন, লা-মেরিডিয়ানে জয়নাল, বিপুল ও বাশার এবং ইন্টারকন্টিনেন্টালে মিন্টুর নেতৃত্বে জমে উঠে রাতের ডিজে পার্টি। এসব পার্টিতে ১০-২০ লাখ উড়ানো হয়। যার মধ্যে ৫০০ ও ১০০০ হাজার নোট থাকে। পার্টি শেষে যার পরিমাণ দাঁড়ায় লাখ লাখ টাকা। অবশ্য রেডিসন ব্লুতে জয়ের পার্টি অনেকটা শালীনতায় চলে চলে বলে জানা গেছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা জানান, এসব তারকা হোটেলে বারের অনুমোদন থাকলেও লাইসেন্সে নাচ-গানের কোনো কথা উল্লেখ নেই বা অনুমোদন নেই। তবে গানের আয়োজন বা পার্টি করার জন্য মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট দুই মেট্রো ও জোনের কর্মকর্তারা লেনদেনের মাধ্যমে মাসিক অলিখিত চুক্তিতে একটি অনুমতি দিয়েছে। যদিও এর আইনী কোনো বৈধতা নেই। আর কথিত ওই অনুমতিপত্রে গানের কথা বলা হলেও বলা নেই উদ্মাম নৃত্যের কথা। বরং রয়েছে নিষেধাজ্ঞা।

সূত্র মতে, পুলিশের গুলশান জোনের উপ পুলিশ কমিশনার (ডিসি) সুদীপ কুমার চক্রবর্তী গত ১৮ ফেব্রুয়ারি এক পত্রে ঢাকা রিজেন্সী কর্তৃপক্ষকে ডিএমপি কমিশনারের অনুমতি ব্যতিত সেখানে সবধরনের নাচ-গান ও পার্টি চালানো যাবে না বলে জানান। ওই পত্রে রিজেন্সী ডিএমপি অর্ডিন্যান্স এর ২৫ (খ), ২৭ (ঙ) এবং ৩১ ধারা লংঘন করছে বলেও উল্লেখ করে সতর্ক করা হয়। কিন্তু এরপরও তাদের নাচ-গান ও টাকা উড়ানো অনুষ্ঠান চলছে। এখনো সপ্তাহে ছয়দিনই মঞ্চের লাইট বন্ধ করে সাতটা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত ডিজে পার্টির নামে আলো-আধারির খেলা (এর ভিডিওচিত্র ভোরের কাগজের কাছে সংরক্ষিত আছে) চললেও পুলিশ-র‌্যাব ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা রহস্যজনক কারণে নিরব রয়েছে। অবশ্য এ প্রসঙ্গে পুলিশের গুলশান জোনের বর্তমান উপ-কমিশনার (ডিসি) আসাদুজ্জামান বলেছেন, যেসব জিনিষ নিষিদ্ধ তার বিরুদ্ধে পুলিশের অভিযান চলমান। এমন কিছু ঘটে থাকলে খতিয়ে দেখে অভিযান পরিচালনা করা হবে। ঢাকা রিজেন্সী, লা-মেরিডিয়ানের ব্যাপারেও খোঁজ নেয়া হবে বলে জানান তিনি।

অবশ্য গত বুধবার এ প্রতিবেদক পুলিশের বক্তব্য নিতে কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার পর রাতে খিলক্ষেত থানার অফিসার ইনচার্জ মুন্সী সাব্বির আহমেদ ঢাকা রিজেন্সী হোটেলে গিয়ে ডিজে-পার্টি বন্ধ রাখার কঠোর নির্দেশ দেন। এ্রপর থেকে সেখানে না-গান বন্ধ রয়েছে। এক প্রশ্নর জবাবে ইন্সপেক্টর মুন্সী সাব্বির আহমেদ জানান, রিজেন্সীর কর্মকর্তা কবির রেজার বিরুদ্ধে একটি মামলায় গ্রেপ্তারী পরোয়ানা রয়েছে। তাকে আটকের চেষ্টা চলছে। হোটেলসহ কয়েকটি স্থানে অভিযান চালিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি বলে জানান তিনি।

গোয়েন্দা পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, ঢাকা রিজেন্সীর ব্যবস্থাপনা পরিচালক কবির রেজার বিরুদ্ধে ৯ নভেম্বর সিআর ৩৫১/২১ নম্বর মামলায় গ্রেপ্তারী পরায়ানা জারি করে আদালত। ঢাকা মহানগর পুলিশ ও পুলিশের গুলশান জোনের পদস্থ কর্মকর্তা এবং খিলক্ষেত থানা পুলিশ এ ব্যাপারে জ্ঞাত হলেও রহস্যজনক কারণে তাকে ধরতে উদ্যোগ নেই। বরং পরোয়ানা জারির পর পরই থানা থেকে খবর যায় কবির রেজার কাছে। উত্তরার বাসা থেকে হোটেলে অবস্থান নেন তিনি।

একই হোটেলের মালিকানার অংশীদার অনেকেই একাধিক মামলার আসামি এবং কারাগারে গেছেন বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে। একই হোটেলের গত ২০ সেপ্টেম্বর এক রশিদে খিলক্ষেত থানায় একজনের বিরুদ্ধে মামলা রুজুর জন্য দেড় লাখ টাকা দেয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয় (কপি ভোরের কাগজের কাছে সংরক্ষিত আছে)! যাতে কর্তৃপক্ষের চারজনের স্বাক্ষর রয়েছে। একজনের সঙ্গে বিরোধের জের ওই মামলা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

ডিজে পার্টিতে অংশগ্রনকারী একাধিক ব্যক্তি জানান, বদলে যাওয়া সময়ের এক নতুন সংস্কৃতি ‘ডিজে পার্টি’। ডিজে শব্দের অর্থ হলো ডিস্ক জকি। একে আবার কেউ কেউ বলে ডিসকো জকি। ডিজে পার্টির আকর্ষণ হলেন চিয়ার্সগার্ল। শুক্রবার ছাড়া সপ্তাহে ছয়দিন এসব হোটেলে চলে নাচ-গান। নাচগানের আসড়ে প্রতিরাতে উড়ে লাখ লাখ টাকা।

এরমধ্যে নাচ এবং গানের শিল্পীরা সেখানে যাওয়া অতিথিদের আকৃষ্ট করে তাদের কাছে নামি-দামি ব্রান্ডের বিদেশী মদ-বিয়ার বিক্রি করে থাকেন। পেগ ও বোতল ধরে বিক্রি করা হয় ব্রান্ডের মদ। এর সঙ্গে হোটেলের আয় বা ব্যবসার স্বার্থ জড়িত। বেশী মদ-বিয়ার বিক্রি করা তরুণীদের পুরস্কৃত হরা হয়। আবার মদপানে বিভোর লোকজন বনিবনা করে অনেক তরুণীকে সঙ্গে করে নিয়ে যান। মাঝরাতে শিল্পী ও হোটেল কর্তৃপক্ষ মিলে পার্টিতে উড়ানো টাকা কুড়িয়ে ভাগবাটোয়ারা করেন। এভাবে রাতের পর রাত চলছে ডিজে পার্টি নামের অবৈধ কীর্তি।

অনুমোদনহীন ডিজে পার্টির ব্যাপারে কথা বলতে হোটেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও কেউ কোনো কথা বলতে চাননি। প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন তারা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App