×

সারাদেশ

বিনা পারিশ্রমিকে হাজারো কিডনি প্রতিস্থাপন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩১ অক্টোবর ২০২১, ০৮:৫৭ পিএম

বিনা পারিশ্রমিকে হাজারো কিডনি প্রতিস্থাপন

ডা: কামরুল ইসলাম

জীবনে কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই মহানমুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন ডা. কামরুলের পিতা শহীদ আমিনুল ইসলাম আমিন। পিতৃহারা সংসার ও জীবনের ঝুকি নিয়ে কামরুলকে পার করতে হয় শিক্ষাজীবন। সীমাহীন প্রতিকূলতার মধ্যেও জীবনযুদ্ধে জয়ী একটি নাম ডা. কামরুল ইসলাম। কিডনী প্রতিস্থাপনে মানবসেবায় এখন উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ঈশ্বরদীর কৃর্তি সন্তান ডা. কামরুল ইসলাম।

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বাবার সম্মানে বিনা পারিশ্রমিকে ১০০৪ টি কিডনী প্রতিস্থাপন ও ফলোআপ করছেন সেন্টার ফর কিডনী ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতাল। ডা. কামরুলের তত্তাবধায়নে প্রায় ১০০ রোগী প্রতিদিন সেবা নিতে আসেন। স্বল্পমূল্যে কিডনী প্রতিস্থাপন ও ফলোআপ করেন।

২০০৫ সাল থেকে নিজ উদ্যোগে কিডনী রোগীদের চিকিৎসা শুরু করে। ২০০৭ সাল থেকে  ৩০ জন করে  নিয়মিত ডায়ালাসিস শুরু করে। রোগীদের আগ্রহের কারণেই প্রধান পেশা হিসেবেই কাজটি শুরু করে ডা. কামরুল। প্রথম রোগী সার্থক হওয়ায় বেড়ে যায় রোগীর আগ্রহ। প্রথম তিন বছর শুক্রবার সকাল থেকে শুরু করে সারাদিন চল্ এই কাজ । সহকর্মীরা ছুটি না নিয়ে এই কাজে যোগ দেয়। কিডনী প্রতিস্থাপনে রোগীর চাপ বেড়ে যাওয়ায় ২০১১ সরকারী চাকরী ছেড়ে দেন কামরুল। এ পর্যন্ত এই হাসপাতালে মোট ১০০৪টি কিডনী প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। কিডনী প্রতিস্থাপনে সকল রোগীর ফলো আপ পরীক্ষা করা হচ্ছে বিনামূল্যে। প্রতিমাসে অন্ত:ত ৫০০ থেকে ৬০০ রোগী ফলোআপে আসেন এখানে। একটি রোগীর প্রতি ফলোআপে খরচ আসে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। এমনকি রিপোর্টটি দেখতেও খরচ নেওয়া হয় না।

অধ্যাপক ডা. কামরুল ইসলাম বলেন, কোরবানির খাশি ও গরুর কিডনী দিয়ে পরিক্ষা চালাই কিভাবে সেলাই দিব? তা প্র্যাকটিস করেছি অপারেশন থিয়েটারে বসে বসে। দেখি যে ধমনী, শিরা কেমন থাকে? যেন মানুষের দেহে পরে তা করতে পারি।

কিডনী প্রতিস্থাপন খুব সহজ কাজ নয় যে- সেখানে যে ইচ্ছে করে আমি যাব। তখন সেরকম ইচ্ছা ছিল না। আমি তখন সবে মাত্র এফসিপিএস করে এসেছি।এর্ডিনবরা রয়েল কলেজ থেকে এফআরসিএস পাশ করে পরে ইউরোলজিতে ৫ বছর মেয়াদী এমএস প্রোগ্রাম করে জাতীয় কিডনী ও ইউরোলোজী হাসপাতালে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করি।  যখন আমি ন্যাশনাল ইন্সটিটিউটে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে চাকরি পেলাম, তখন দেখলাম আমাকে করতেই হবে। জোয়াল ঘাড়ে উঠিয়ে দিয়েছে। সকল সিনিয়র সার্জন ও বন্ধুদের চিকিৎসকদের উৎসাহে ও স্থানীয় প্রশাসনের অনুমতিক্রমে কিডনী প্রতিস্থাপন কাজটি করি। টাকার প্রশ্নে এই গুণী চিকিৎসক ভোরের কাগজকে বলেন, টাকা নেই নি তবে যে সম্মান পাচ্ছি তার মূল্য আমার কাছে অনেক কোটি টাকার চেয়ে বেশি দামী।

গুণী এই চিকিৎসকের মা রহিমা খাতুন জানান, মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ইক্ষু গবেষণা কেন্দ্রের এগ্রোনোমিস্ট আমার স্বামী আমিনুল ইসলাম আমিনকে পাবনার ঈশ্বরদী রোডের ওয়াপদা গেটের সন্নিকটের বাড়িতে ডেকে এনে রাজাকার-আলবদর, বিহারীরা বেওনেট ও ছুরিকাঘাতে হত্যা করে। মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগীতা ও আওয়ামীলীগকে সর্মথন করার কারণে তাকে হত্যা করা হয়। এসময় তারা বাড়ির মালামাল লুন্ঠন করে। আমার ছোট ছেলের জন্মের তিনদিনের দিন এই ঘটনা ঘটে। আমি আমার স্বামীর লাশটিও দেখতে পারি নাই। নানা প্রতিকূলতার মাঝেও নিরাশ না হয়ে সন্তানগুলোকে মানুষের মতো মানুষ করতে চেষ্টা চালিয়ে গেছি। বাবার আকষ্মিক মৃত্যুতে প্রথম সন্তাান ওয়ালিউর রহমান মানসিক প্রতিবন্ধি হয়ে যায়। সকল প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে আমার মেঝো ছেলে কামরুল ইসলাম আজ দেশের একজন গুনী চিকিৎসক। তৃতীয় সন্তান জাহিদুল ইসলাম প্রকৌশলী হলেও দূরারোগ্য ক্যান্সারে মারা যায়। চতুর্থ সন্তান রাজিউল ইসলাম। সেও প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত। বর্তমানে কর্মসূত্রে থাইল্যান্ডে বসবাস করে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ঈশ্বরদীর আলোবাগ ক্লাবের উদ্যোগে মহান মুক্তিযুদ্ধে আমার স্বামী শহীদ হওয়ায় তার নামানুসারেই এলাকাবাসী শহীদ আমিনপাড়া নামকরণ করেছেন।

ঈশ্বরদী নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব মোস্তাক আহমেদ কিরণ বলেন, কামরুল ইসলামের জন্য ঈশ্বরদীসহ পুরো পাবনাবাসী গর্বিত। ঈশ্বরদীর মানুষের মূখ উজ্জ্বল করেছে। তার কথা এখন প্রত্যেক বাড়িতে বাড়িতে আলোচনা হচ্ছে। তার বাবাকে যেহেতু রাজাকাররা হত্যা করেছিল। তার স্বরণেই এক হাজারেরও বেশি কিডনি বিনা পারিশ্রমিকে প্রতিস্থাপন করেছে। সরকারের কাছে আকুল আবেদন তাকে স্বাধীনতা বা একুশে পদকে ভূষিত করা হোক।

অধ্যাপক কামরুল ইসলামের শিক্ষা জীবনের একজন শিক্ষকই বেঁচে আছেন। তিনি পাকশি চন্দ্র প্রভা উচ্চ বিদালয়ের সাবেক বিজ্ঞান শিক্ষক আবুল কালাম আহাদ। তিনি বলেন, সে আমার ছাত্র সেই জন্য আমি নিজেকে গর্ববোধ করি। স্কুল জীবনে প্রখর মেধার অধিকারী ছিল। পরীক্ষার হলে এদিক সেদিক মাথা ঘুরাতে দেখিনি। খাতা দেখতে গিয়ে কোথায় লাল কালি দেওয়ার সুযোগ পাইনি। শিক্ষক হিসেবে জীবনের সেরা পাওয়া হলো আমার ছাত্র বিনা পারিশ্রমিকে হাজারো রোগীর কিডনি প্রতিস্থাপন করেছে।

তিনি বলেন, কামরুল ছোটবেলা থেকেই মানবতার কাজ করতেন। সহপাঠিরা অসুস্থ হলে তাকে দ্রুত ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যেতেন। প্রতিভা দেখেই ভাবতাম সে বড় হয়ে কিছু একটা করবে। তার জন্য দোয়া করেছি। সেই দোয়ায় আজ সে মানবতার কাজ করে যাচ্ছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App