×

মুক্তচিন্তা

মৌলবাদীদের স্থান নেই বাংলাদেশে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩১ অক্টোবর ২০২১, ১২:৫৩ এএম

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে গৌরবের ও মর্যাদার বাংলাদেশ আজ প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু দেশে হঠাৎ করেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে মৌলবাদী অপশক্তি। অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে পরিবেশ। চারপাশে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প। অস্তিত্ব সংকটে অসাম্প্রদায়িক চেতনা। আবহমানকাল ধরে হাতে হাত রেখে চলেছে বাংলার মুসলিম, বাংলার হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান। বিপদে-আপদে সবাই সবার পাশে থেকেছে। এগিয়ে এসেছে মানবতার ডাকে। একাত্ম হয়েছে উৎসবে, উদযাপনে। কখনো বড় হয়ে আসেনি ধর্মীয় পরিচয়।

স্বাধীনতার পরে যার জন্ম তিনি এখন বাংলাদেশের সমান বয়সি। তার চেতনা, তার রক্ত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের। যার সূচনা করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এমন শোষণমুক্ত আলোকিত বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা তিনি। তার চেতনায় সমুজ্জ্বল আজকের কোটি তরুণ।

‘বাংলাদেশ’ নামক তরুণ আজ বিশ্বসভায় গৌরবের নাম। যারা এক সময় উপহাস করত, তারাই আজ এই দেশকে আদর্শ মানে। উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরে বাংলাদেশকে। উন্নয়নের সঙ্গে দুর্যোগ থেকে রক্ষায়ও মডেল এই দেশ। কিন্তু বারবারই হায়েনাদের থাবায় আক্রান্ত হচ্ছে এ দেশমাতৃকা। ১৯৭১-২০২১- অসংখ্য উদাহরণ আছে দেশকে অস্থিতিশীল করার। যতবারই আক্রান্ত হয়েছে, ততবারই ধ্বংসস্তূপ থেকে ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠেছে এই বাংলাদেশ।

বিশ্বের কোনো ধর্ম কখনো সহিংসতার পক্ষে না বরং তা মানবতাবোধ, শান্তি এবং ভ্রাতৃত্ববোধের পক্ষে। ধর্ম মানুষকে বিবেকবান ও মানবিকতা শেখায়। কখনো হত্যা-সন্ত্রাসকে সমর্থন দেয় না। বরং প্রতিটি ধর্মেরই মূল উদ্দেশ্য হলো সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। জগতের কল্যাণে সবার পাশে থাকা। জীবন ও জীবের প্রতি ভালোবাসাই ধর্মের প্রকৃত অর্থ।

ধর্মের নামে বর্ম তৈরি করে শান্তি স্থাপন না করে সহিংস পথ বেছে নিচ্ছে মৌলবাদী বেশ কিছু সংগঠন। বিশ্বব্যাপী সৃষ্টি করে চলেছে অশান্তি, অরাজকতা ও সন্ত্রাস। ধর্মকে হাতিয়ার করে বিশ্বব্যাপী তারা চালিয়ে যাচ্ছে হত্যাসহ নানা ধরনের সন্ত্রাসী কার্যক্রম।

সম্প্রতি হিন্দু ধর্মের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপূজায় কুরআন রাখাকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে দেখা দিয়েছে অস্থিতিশীল পরিবেশ। এটা তো সবাই জানেন কোনো হিন্দু ধর্মাবলম্বী জেনে বুঝে এই কাজ করবেন না। এর পেছনে কোনো সাম্প্রদায়িক শক্তির হাত রয়েছে। উদ্দেশ্য পরিষ্কার- ধর্ম অবমাননার নামে দুর্বলের ওপর আঘাত করা। বাস্তবে ঘটেছেও তাই। কুমিল্লার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সারাদেশের পূজামণ্ডপ আক্রান্ত হয়েছে। পূজা শেষ হয়নি, তার আগেই প্রতিমা বিসর্জন দিতে হয়েছে।

যারা উদার ও অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধারণ করেন, সবাই তার প্রতিবাদ করছেন। বাঙালির সম্প্রীতির মর্মমূলে যে বন্ধন তাতে কিছুটা অবিশ্বাস ও আস্থা সংকট আসতেই পারে। তবে যে গোষ্ঠী এ কাজটি করেছে তাদের স্বার্থ রক্ষা হবে না। এ দেশ ও সংস্কৃতি যেভাবে সবার অন্তরে মিশে আছে তাতে হয়তো বৃক্ষমূলে আঘাতই করা যাবে, মূল উৎপাটন সম্ভব নয়। আফগানিস্তান বা পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশকে তুলনা যারা করেন, তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। এ দেশ কখনোই এক রাষ্ট্র এক ধর্ম হওয়ার নয়। এই দেশ আউল-বাউল লালনের দেশ। এখানে শুয়ে আছে লক্ষ-কোটি মুক্তি সেনা। তাদের পবিত্র মাটিতে ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর ঠাঁই নেই।

এর আগেও আঘাত এসেছে, যে আঘাতে হয়তো সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান হয়েছে। কিন্তু খুব সহজেই তাদের পতনও ঘটেছে। এতে আরো সাম্প্রদায়িক বন্ধন দৃঢ় হয়েছে। এই ইসলামী মৌলবাদীদের স্থান নেই বাংলাদেশে। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সে শিক্ষাই দেয়।

এই ধর্মান্ধদের বীজ একদিনে প্রোথিত হয়নি। ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান ভাগ থেকেই এর সূত্রপাত। জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বই আজকের মৌলবাদ। সেদিনের পাকিস্তান থেকে ১৯৭১ সাল- তার ধারা এখনো বহমান। স্বাধীনতা সংগ্রাম বা স্বাধীন বাংলাদেশ যারা মেনে নিতে পারেনি, তারাই আজকের অরাজকতা কিংবা অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিরুদ্ধে। তারা সবসময়ই সুযোগ খোঁজে, তাদের এই চক্রান্ত কখনো সরবে, কখনো নীরবে। কিন্তু তা বন্ধ হয়নি বা থেমে থাকেনি। এই মৌলবাদ গোষ্ঠী বারবার লেবাস পরিবর্তন করেছে। সুযোগের অপেক্ষায় থেকেছে। যখন যেখানে সুযোগ পেয়েছে সেখানেই সেই দল বা গোষ্ঠীর কাঁধে চেপেছে।

বিভিন্ন ছদ্মবেশে তারা তাদের প্রচার-প্রসার চালিয়েছে। ব্যক্তি থেকে রাজনৈতিক দল বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা পৃষ্ঠপোষকতা চালিয়েছে। এক্ষেত্রে অনুদানের নামে বিদেশি তহবিল সংগ্রহ করেছে। আবার সেই অর্থ বিলিয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্য করতে গোপনে সাংগঠনিক তৎপরতা বৃদ্ধি করেছে। সাধারণ মানুষের কাছে তাদের পরিচিতি ও দাতব্য কর্মকাণ্ডে নেটওয়ার্ক বিস্তৃৃত করেছে। ধর্মের নামে এ গোষ্ঠী সবকিছুকে ইসলামীকরণ করতে চেয়েছে। জামায়াতের মতো কিছু সংগঠন স্বাধীনতার আগে থেকেই ছিল। আবার কোনোটির জন্ম হয়েছে ১৯৭১ সালের পরে। যারা স্বাধীনতা চায়নি বা পূর্ব পাকিস্তানকে বাংলাদেশ হিসেবে মেনে নিতে পারেনি তারা কিন্তু এদেশ ছেড়ে চলে যায়নি। তারা এদেশেই রয়ে গেছে। দিনে দিনে তাদের শিকড় গজিয়েছে। তাদের বংশধর বা অনুসারীও আনুপাতিক হারে বেড়েছে। কিন্তু তাদের ষড়যন্ত্রও বন্ধ হয়নি। বন্ধ যে হয়নি তার নমুনা স্বাধীনতার পর থেকে আমরা পাচ্ছি। তারা সবকিছুতেই মেরুকরণ করতে চায়। কখনো পারে আবার কখনো ব্যর্থ হয়। কিন্তু তাদের মিশন থেকে সরে যায়নি। তাদের বুকের ভেতরে লুকিয়ে থাকা ‘পাকিস্তানে’র স্বপ্ন এখনো দেখে। দেখে একদিন তালেবানের মতো বাংলাদেশ আফগানিস্তান হবে।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর এক অন্ধকার যুগে পা রাখে বাংলাদেশ। আস্ফালন বাড়ে ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর। ১৯৭৫ সালের পরে পূর্বতন মুসলিম লীগ ছেড়ে যাওয়া নেতারা এদেশের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। গড়েছেন নতুন দল। সেখানে ঠাঁই মিলেছে স্বাধীনতা ও ইসলাম বিদ্বেষীদের। তাদের প্রধান কাজ ছিল ভারত বিরোধিতা করা। একসময় তাদের ছত্রছায়ায় থেকে বিএনপি-জামায়াত প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। রাষ্ট্র ও সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ডে তারা দেশে বিভেদ ও হিংসার রাজনীতি প্রবর্তন করে। ধীরে ধীরে বিএনপি-জামায়াত জোট দেশকে পেছনের দিকে ঠেলে দেয়।

জঙ্গি ও ইসলাম লেবাসধারীদের প্রশ্রয় দিয়ে সারাদেশে ত্রাসের রাজনীতি কায়েম করে। এই বিএনপি জামায়াতের অপশাসনে সারাদেশে একযোগে বোমাবাজি হয়।

শুরু হয় ধর্মের নামে রাজনীতি। যে রাজনীতির কারণে ভাঙতে থাকে সমাজের দেয়াল। মানুষের মধ্যে তৈরি হয় বিভাজন। মুখ থুবড়ে পড়ে সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা। তার বদলে ধর্ম ব্যবসায়ীদের হাতে ওঠে সব কিছুর নিয়ন্ত্রণ।

এই চক্রান্তে ধর্মের নামে রাজনীতি তখনই বন্ধ হবে যখন দেশ আরো উন্নত হবে। শিক্ষায়, সংস্কৃতি ও প্রযুক্তিতে আরো এগিয়ে যাবে দেশ। মানুষকে ধর্মের অপব্যাখ্যা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় জাগ্রত করা যাবে।

অনেকে অভিযোগ করেন, অংশগ্রহণমূলক রাজনীতির অভাবে এমনটি হয়। আসলেই কি তাই? বাংলাদেশে যে অংশগ্রহণমূলক রাজনীতি চলমান তার বড় প্রমাণ গত নির্বাচন। যে নির্বাচনে বিএনপিসহ অধিকাংশ দলই অংশ নেয়। যদি জাতীয় নির্বাচনে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়তে না পারে তার দায় অন্যকে চাপিয়ে লাভ নেই। ২০১৩ সালে হাইকোর্ট জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ বলে ঘোষণা করে, ফলে তাদের কথা আলাদা। কিন্তু তাই বলে তাদের ষড়যন্ত্র থেমে নেই। একের পর এক ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তে ধর্মান্ধ গোষ্ঠী জড়িত।

কারো কারো আশঙ্কা- অংশগ্রহণমূলক রাজনীতির অভাবে এমন সব ইসলামপন্থিদের প্রভাব বাড়ছে যারা তুলনামূলকভাবে অধিকতর রক্ষণশীল। তারা এমন সব বিষয় ও ভাবনা সাধারণ মানুষের কাছে উপস্থাপন করছেন, যা সমাজ ও প্রগতিশীল ভাবনার জন্য বিপজ্জনক। এটা সত্যি বাংলাদেশে ইসলামী ভাবধারার দ্রুত প্রসার হচ্ছে এবং রাজনৈতিক দলগুলো সেই বাস্তবতাকে গ্রহণ করছে। সমাজে ইসলামীকরণ একটি বাস্তবতা, যদিও সেটা নেতিবাচকভাবেই বেশি দেখা হয়। বিশেষ করে ১৯৭৫-এর পর এর ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটেছে। ইসলামী দলগুলো বিভিন্নভাবে রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান নেয়ার চেষ্টা করে। তবে এর দায় অনেকটাই জামায়াত-বিএনপির। কারণ তারা ওই সুবিধাবাদী ও বাঙালি চেতনার বিরুদ্ধ দলগুলোকে তোষামোদ করে মাথায় চড়িয়েছে। এতে তারা নিজেদের মূল্যবান ও দেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভাবতে শুরু করে। এই ভাবনাই আজ অরাজনৈতিক সংগঠন ও ধর্ম ব্যবসায়ীদের ক্ষমতায় বসার স্বপ্ন দেখিয়েছে। রাজনীতি ও সমাজ সেবা এ দুটোকে তারা গুলিয়ে ফেলেছে।

তবে আশার কথা বর্তমান সরকার ও রাজনীতি তাদের বাস্তবের জমিনে নামিয়ে এনেছে। যার ফলে তাদের স্বার্থ ও ক্ষমতায় যাওয়ার চিন্তায় বাধা পড়েছে। এজন্য তারা বাঁকা পথ বেছে নিচ্ছে। দেশকে ঠেলে দিচ্ছে অস্থিতিশীলতার দিকে। কিন্তু দিনশেষে লাভ হবে না। এই দেশের সংগ্রামী মানুষ জানে সংকটে বারবার ঘুরে দাঁড়াতে। সম্প্রীতির বন্ধনকে অটুট রাখতে। তাই মৌলবাদীদের এ আস্ফালন খুব শিগগিরই থেমে যাবে। নিশ্চয়ই শান্ত হবে শ্যামল বাংলা। আবারো শতদল হয়ে ফুটবে অসাম্প্রদায়িক চেতনা।

রমাপ্রসাদ বাবু : লেখক ও সাংবাদিক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App