×

জাতীয়

পরপর দুবছরই সাম্প্রদায়িক সহিংসতা কুমিল্লায়

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩১ অক্টোবর ২০২১, ০৮:৫৩ এএম

ধর্মীয় অবমাননার গুজব রটিয়ে বারবারই হামলা চালানো হয়েছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর। বাংলাদেশে গত এক যুগে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, দুই-এক বছর পরপরই এমন গুজব রটিয়ে হামলা চালানো হচ্ছে। এ রকম জঘন্য ঘটনা শুরু হয় ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর, কক্সবাজারের রামুতে। এরপর ২০১৩ সালের ২ নভেম্বর পাবনার সাঁথিয়া, ২০১৬ সালে ৩০ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, ২০১৭ সালের ১০ নভেম্বর রংপুরের গঙ্গাচড়ায়, ২০১৯ সালে ২০ অক্টোবর ভোলার বোরহানউদ্দিনে ব্যাপক আকারে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি দুর্গোৎসবের সময়ও সাম্প্রদায়িক হামলা ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। আইনে ধর্মীয় অবমাননার সুস্পষ্ট সংজ্ঞা ও শাস্তির বিধানের উল্লেখ থাকলেও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে এই আইনের প্রয়োগ নেই বললেই চলে।

ধারাবাহিকভাবেই যেন সাম্প্রদায়িক সহিংস হামলার ঘটনা ঘটে চলেছে কুমিল্লায়। ২০২০ সালের ১ নভেম্বর সাম্প্রদায়িক সহিংস ঘটনা ঘটে কুমিল্লার মুরাদনগরে। এই হামলার বছর ঘুরতে না ঘুরতেই চলতি বছরের ১৩ অক্টোবর ফের সাম্প্রদায়িক সহিংস ঘটনা ঘটে একই জেলার নানুয়া দীঘিরপাড় এলাকায়। এর আগে ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল কুমিল্লার হোমনা উপজেলার সীমান্তবর্তী বাঘসীতারামপুরেও সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটে।

যা ঘটেছিল কোরবানপুর ও নানুয়া দীঘিরপাড়ে: ধর্মীয় অবমাননার গুজব ছড়িয়ে পরপর দুই বছর সাম্প্রদায়িক সহিংস হামলার ঘটনা ঘটে কুমিল্লা জেলায়। প্রথম ঘটনাটি ঘটে ২০২০ সালের ১ নভেম্বর। কোরবানপুর গ্রামের শিক্ষক শংকর দেবনাথ এবং আন্দিকুট গ্রামের অনিক ভৌমিক নামে দুই ব্যক্তি তাদের ফেসবুক আইডি থেকে মহানবীকে (সা.) নিয়ে ফ্রান্সে প্রদর্শিত ব্যঙ্গচিত্রকে সমর্থন করে মন্তব্য করেন। বিষয়টি স্থানীয়দের নজরে এলে এলাকায় উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। ৩১ অক্টোবর রাতে এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশ মোবাইল ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে ওই দুই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে। এর পরের দিন অর্থাৎ ১ নভেম্বর পরিস্থিতি শান্ত করতে মুরাদনগর উপজেলার বাঙ্গরা থানার ওসি বিকালে কোরবানপুর উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে সম্প্রীতি সমাবেশ ডাকেন। সেখানে স্থানীয় ইসলাম ধর্মের নেতৃস্থানীয়রা উপস্থিত ছিলেন। সেই সমাবেশ থেকেই একদল লোক উঠে গিয়ে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বনকুমার শিবের বাড়িতে হামলা চালায় ও আগুন দেয়। আরেকটি দল

শংকর দেবনাথের বাড়িতে গিয়ে হামলা ও মন্দিরে আক্রমণ করে। পরে ফায়ার সার্ভিসের লোকজন গিয়ে চেয়ারম্যানের বাড়ির আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। ওই দিন ৮/১০টি বাড়িঘরে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করা হয়। পরের ঘটনাটি ঘটে চলতি বছরের ১৩ অক্টোবর দুর্গাপূজার অষ্টমী পূজার দিন। কুমিল্লা শহরে নানুয়া দীঘিরপাড়ে একটি পূজামণ্ডপে পবিত্র কুরআন অবমাননার কথিত অভিযোগে শহরের ৮টি মন্দির ও হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা চালানো হয়। এই ঘটনার জের ধরে পরে চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ফেনী, রংপুরের পীরগঞ্জসহ দেশের কয়েকটি জেলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর, মন্দির ও মণ্ডপে হামলা চালানো হয়। সাম্প্রদায়িক এসব হামলায় মোট ৮ জন নিহত হয়। নানুয়া দীঘিরপাড়ের সহিংস ঘটনার পর কুমিল্লার সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে কুমিল্লা জেলা প্রশাসক জানান, কুমিল্লা ছাড়াও দাউদকান্দি ও সদর দক্ষিণে বিচ্ছিন্ন কয়েকটি ঘটনা ঘটে। এর বাইরে আর কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।

মামলা ও আসামির সংখ্যা: ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ৫টি মামলা হয়েছে বাঙ্গরাবাজার থানায়। এসব মামলায় ৪ শতাধিক ব্যক্তির নাম উল্লেখ করা ছাড়াও আরো ৫০০ ব্যক্তিকে অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করা হয়েছে। ঘটনার দিন রাতেই কোরবানপুরে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় জড়িত ৫ অভিযুক্তকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে সাজা দেয় মুরাদনগর উপজেলার সহকারী কমিশনার সাইফুল ইসলাম কমল। এদের মধ্যে মো. এরশাদকে (৪০) ১৮ মাস, হেলাল উদ্দিন ভূঁইয়াকে (৪৫) ১৮ মাস, এনু মিয়াকে (৪৮) ৬ মাস, মো. শানু মিয়াকে (৩৮) ১৮ মাস এবং মো. বাবু মিয়াকে (৩০) ৬ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়। কোরবানপুরের হামলার ঘটনায় আবিদ হোসেন অভি, বাবলু, মামুন মিয়া, শান মিয়া, রাজু মিয়া, মাসুম মিয়া, কাওসার, শাহ আলমের নাম উঠে এসেছে বারবার।

নানুয়া দীঘিরপাড়ের ঘটনায় জেলায় এ পর্যন্ত মোট ১১টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে কোতোয়ালি মডেল থানায় ৭টি, সদর দক্ষিণ মডেল থানায় ২টি এবং দাউদকান্দি ও দেবিদ্বার থানায় একটি। এসব মামলায় ৯২ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা ১ হাজার ১০ জনকে আসামি করা হয়, এদের মধ্যে এজাহারনামীয় ৪৪ জনসহ মোট ৮৯ জন গ্রেপ্তার হয়েছে।

মামলার বর্তমান অবস্থা: কোরবানপুরের হামলার ঘটনা প্রসঙ্গে বাঙ্গরাবাজার থানার ওসি কামরুজ্জামান তালুকদার ভোরের কাগজকে জানান, কোরবানপুরে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘরে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলাটি এক সপ্তাহ পর সিআইডির কাছে হস্তান্তর করা হয়।

নানুয়া দীঘিরপাড়ের ঘটনায় পুলিশের দায়ের করা মামলার প্রধান আসামি ইকবাল হোসেন, ইকরাম হোসেন, দারোগাবাড়ি মাজার-মসজিদের সহকারী খাদেম ফয়সাল হোসেন ও হুমায়ুন কবীরকে ফের ৫ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। ২৯ অক্টোবর কুমিল্লার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক ফারহানা সুলতানা এ আদেশ দেন। সিআইডি-কুমিল্লা অঞ্চলের বিশেষ পুলিশ সুপার খান মোহাম্মদ রেজওয়ান জানান, আসামিদের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ অনেক তথ্য পাওয়া গেছে। পর্যায়ক্রমে জিজ্ঞাসাবাদে আরো তথ্য বের হয়ে আসবে।

ভুক্তভোগী ও এলাকাবাসীর বক্তব্য: কোরবানপুরবাসী বলছেন, ঘটনার আগের দিন মাইকিং করে আশপাশের গ্রাম ও ইউনিয়ন থেকে শত শত মানুষ জড়ো করা হয়েছিল। সেদিনের হামলা ও অগ্নিসংযোগকারীরা লুটপাটও চালিয়েছিল। যারা এসব করেছে তাদের অনেককেই তারা চিনতে পারেনি। প্রায় দেড় ঘণ্টার বেশি সময় চলে ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি এলেও হামলাকারীদের বাধায় ঢুকতে পারেনি। তবে এলাকাবাসী বলছেন, এই হামলা শুধু পরিকল্পিতই নয়, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতও। বন কুমার শিবের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতা শুকলাল দেবনাথের বিরোধের জেরেই এমন ঘটনা ঘটেছে বলে মনে করেন অনেকেই।

১৩ অক্টোবর কুমিল্লা শহরের চকবাজার এলাকার (কাপুড়িয়াপট্টি) চাঁন্দমনি রক্ষাকালী মন্দিরে হামলা চালায় দুষ্কৃতিকারীরা। ওই মন্দির কমিটির সাধারণ সম্পাদক হারাধন চক্রবর্তী বলেন, প্রথম দফায় হামলার চেষ্টা হয়। তবে ফটক টপকে হামলাকারীরা ঢুকতে পারেনি। সাড়ে ১২টার দিকে আরেকবার হামলার চেষ্টা করে। কিছুক্ষণ ঢিলাঢিলি করে চলে যায়। এরপর বেলা ৩টার দিকে তারা মই, হাতুড়ি, পেট্রল নিয়ে চূড়ান্ত হামলা চালিয়ে সব ভেঙেচুরে, পুড়িয়ে চলে যায়। প্রথম দফা হামলা চেষ্টার পর ১১টার দিকে সদর থানার পরিদর্শকের (তদন্ত) সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি ফোর্স পাঠাবেন বলে জানালেন। তবে সেই ফোর্স আসেনি। বেলা আড়াইটার দিকে আবারো পুলিশের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও ফল পাইনি। হামলাকারীরা মন্দিরে ঢুকে তাণ্ডব চালিয়ে নির্বিঘেœ বের হয়ে যায়। সন্ধ্যার পর জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার মন্দিরে যান।

বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বক্তব্য: ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলা পরিষদ চত্বরে গত শুক্রবার এক অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, দুর্গাপূজার সময় দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দুদের ঘরবাড়ি ও উপাসনালয়ে হামলা-ভাঙচুরের ঘটনাকে সাম্প্রদায়িক হিসেবে দেখা ঠিক হবে না। কারণ এটা ছিল পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। এই ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিছু জায়গায় এ ঘটনা ঘটেছে। এটি বাংলাদেশের সার্বিক চিত্র নয়।

পূজা উদযাপন পরিষদের মুরাদনগর উপজেলার সভাপতি নিত্যনন্দ রায় ভোরের কাগজকে বলেন, এখন পরিস্থিতি শান্ত থাকলেও কখন কী হবে তা তো বলা যায় না। অবস্থা এখন এমন যে, এসব মেনে নিয়েই আমাদের থাকতে হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App