×

মুক্তচিন্তা

এমন বেপরোয়া সিদ্ধান্ত মেনে নেয়া যায় না

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৩ নভেম্বর ২০২১, ০১:০৯ এএম

ভিন্ন একটি বিষয় নিয়ে এবারের লেখাটি লিখব ভেবেছিলাম, সে ভাবনায় ছেদ পড়ল সরকারের অতি সম্প্রতি নেয়া এক সিদ্ধান্তে, সব দৃষ্টি কেড়ে নিল সেটি। বিষয় জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি। এমন হারে বাড়ানো হলো দাম, যা অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করল। প্রায় ২০ মাস ধরে করোনা ভাইরাসের দাপট চলছে, পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় মানুষ কিছুটা স্বস্তি নিয়ে ফের ওঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল। লণ্ডভণ্ড জাতীয় অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের পর্ব এখন। এ সময় সরকারের তরফ থেকে আরো বেশি নীতি সহায়তা দরকার ছিল। ঘটল তার উল্টোটি, মানুষের ওপর চাপিয়ে দেয়া হলো সইবার অতীত বোঝা। জ্বালানি তেলকে অর্থনীতির ভাষায় ‘কৌশলগত পণ্য’ বলা হয়। এর প্রভাব পড়ে প্রতিটি খাতে। সার্বিক মূল্যস্তর বেড়ে যায়। মুদ্রাস্ফীতি ঘটে। এ সময় এমন পরিস্থিতির উদ্ভব একেবারেই অনাকাক্সিক্ষত। সেজন্যই একে বেপরোয়া সিদ্ধান্ত বলছি। সাধারণ মানুষের করোনা-পরবর্তী বিপর্যস্ত জীবনকে মোটেই বিবেচনায় নেয়া হয়নি সিদ্ধান্ত গ্রহণের বেলায়। একে সরকারের তরফ থেকে চাপিয়ে দেয়া এক নির্মম ঘটনা বললেও অত্যুক্তি হবে না। করোনার অভিঘাত নিয়ে দেশের শীর্ষস্থানীয় গবেষণা সংস্থা ‘সানেম’, ‘বিআইজিডি-পিপিআরসি’সহ বিভিন্ন সংস্থা গবেষণা করে ফলাফল প্রকাশ করেছে। এতে দেখা যাচ্ছে দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। ‘বিআইজিডি’ ও ‘পিপিআরসি’-র সর্বশেষ জরিপের ফলাফল অনুযায়ী দেশে করোনাকালে নতুন করে দরিদ্র হয়েছে এমন মানুষের সংখ্যা ৩ কোটি ২৪ লাখ। সরকার স্বীকার করুক আর না করুক, বিপুলসংখ্যক মানুষ যে নতুন করে দরিদ্র হয়েছে তাতে কোনো ভুল নেই। দরিদ্র মানুষতো কষ্টে আছেই, চাপে আছে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষও। নিত্যব্যবহার্য সব জিনিসেরই মূল্য বেড়েছে, কোনোটির মূল্য আবার আকাশছোঁয়া। নুন আনতে পান্তা ফুরানোর দশা অনেকেরই। কেমন করুণ দশা মানুষের, ঢাকায় টিসিবির ট্রাকের সামনে দৃষ্টি মেললেই অনুভব করা যায়। এমন নারী-পুরুষকেও সারি বেঁধে দীর্ঘ সময় অপেক্ষারত দেখা যায় যাদের কখনো এরকম পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি। সরকার নীতি সহায়তা দিয়ে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইছে এমন উদাহরণ কম। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে এলো এবার ‘কৌশলগত পণ্য’ জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বেড়েছে লিটারপ্রতি ১৫ টাকা। ফার্নেস ওয়েল ও রান্নার গ্যাসেরও দাম বেড়েছে কিছুটা কম করে হলেও। এ সিদ্ধান্তের অভিঘাত পড়বে সমাজের সর্বস্তরে। মূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে জ্বালানি মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের পক্ষ থেকে জানানো হচ্ছে, ক্রমাগত ৫ মাস বিশ্ববাজারে তেলের দাম বেশি থাকায় তাদের বাধ্য হয়ে জ্বালানি তেলের দাম বাড়াতে হয়েছে। অন্যদিকে গণমাধ্যম জানাচ্ছে, বিগত ৭ বছর বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য কম ছিল। এ সময় ২০১৬ সালে একবার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম সামান্য কমানো ছাড়া জ্বালানি তেলের দাম কমানো হয়নি। এর ফলে বিপিসির লাভ হয়েছে ৪৩ হাজার ১৩৭ কোটি টাকা। লাভের অঙ্ক সরকার নিয়ে নেয়ায় বিপিসির পক্ষে ভর্তুকি মূল্যে জ্বালানি তেল সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। জ্বালানি তেল সরবরাহের দায়িত্ব সরকার তার হাতে রাখে এটি ‘কৌশলগত পণ্য’ বলে। বস্তুত মানুষের কল্যাণে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখাই এ ব্যবস্থার লক্ষ্য, মুনাফা করা নয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে মুনাফাটাই হয়ে ওঠেছে যেন মুখ্য। সরকারের প্রতিনিধিরা দাম বৃদ্ধির কারণ হিসেবে অন্য আরেকটি যুক্তি সামনে আনছেন, তারা বলছেন ভারতে জ্বালানি তেলের মূল্য বেশি থাকায় দেশে পণ্যটির দাম না বাড়ালে তা পাচার হবে সে দেশে। এটি আসলে খোঁড়া যুক্তি। আমাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনী তাহলে আছে কেন? জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব সর্বব্যাপী এ কথা আগেই উল্লেখ করেছি। তবে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে যোগাযোগ ও পরিবহন খাতে। সাধারণ মানুষ আঁচ করতে না পারলেও পরিবহন মালিকরা বোধ করি ঠিকই জানতেন এ খবর। যে কারণে সঙ্গে সঙ্গেই তারা মানুষকে জিম্মি করে বিনা নোটিসে ধর্মঘটে যান। বিষয়টিকে অনেকে পাতানো খেলা বলছেন। হতেই পারে সেটি, কেননা সরকারি দলের লোকজনই পরিবহন খাতের নেতা। তিনদিন টানা মানুষকে দুর্ভোগে রেখে বর্ধিত ভাড়া আদায় করে নিলেন তারা। তবে বরাবরের মতোই যা আদায় করা হলো তা ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির হার বিচারে বেশি। দূরপাল্লার বাসে ভাড়া বৃদ্ধির হার ২৬ দশমিক ৭৬ শতাংশ। লঞ্চভাড়া বৃদ্ধির হার আরো বেশি, ৩৫ দশমিক ২৯ শতাংশ। বলা নিষ্প্রয়োজন, ঢাকা-চট্টগ্রামের অভ্যন্তরীণ রুটেও বাসভাড়া সমানতালে বেড়েছে। এরপর অবশ্য শুরু হবে খুশিমতো ভাড়া আদায়ের খেলা। যাত্রীদের সহিত পরিবহন শ্রমিকদের বিবাদবিসম্বাদ হবে, তবে যাত্রীরা জিতবেন না, জিতবে শেষ পর্যন্ত পরিবহন শ্রমিকরাই। এটিই ভোক্তাদের নিয়তি এদেশে। ট্রাক-কাভার্ডভ্যান-লরি ইত্যাদির ভাড়া সরকার নির্ধারণ করে দেয় না, দর কষাকষির মাধ্যমে স্থির হয়। ওতে গ্রাহক ঠকবেন নিশ্চিত। দায় শেষতক গিয়ে পড়বে সমগ্র জনগোষ্ঠীর ওপর। মূল্যস্তর বাড়বে সর্বক্ষেত্রে। আরেক দফা চাপে পড়বে মানুষ। গরিব ও সীমিত আয়ের মানুষজনের অস্তিত্বে টান পড়বে। বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণভোমরা এখনো কৃষি খাত। মেধা-শ্রমের সম্মিলনে কৃষকসমাজ বলতে গেলে বিপ্লব সাধন করেছে দেশে। স্বাধীনতা পূর্বকালে যেখানে ১ কোটি টন খাদ্যশস্যও উৎপাদিত হতো না, এখন সেখানে হচ্ছে প্রায় সাড়ে ৪ কোটি টন। এর পেছনে অবশ্য কৃষি বিজ্ঞানীদের অবদান আছে, তারা ফসলের বিভিন্ন জাত উদ্ভাবন করে কৃষকদের দোরগোড়ায় নিয়ে গেছেন, কৃষকসমাজ সযতেœ তা গ্রহণ করে উৎপাদন বাড়িয়েছে। নতুন প্রযুক্তিও তারা হাত পেতে নিয়েছেন। অস্বীকার করি না, সরকারও কৃষির ব্যাপারে অনেকটা সংবেদনশীল; উপকরণ ও যন্ত্রপাতির ওপর ভর্তুকির ব্যবস্থা রেখে তারা কৃষকদের সহায়তা করছে। ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধিতে এই কৃষি চাপে পড়বে। প্রাপ্ত তথ্যমতে জ্বালানি তেলের ১৬ শতাংশ ব্যবহৃত হয় কৃষি খাতে। সেচকার্য, ট্রাক্টর-হারভেস্টর-শ্যালো মেশিন ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি ব্যবহারের জন্য ডিজেল আবশ্যক। এই ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি উৎপাদন খরচ বাড়াবে। বিশেষজ্ঞরা হিসাব কষে দেখিয়েছেন শুধু আসন্ন বোরো মৌসুমেই কৃষকের খরচ বাড়বে ৭৫৭ কোটি টাকা। কৃষি খাত এমনিতেই সমস্যাগ্রস্ত; কৃষিশ্রমিকের দুষ্প্রাপ্যতা দিন দিন প্রকট হচ্ছে, উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া পুরনো ইস্যু। এক বছর মূল্য যৌক্তিক হয় তো অন্য বছর হয় না। তদুপরি আছে সামাজিক সমস্যা, অন্যসব পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেলে যতটা হইচই হয়, চালের মূল্য সামান্য বাড়লেও তার চেয়ে অনেক বেশি হা-পিত্যেশ শুরু হয়ে যায়। গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বিদ্যুতের যে সক্ষমতা তৈরি হয়েছে তার ৩২ শতাংশ জ্বালানি তেলনির্ভর, এর ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যয় বাড়বে। ভোক্তা পর্যায়ে যদি এর দায় পড়ে তাহলে বিরূপ প্রভাব পড়বে জনজীবনের সর্বত্র। গ্যাস সংযোগ বন্ধ থাকায় এলপিজির ব্যবহার বেড়েছে। পণ্যটি এখন আর কেবল শহরের নয়, গ্রামেরও। গ্রামের বাড়িঘর, হাটবাজারে এর ব্যবহার দ্রুতলয়ে বাড়ছে। রান্নায় কাঠ-কয়লার ব্যবহার ওঠে যাচ্ছে, যা পরিবেশসম্মত। সেই এলপিজির মূল্যও বাড়ানো হয়েছে। সবমিলিয়ে এক অস্বস্তিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে জনজীবনে, জীবনযাত্রায় চাপ পড়ছে অসহনীয় মাত্রায়। আশা করব সরকার মানুষের বিপন্ন অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে সিদ্ধান্ত বদলাবে, খরচ সংকুলান করতে না পারলে দু’চারটা মেগা প্রকল্প থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সাধারণ মানুষের দিকে তাকাবে, ‘কৌশলগত পণ্যে’ ভর্তুকির ব্যবস্থা করবে। জ্বালানি তেলের মূল্য করোনাকালে বাড়াতে হতো না, যদি না সরকার বিগত সাত বছরে করা লাভের অঙ্কের কিয়দাংশ ফেরত দিত।

মজিবর রহমান : কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App