×

মুক্তচিন্তা

রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় ও শাহজাদপুরবাসীর দুঃখ

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৬ নভেম্বর ২০২১, ১২:৩৯ এএম

রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় ও শাহজাদপুরবাসীর দুঃখ

সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুরে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বহুবার এসেছেন। যতবারই কবি এসেছেন, ততবারই অনেকদিন করে শাহজাদপুরে অবস্থান করেছেন। শাহজাদপুর বসে বিশ্বকবি বহু কবিতা, গল্প, গান আর চিঠি লিখেছেন। কবি শাহজাদপুরে আসতেন শুধু জমিদারি দেখার জন্য নয়, তিনি মূলত ঘন ঘন আসতেন কবিতা, গান আর গল্প লেখার জন্য। কবি স্বীকার করেছেন শাহজাদপুর এলে তার লেখার কাব্যভাব, সাহিত্যানুভূতির সৃষ্টি হয়। কলকাতা বসে কবিতা, গল্প লেখার এত উপাদান কবি পেতেন না। শাহজাদপুর এলাকায় কবি নৌকা নিয়ে ছোট ছোট নদীতে ঘুরতেন আর কবিতা লিখতেন। কবি শাহজাদপুরকে সখী হিসেবে আখ্যা দিয়ে শেষবারের মতো যাওয়ার সময় একটি গানও লিখেছেন। শাহজাদপুরবাসী বড়ই সৌভাগ্যবান যে, বিশ্বকবি শাহজাদপুর থেকেছেন এবং শাহজাদপুরের কুঠিবাড়িতে বসে কবি অনেক লেখা বিশ্বকে উপহার দিয়েছেন। শাহজাদপুরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামটি চাঁদের মতো উজ্জ্বল আর ঝলমলে করে রাখার জন্য রবীন্দ্র স্মৃতিবিজড়িত শাহজাদপুরবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি ছিল শাহজাদপুরে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার। সেই দাবির প্রতি সম্মান রেখে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শাহজাদপুরে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। ঘোষণার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই গত পাঁচ বছর আগে বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত হয় শাহজাদপুরে স্বপ্নের রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়। শাহজাদপুরে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এজন্য শাহজাদপুরবাসীর আনন্দের অন্ত নেই। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় দেখভাল করার দায়িত্বে যারা আছেন তাদের অবহেলা আর উদাসীনতার কারণে গত পাঁচ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন দৃশ্যমান কিছু দেখতে না পেরে আমরা হতাশায় দীর্ঘশ্বাস ফেলছি। শাহজাদপুরে ভাড়া বাড়িতে অফিস, ক্লাস আর দেখতে ইচ্ছে করে না। আমাদের মন জুড়ায় না। সাবেক ভিসি শাহজাদপুরে বিশ্ববিদ্যালয় রেখে রাজধানীতে আরাম-আয়েশে জীবন-যাপন করেছেন এ অবস্থা দেখে মনে খটকা লাগত তিনি কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি? প্রকৃতপক্ষে প্রত্যক্ষদর্শী শাহজাদপুরবাসী মনে করেন যে, ঐতিহ্যবাহী রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভিসি এবং বর্তমান রেজিস্ট্রারের অবহেলা আর অদক্ষতার কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়ের এত দুর্গতি। তারা সদ্য প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের চেয়ে নিজেদের উন্নতির কথা চিন্তা করেছেন বেশি। তারা দুজন মিলে নামেমাত্র পরীক্ষা নিয়ে তাদের ইচ্ছেমতো অনেক অযোগ্য শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীকে নিয়োগ দিয়েছেন। আর তার কুফল ভোগ করছে অধ্যয়নরত ছাত্ররা। মূলত তারা দুজন এবং তাদের সহযোগী দুয়েকজনের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় পিছিয়ে গেছে অনেকখানি। রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হওয়ার পেছনে একটি ইতিহাস আছে, আছে শাহজাদপুরবাসীর অনেক অবদান। আছে অনেকের ঘাম আর অনেকের মেধা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কয়েক বছর আগে বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সেই কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন শাহজাদপুরের কৃতী সন্তান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি, শিক্ষাবিদ ড. আবদুল খালেক। আর সদস্য সচিব ছিলেন শিক্ষাবিদ, লেখক ও রবীন্দ্র গবেষক নাছিম উদ্দিন মালিথা। মালিথা স্যার এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হওয়ায় যারপর নেই খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু কয়েক মাস আগে তিনি না ফেরার দেশে চলে গেলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি এবং রেজিস্টারের ওপর অনেকখানি অভিমান নিয়ে। কারণ রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই তার বাসা অথচ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর পাঁচ বছরেও বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউই তার কোনো খোঁজ নেননি, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের চায়ের কাপে এক কাপ চা খেতেও পারেননি। এই কষ্টের কথা আমার সঙ্গে অনেকবার গল্প করেছেন, আর দুচোখ দিয়ে পানি ফেলেছেন। কারণ এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি অনেক মূল্যবান সময় ব্যয় করেছেন আর অনেক মিটিং এবং মানববন্ধন করেছেন। তবে খুশির কথা বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক এখনো জীবিত আছেন। তিনি হলেন শাহজাদপুরের কৃতী সন্তান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি, প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা এবং শিক্ষা ও মানবসম্পদ উপ-কমিটির চেয়ারম্যান, শিক্ষাবিদ ড. আবদুল খালেক। তিনি নিজেও একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হিসেবে কর্মরত আছেন। কিন্তু তার মনে থেকে গেছে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে অনেক দুঃখ এবং হতাশা। কারণ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ব্যাপারেই তার কোনো পরামর্শ নেয়া হয় না। তাকে কোনো অনুষ্ঠানে দাওয়াত পর্যন্ত করা হয় না। শাহজাদপুরবাসীর দুঃখ- এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য যিনি এত শ্রম দিলেন, এত লেখালেখি করলেন, মিটিং করলেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শুভাকাক্সক্ষী ছিলেন অথচ তার মতো অভিজ্ঞ এবং প্রবীণ শিক্ষাবিদকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো কমিটিতে রাখা হয়নি। অথচ তিনি আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা এবং আওয়ামী লীগের শিক্ষা ও মানবসম্পদ উপ-কমিটির চেয়ারম্যান। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অথচ তার মতো অভিজ্ঞ এবং প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও শিক্ষাবিদের পরামর্শ নিলে আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক কঠিন সমস্যাই সহজে সমাধা হতো। কিন্তু যারা ন্যায় ও সৎ চিন্তা করেন না, তারা ভালো মানুষের পরামর্শ নেবেন না এবং ভালো মানুষ থেকে অনেক দূরেই থাকেন। আজ সদ্য প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ে সমস্যার শেষ নেই। গত কয়েকদিন আগের ঘটনাই বলি, ক্লাস চলাকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর ফারহানা ইয়াসমিন বাতেন শিক্ষার্থীদের চুল বড় রাখার বিষয়ে বকাঝকা করেন। তার ভয়ে সবাই পরদিনই চুল ছোট করে আসে। অথচ গত ২৬ সেপ্টেম্বর দুপুরে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বাংলাদেশ অধ্যয়ন বিভাগের প্রথম বর্ষের রাষ্ট্রবিজ্ঞান পরিচিতি বিষয়ের ফাইনাল পরীক্ষা হলে ঢোকার সময় অভিযুক্ত শিক্ষক কাঁচি হাতে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন। এ সময় যেসব শিক্ষার্থীর মাথার চুল হাতের মুঠোর মধ্যে ধরা যায় এমন ১৪ শিক্ষার্থীর মাথার সামনের দিকের চুল শিক্ষক ফারহানা ইয়াসমিন বাতেন নিজ হাতে কাঁচি দিয়ে কেটে দেন। এ ঘটনায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এই অপমানে ২৭ সেপ্টেম্বর রাতে নাজমুল হাসান তুহিন নামে এক শিক্ষার্থী আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। পরে তাকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ ঘটনায় রাতে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে ভাঙচুর চালান। এ ঘটনার প্রতিবাদে ২৮ সেপ্টেম্বর সকালে শিক্ষার্থীরা তাদের ফাইনাল পরীক্ষা বর্জন করে ক্যাম্পাসে প্রশাসনিক ভবনে তালা ঝুলিয়ে দেন। এ সময় শিক্ষার্থীরা অভিযুক্ত শিক্ষকের অপসারণের দাবি করেন। অপসারণ না হওয়া পর্যন্ত তারা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। সাধারণের প্রশ্ন, বিশ্বকবির ঐতিহ্যবাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন নির্মম ঘটনা, এ লজ্জা রাখব কোথায়? শিক্ষার্থীদের মাথার চুল কাটা কি ভীষণ জরুরি ছিল? একজন শিক্ষক হয়ে কেন এই নির্মম, নিষ্ঠুর ঘটনা ঘটাতে গেলেন? যে প্রকৃতপক্ষে শিক্ষক এবং ছাত্রের অভিভাবক তিনি কখনো এমন কঠিন, কদর্য সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। তার আচরণ কখনই এত নীচ হবে না। তার এমন কর্মকাণ্ড শুধু শিক্ষার্থীদের নয়, আমাদেরও ব্যথিত করেছে এবং রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন ঘটনার কারণে বিশ্বকবির নামেও কলঙ্ক এঁকে দিয়েছেন। তার এরূপ কর্মকাণ্ড দেখে মনে হয় তাকে যারা তত্ত্বাবধান করেন তাদের যথেষ্ট উদাসীনতা ও দুর্বলতা আছে। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো খোঁজ-খবর রাখেন না। তার কথায় কাজে অনেক গরমিল দেখে সন্দেহ হয় ফারহানা ইয়াসমিন বাতেন শিক্ষক হিসেবে কতটুকু যোগ্য। ১৪ জন ছেলের মাথার চুল কেটে দেয়ার সাহস কোথা থেকে পেলেন। তার এই কর্মকাণ্ড এবং ছেলেদের অপমানের ঘটনা জেনেও কর্তৃপক্ষ এই ছেলেদের কথা শুনেছেন এবং ছেলেদের কোনো সান্ত¡না দিয়েছেন বা শিক্ষককে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন এ বিষয়ে পত্র-পত্রিকায় কোনো খবর দেখিনি বা ছেলেদের মুখে শুনিনি। এ ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে যদি কর্তৃপক্ষ এর বিহিত করত বা যথাযথ উদ্যোগ নিত তবে এ ঘটনা এত দূর গড়াত না। কেউ আত্মহত্যার পথ বেছে নিত না এবং বিশ্ববিদ্যালয় আজ বন্ধ হতো না। তবে আল্লাহ অনেক রক্ষা করেছেন, মাথার চুল কাটার অপমানে যদি ১৪ জন ছেলেই আত্মহত্যার পথ বেছে নিত, তাহলে কী ভয়ানক পরিস্থিতিই না দাঁড়াত? অনেকেই মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এ ঘটনার জন্য পুরোটাই দায়ী কর্তৃপক্ষ। আরো সন্দেহ করেন যে, যারা এই শিক্ষককে নিয়োগ দিয়েছেন তারা কতটুকু দেখে আর কীভাবে যাচাই করে নিয়োগ দিয়েছেন? রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। যা ইতোমধ্যে আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। কিন্তু আমরা এর সমাধান চাই। এই অবস্থা চলতে দেয়া যায় না। এর একটা স্থায়ী বিহিত করতে হবে। এজন্য সংশ্লিষ্ট সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

এইচ এস সরোয়ারদী : লেখক ও কথাসাহিত্যিক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App