×

মুক্তচিন্তা

দাম বাড়ে সব কিছুর আয় বাড়ে না অনেকেরই

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২১, ০১:০২ এএম

রাজনীতি নিয়ে মাতামাতি করার মুড নেই সাধারণ মানুষের। তারা বরং এখন মুণ্ডপাত করেন রাজনীতিবিদদের এবং নিজের কপাল নিজে চাপড়ে সান্ত¡না খোঁজার চেষ্টা করেন। রাজনৈতিক দলের নেতারা একে অপরের বিরুদ্ধে কথা বলতে ওস্তাদ কিন্তু বাজারে যে আগুন লেগেছে, যার তাপে ঝলসে যাচ্ছে কোটি কোটি মানুষের জীবন, তা নিয়ে রাজনীতিবিদদের মাথাব্যথা নেই। কেউ টুঁ শব্দটি করছেন না। যারা দাম বাড়ানোর নেপথ্য নায়ক তারা বাইরে যে যে দলই করুন না কেন, ভেতরে ভেতরে তারা এক, তাদের স্বার্থ এক, লাভের স্বার্থ, মুনাফার স্বার্থ। এই স্বার্থ রক্ষার প্রশ্নে তাদের মধ্যে ঐক্য হয় নীরবে। আওয়ামী লীগ সমর্থক ব্যবসায়ী ও বাস মালিক এবং বিএনপি সমর্থক ব্যবসায়ী, বাস মালিকের মধ্যে কোনো প্রার্থক্য আছে কি? সম্ভবত এজন্যই জিনিসপত্রের দাম বাড়লে আওয়ামী লীগ যেমন চুপ থাকে, বিএনপিও দায়সারাভাবে বিবৃতি দিয়ে কাজ শেষ করে। বিএনপি দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বিরুদ্ধে যতটা না সোচ্চার তার চেয়ে বেশি সোচ্চার খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে। প্রশ্ন হলো, মানুষ কি খালেদা জিয়াকে নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন, না নিজের জীবন কীভাবে রক্ষা হবে তা নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন? কোনো আগাম ঘোষণা না দিয়ে সরকার ডিজেল ও কেরোসিন তেলের দাম বাড়িয়েছে প্রতি লিটারে ১৫ টাকা। ৬৫ টাকার তেল এখন হয়েছে ৮০ টাকা। দাম বাড়ানোর খবর শোনামাত্র বাস মালিকরা পরিবহন চলাচল বন্ধ করে বসেন। তিন দিন বেআইনি ধর্মঘট করে সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসে বাস ভাড়া বাড়িয়ে তারা প্রীত হয়েছেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ, যারা বাসে চলাচল করেন তাদের অবস্থা এখন কী দাঁড়াবে? যে মানুষটির যাতায়াত বাবদ আগে মাসে ব্যয় হতো ১ হাজার ৮০০ টাকা, তাকে এখন হবে কমপক্ষে ২ হাজার ৪০০ টাকা। এই বাড়তি ৬০০ টাকা কোথা থেকে তিনি পাবেন? তার কি বেতন বাড়বে? একবারে হুট করে ডিজেল-কেরোসিনের দাম এতটা বাড়ানো হয়েছে, যার ধাক্কা সামাল দেয়া সাধারণ মানুষের জন্য দুঃসহ হয়ে উঠেছে। দাম বাড়ানোর পক্ষে সরকারের যুক্তি হলো, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়ায় গত ৫ মাসে সরকারের হাজার কোটি টাকার বেশি লোকসান হয়েছে। আর লোকসান গোনা সম্ভব নয়। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে সরকার বুঝি ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ীরা কোনো কিছু কেনার দাম বাড়লে বিক্রির দামও সঙ্গে সঙ্গে বাড়িয়ে দেয়। এমনকি আগের কেনা পণ্যের দাম বাড়ার খবর শুনলেও দাম বাড়িয়ে বাড়তি মুনাফা হাতিয়ে নেয়া জাত ব্যবসায়ীদের জন্য স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু সরকার তো আর ব্যবসায়ী নয়। সব ব্যাপারে লাভ-ক্ষতির টাকাআনাপাই হিসাব করে সরকার চলতে পারে না। দেশের মানুষের প্রতি সরকারের দায়দায়িত্ব থাকে। মানুষের সুবিধা-অসুবিধার কথা বিবেচনায় নিয়ে সরকারকে অনেক সময় ভর্তুকিও দিতে হয়। কৃষকদের উৎপাদন বাড়ানোর কাজে উৎসাহ জোগাতে সার, বীজসহ কৃষি উপকরণে ভর্তুকি তো বর্তমান সরকারও দিয়েছে। তাহলে এবার আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়ার অজুহাতে তেলের দাম এতটা বাড়ানো হলো কেন? এই দাম বাড়ানোর জন্য যে সাধারণ মানুষের জীবনে কত বড় দুর্ভোগ নেমে আসবে, তা কি সরকারের নীতিনির্ধারকরা বিবেচনায় নিয়েছেন? হয়তো বলা হবে, এভাবে লোকসান গুনতে হলে তো সরকারের উন্নয়ন তৎপরতা ব্যাহত হবে। সরকারকেও তো সরকারের ভালো-মন্দ ভাবতে হবে। কথা মিথ্যা নয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যখন আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমেছিল, তখন তো সরকার দাম কমানোর কথা ভাবেনি। গত কয় বছরে যে হাজার হাজার কোটি টাকা লাভ ঘরে তোলা হয়েছে তা থেকে ভর্তুকি দিয়ে কি সাধারণ মানুষের ওপর চাপ কমানো যেত না? নাকি সাধারণ জনগণের স্বার্থের বিষয়টি বিবেচনা করা সরকার আর জরুরি মনে করছে না? তেলের দাম বাড়ানোর অনেক প্রতিক্রিয়া আছে। এর প্রভাব বহু বিস্তৃত। দাম বাড়ার ঘোষণা শুনেই দেশে কোনো পূর্ব নোটিস ছাড়াই বাস-ট্রাকসহ তেলচালিত পরিবহন ধর্মঘট শুরু হয়েছে। এতে মানুষের জন্য দুঃসহ অবস্থা তৈরি হয়েছে। মানুষ এই অবস্থার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না। তিন দিনের ধর্মঘটে কত মানুষ কতভাবে কত রকম সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন, তা জানাবোঝার চেষ্টা কি একবার সরকার করে দেখবে? পরিবহন মালিকরা তো প্রতিদিনই লাভ করেন। ধর্মঘটের জন্য ২-৪ সময় দিয়ে নোটিস দিলে এমন ক্ষতি কি হতো যার জন্য পরিবহন মালিকদের অনাহারে থাকতে হতো? দাম বাড়িয়েছে সরকার। তাহলে সরকারের ওপর চাপ তৈরির উপায় বের না করে সাধারণ মানুষের ওপর দুর্বিষহ অবস্থা চাপিয়ে দেয়া হলো কেন? সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে পরিবহন মালিকদের এই আচরণ নিন্দনীয়ই শুধু নয়, বরং এটা একটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু সরকার পরিবহন মালিকদের শায়েস্তা না করে তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসে পরিবহন ভাড়া বাড়িয়ে বেপরোয়া মালিকদেরই স্বার্থ রক্ষা করল। এতে কি সরকারের জনবান্ধন রূপ ফুটে উঠল? শুধু বাস বা লঞ্চ কিংবা ট্রাকের ভাড়া বাড়ানোর প্রভাব পড়বে বাজারে। নিত্যপণ্যের বাজার কয়েক মাস ধরেই অস্থির। সব জিনিসের দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। এখন পরিবহন ভাড়া বাড়ার অজুহাতে আরেক দফা দাম বাড়বে সব জিনিসপত্রের। কাঁচা বাজারে প্রভাব এর মধ্যেই লক্ষ করা যাচ্ছে। একটি ফুলকপির দাম বেড়েছে ১৫ টাকা। যা কিছুই কিনতে যাওয়া যাবে, তারই দাম চড়া। এতে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে। মূল্যস্ফীতি ঘটবে। বাজার এবং পরিবহন খাতে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। ফলে সব ধাক্কা যাবে ভোক্তা তথা সাধারণ মানুষের ওপর দিয়ে। প্রশ্ন হলো, মানুষের কি এত ধাক্কা সামাল দেয়ার অবস্থা আছে? বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে একটি সাধারণ পদে চাকরি করা একজন মানুষ বলেছেন, তেলের ভাড়া বাড়ার অজুহাতে বাসের ভাড়া যেটা বাড়ানো হয়েছে, যাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে তার চেয়েও বেশি। এটা দেখা কি সরকারের দায়িত্ব নয়? সরকার কি শুধু মালিকদের স্বার্থ দেখবে? তাহলে সাধারণ মানুষের স্বার্থ কে দেখবে? গত পৌনে দুই বছরে করোনার কারণে এমনিতেই দেশের বেশিরভাগ মানুষের জীবন নানা কারণে অনিরাপদ হয়ে পড়েছে। অনেক মানুষ আয়-উপার্জনহীন হয়েছেন। বেকার হয়েছেন। বেঁচে থাকার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন কোনোভাবে। একটি গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে, করোনাকালে দেশে ৩ কোটি ২৪ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন। দারিদ্র্যের হার দাঁড়িয়েছে ৪২ শতাংশ, যা ২০১৯ সালের তুলনায় দ্বিগুণ। এখন এই গরিব মানুষ জিনিসপত্রের দাম বাড়ানোর চাপ সহ্য করবে কীভাবে? ব্যয় বাড়বে অথচ আয় বাড়ার তো কোনো উপায় বা ব্যবস্থা নেই। যাদের আছে তাদের জন্য সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা আছে। কিন্তু যাদের নেই তাদের কী হবে? কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর হিসাব অনুযায়ী ডিজেলের দাম বাড়ায় এবার বোরো মৌসুমে সেচ বাবদ কৃষকদের বাড়তি খরচ হবে ৭৫৭ কোটি টাকার মতো। কারণ দেশের ৭০ শতাংশ জমির চাষ ডিজেলচালিত সেচযন্ত্রনির্ভর। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের হিসাবে বিঘাপ্রতি সেচের জন্য বাড়তি খরচ জুগিয়ে ধান বিক্রিতে ৩ শতাংশ মুনাফা কমবে কৃষকদের। এর ফলে সামগ্রিকভাবে গ্রামীণ অর্থনীতিতে প্রভাব পড়বে। ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়ানোর আগে যদি এর প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি গভীরভাবে বিবেচনা করা হতো তাহলে সরকার হয়তো এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্তটি না-ও নিতে পারত। কিন্তু একবার দাম বাড়িয়ে আবার কমানোর অতীত কোনো নজির না পাওয়ায় এটা মনে হচ্ছে তেলের দাম আর কমবে না। জিনিসপত্রের দামও আর কমবে বলে মনে হয় না। শেষ করতে চাই একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত একজন দোকান কর্মচারীর কথা দিয়ে। তিনি বলেছেন, ত্যালের দাম বাড়ছে, বাসের ভাড়া বাড়ল। চাল, ডাল সবকিছুরই তো দাম বাড়ে। কমে শুধু আমাগো আয়। গলায় দড়ি দিয়া মরতে পারলে বাঁইচা যাইতাম। মানুষকে যদি এভাবে মৃত্যু চিন্তা করতে হয় তাহলে দেশ নিয়ে আশাবাদী হওয়ার কারণ থাকে কি? গরিব, কম আয়ের, সীমিত আয়ের মানুষের বেঁচে থাকার উপায় করে দিতে না পারলেও মানুষ কি সরকারের ওপর তুষ্ট থাকবে? পেট খালি থাকলে মধুর বচনও শুনতে ভালো লাগে না। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা বিষয়টি ভেবে দেখলে ভালো করবেন। পেটে ক্ষুধা নিয়ে মানুষ উন্নয়নবার্তা শুনে উল্লসিত না হয়ে বিরক্ত হবে। জনগণের কথা বিবেচনায় নিয়ে রাজনীতির দিকে মুখ না ফেরালে অনেক রাজনৈতিক দলই হয়তো মানুষের কাছ থেকে দূরে যাবে এবং রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিকতা হারাবে।

বিভুরঞ্জন সরকার : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App