×

জাতীয়

নেতৃত্বের বিরোধে দিশাহারা তৃণমূল, সংগঠনেও স্থবিরতা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২১, ০৮:৩০ এএম

সরকারবিরোধী আন্দোলনে রাজপথে থাকবে এবং দলের জন্য ত্যাগ ও আদর্শের মূল্য দেবে- এমন বার্তা নিয়েই তৃণমূল গোছানোর উদ্যোগ নিয়েছে বিএনপি। এ বার্তায় নড়েচড়ে বসেছে সারাদেশে দলের নেতাকর্মীরাও। কেন্দ্রের নির্দেশে ঢেলে সাজানো হচ্ছে সংগঠন। ত্যাগী, পরীক্ষিত ও দুঃসময়ের নেতাকর্মীদের প্রাধান্য দিয়ে জেলা, উপজেলা ও ওয়ার্ড কমিটিগুলো সাজানো হচ্ছে নতুনভাবে। তবে দীর্ঘদিন ধরে সম্মেলন না হওয়ায় প্রকাশ পাচ্ছে প্রতিটি জেলায় নেতৃত্বের শূন্যতা ও সাংগঠনিক স্থবিরতা।

বছরের পর বছর ধরে একই কমিটি এবং স্থানীয় ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে লিয়াজোঁ করে চলার কারণে এক সময় বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত রাজশাহী এখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দখলে। ভেঙে পড়েছে ‘চেইন অব কমান্ড’। জেলাগুলোয় পূর্ণাঙ্গ কমিটি না থাকায় সাংগঠনিকভাবে শক্ত ভিত গড়ে তুলতে পারছে না রাজশাহী বিএনপি। তিন মেয়াদ ধরে এ বিভাগের ৬টি সংসদীয় আসনই হাতছাড়া বিএনপির। এছাড়া রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়রের পদও এখন ক্ষমতাসীনদের দখলে। এ বিভাগে বিএনপির ৯ জেলা ও এক মহানগর। কেবল সিরাজগঞ্জ এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় রয়েছে পূর্ণাঙ্গ কমিটি। এছাড়া সব জেলা কমিটি ভেঙে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে। নতুন পূর্ণাঙ্গ কমিটি নেই, তাই কোনো সম্মেলনও হয়নি।

রাজশাহী বিভাগের সাংগঠনিক টিমের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা জানান, ৫৬ উপজেলার সম্মেলন নিয়ে কাজ করছেন টিমের সদস্যরা। এর আগে ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে জেলা-উপজেলা সম্মেলনের লক্ষ্য নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন কেন্দ্রীয় নেতারা। কিন্তু তৃণমূলে অভ্যন্তরীণ দ্ব›দ্ব, ক্ষোভ-বিক্ষোভ আর পাল্টাপাল্টি কমিটি গঠনের কারণে বিভাগীয় পর্যায়ে কমিটি গঠনের কাজ শেষ করা যায়নি। ২০১৬ সালে ষষ্ঠ কাউন্সিলের পর আরেক দফা উদ্যোগ নিলেও একই দ্বন্দ্বের কারণে কমিটি পুনর্গঠন শেষ হয়নি। দুই বছর মেয়াদি মহানগর বিএনপির কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০১৮ সালের ২৭ ডিসেম্বর। অথচ এখনো পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতে পারেনি। এরপর গত ১৭ সেপ্টেম্বর দলের নির্বাহী কমিটির ধারাবাহিক বৈঠকের পর গতি ফিরেছে পুনর্গঠনে।

জানতে চাইলে বিএনপির রাজশাহী বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু ভোরের কাগজকে বলেন, আমার বিভাগে ৯ জেলা এবং ১টি মহানগর। এর মধ্যে সিরাজগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহী মহানগরে পূর্ণাঙ্গ কমিটি রয়েছে। বাকি সব জেলা আহ্বায়ক কমিটিতে চলছে। তবে নতুন কমিটি গঠনের জন্য সব চূড়ান্ত। প্রতিটি থানা ও পৌরসভায় কর্মিসভা হচ্ছে। আশা করছি কেন্দ্রের বেঁধে দেয়া সময়- আগামী ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যেই পুনর্গঠন শেষ করতে পারব।

নাটোরে উপজেলা ও পৌর কমিটিতে মৃত ব্যক্তির নাম! : রাজশাহী বিভাগে নাটোরের বাগাতিপাড়ায় নবগঠিত উপজেলা ও পৌর এবং গোপালপুর পৌর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটিতে মৃত ব্যক্তিদের পদ দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। কমিটিতে আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠজন বাগাতিপাড়া পৌর মেয়র মোশাররফ হোসেনকে আহ্বায়ক ও হাফিজুর রহমানকে সদস্য সচিব করে যে উপজেলা কমিটি গঠন করা হয়েছে, সেখানে মৃত ব্যক্তি আজিজুল হককে ২৫ নম্বর ক্রমিকে রাখা হয়েছে। এছাড়া জামাল হোসেনকে আহ্বায়ক ও মাইনুল ইসলামকে সদস্য সচিব করে গঠিত পৌর কমিটিতে ৩১ নম্বর ক্রমিকে থাকা আহাদ আলী মৃত।

আজিজুল হকের ছোট ভাই হাফিজুর রহমান জানান, তার ভাই গত ১২ ফেব্রুয়ারি মারা গেছেন। অন্যদিকে আহাদ আলীর ছেলে মেহেদী হাসান জানান, তার বাবা ২০১৯ সালের ২৮ অক্টোবর মারা গেছেন। এসব কমিটি গঠনে দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন নবী খান সোহেল।

কমিটি গঠনের পর পরই তা বাতিলের দাবিতে স্থানীয় নেতারা সংবাদ সম্মেলন ও মানববন্ধন করেছেন। উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি গোলাম মোস্তফা নয়ন বলেন, দীর্ঘদিন ধরে নিষ্ক্রিয় নেতাদের দিয়ে কমিটি দেয়া হয়েছে। গোপালপুর পৌর বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক শাহীনুর আলম বলেন, নবগঠিত গোপালপুর পৌর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটিতেও মৃত ব্যক্তিকে পদ দেয়া হয়েছে। এছাড়া পৌর কমিটির সদস্য সচিব করা হয়েছে জিল্লুর রহমানকে, যিনি এর আগে দলের কোনো পদে ছিলেন না। তিনি বছরের বেশির ভাগ সময় ব্যবসার কাজে সৌদি আরব থাকেন। জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, জেলা কমিটি গঠনে কিছু ভুলত্রুটি হতে পারে। অভিযোগ পেলে দল থেকে ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিছু কমিটি নিয়ে অভিযোগ ওঠার পর ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে ইতোমধ্যে। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে হাবিব-উন নবী সোহেল বলেন, পক্ষ-বিপক্ষ থাকলে নানা অভিযোগ আসে। চারটি কমিটির মধ্যে একজনের বিষয়ে শুনেছি তিনি মৃত, তিনজন নয়। দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কমিটি দেয়া হয়েছে। করোনার মধ্যে একজন মারা যেতে পারেন।

উপদলে বিভক্ত জেলা বিএনপি : অন্তর্দ্বন্দ্ব ও কোন্দলে জর্জরিত রাজশাহীর প্রতিটি আসনেই সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য দল, উপদল। পবা, বাগমারা, পুঠিয়া, দুর্গাপুর, তানোর, গোদাগাড়ী, চারঘাট, বাঘা উপজেলা ও পৌর বিএনপির কমিটিগুলোতেও দ্ব›দ্ব ছড়িয়ে পড়েছে। এসব তৃণমূল সাংগঠনিক ইউনিটের নেতাকর্মীরা কেউই একসঙ্গে কোনো কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন না। অনেক জায়গাতেই নেতাকর্মীরা দুই বা তার অধিক গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পৃথকভাবে কর্মসূচি পালন করে আসছেন। এতে দলের ভেতরের সংহতি বিনষ্টের পাশাপাশি বেড়েছে বিভক্তি।

স্থানীয় নেতারা জানান, গত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর এ বিভাগের বেশির ভাগ জেলায় বিএনপির দলীয় রাজনীতি অনেকটাই নিষ্ক্রিয় অবস্থায় রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে সাংগঠনিক কার্যক্রম না থাকলেও রাজশাহী মহানগর ও জেলা বিএনপি একাধিক ভাগে বিভক্ত। নগর বিএনপি বর্তমানে দুটি বলয়ে বিভক্ত। একদিকে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মিজানুর রহমান মিনু ও নগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শফিকুল হক মিলন।

তাদের ঠিক বিপরীত মেরুতে অবস্থান নগর বিএনপি সভাপতি মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলের। নগর বিএনপিতে মিনু ও মিলন দলীয় কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে দল এবং সংগঠনকে চাঙ্গা রাখার চেষ্টা করলেও মোসাদ্দেক হোসেনের বলয় অনেকটাই নিষ্ক্রিয়। অন্যদিকে এক সময়ের দাপুটে নেতা, জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি নাদিম মোস্তফাকে সরিয়ে সেখানে তোফাজ্জল হোসেন তপু ও মতিউর রহমান মন্টুর যে নেতৃত্ব চলে আসছিল, সেখানেও তাদের সাংগঠনিক দক্ষতা নিয়ে নেতাকর্মীদের রয়েছে নানা অভিযোগ। এসব বিষয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মিজানুর রহমান মিনু অবশ্য দাবি করেছেন, রাজশাহী বিএনপির রাজনীতিতে কোনো বিরোধ নেই। কমিটি পুনর্গঠনে সবাই মিলে সমন্বয় করে কাজ করছেন।

নওগাঁয় ঘাঁটিহারা বিএনপি : রাজশাহী বিভাগের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ জেলা নওগাঁ। এ জেলায় রয়েছে ছয়টি সংসদীয় আসন, ১১টি উপজেলা ও তিনটি পৌরসভা। এই জেলার পরিচয় ছিল ‘বিএনপির ঘাঁটি’ নামে; কিন্তু সেই দিন আর নেই। দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি নেতাকর্মীরা এ জেলায় ঝিমিয়ে পড়েছেন। তৃণমূল নেতাকর্মীদের অভিযোগ, জেলা বিএনপির প্রথম সারির নেতারা দুটি গ্রুপে বিভক্ত হওয়ার ফলে শক্ত অবস্থানে যেতে পারছেন না তারা। নেতাদের ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে মামলা-মোকদ্দমায় পড়লে পরবর্তী সময়ে তাদের আর খোঁজখবর রাখছেন না কেউ। নওগাঁ-১ আসনের সাবেক এমপি সালেক চৌধুরী ও জেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি মোস্তাফিজুর রহমানের দুটি গ্রুপ পরস্পরের বিরুদ্ধে সক্রিয়। এ আসনের তিনটি উপজেলা সাপাহার, পোরশা ও নিয়ামতপুর। এর মধ্যে কোনো উপজেলায় বিএনপি পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতে পারেনি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App