×

শিক্ষা

গুচ্ছ পদ্ধতি ভর্তি পরীক্ষার গোড়ায় গলদ!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩০ অক্টোবর ২০২১, ০৮:৩৫ এএম

গুচ্ছ পদ্ধতি ভর্তি পরীক্ষার গোড়ায় গলদ!

প্রতীকি ছবি

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ভর্তি পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের যাতায়াত, থাকা নিয়ে অনিশ্চয়তা, অর্থ ব্যয়সহ বিভিন্ন দুর্ভোগ লাঘবের জন্য এ বছর প্রথমবারের মতো একসঙ্গে গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন দেশের ২০টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা। বিজ্ঞান, মানবিক, বাণিজ্য গুচ্ছের এই তিন ইউনিটের প্রথম দুটির পরীক্ষা ও ফলাফল প্রদান ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। তবে গুচ্ছের শুরু থেকেই হঠাৎ করে বিভাগ পরিবর্তন ইউনিট না রাখার সিদ্ধান্ত, পরীক্ষার মনোনয়নের জন্য সিজিপিএ বেশি রাখা, পরীক্ষার ফি বাড়িয়ে দ্বিগুণের অধিক করা, পরীক্ষা কেন্দ্র অনেকের নিজ নিজ এলাকায় না পড়া, কর্মদিবসে পরীক্ষা, ফলাফলে অসামঞ্জস্যতা এবং অভিযোগ গ্রহণের নির্দিষ্ট কোনো জায়গা না থাকায় শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি লাঘবের এই পরীক্ষা গোড়ায় গলদে পরিণত হয়েছে বলে মনে করছেন শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা।

ভোগান্তি হ্রাসে ২০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে একসঙ্গে পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ প্রথমে সাদরে গ্রহণ করে শিক্ষার্থীরা। তবে পরীক্ষার প্রস্তুতির দীর্ঘদিন পর সিদ্ধান্ত হয় বিভাগ পরিবর্তন ইউনিট থাকবে না। এতে ইউনিটটিতে দীর্ঘ প্রস্তুতি নেয়া শিক্ষার্থীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে জাতীয় প্রেস ক্লাবসহ বিভিন্ন জায়গায় মানববন্ধন করে। তবে গুচ্ছের সে সিদ্ধান্ত বহাল থাকে। এরপর পরীক্ষা দেয়ার জন্য প্রাথমিক ও চূড়ান্ত ধাপে রেজাল্টসহ নির্দিষ্ট শর্ত দেয়ায় অনেক শিক্ষার্থী বাদ পড়ে যান। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, পৃথকভাবে পরীক্ষা হলে একই রেজাল্টে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করা যেত। কিন্তু গুচ্ছে তারা সে সুযোগ পায়নি। এ কারণে উপাচার্যদের গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা আয়োজক কমিটি পরীক্ষার প্রাথমিক আবেদনে আট-১০ লাখ আবেদন প্রত্যাশা করলেও তিন বিভাগ মিলে সাড়ে তিন লাখের মতো পড়ে বলে সেসময় ভোরের কাগজকে জানায় কমিটি।

পরীক্ষার ফি বৃদ্ধি

চূড়ান্ত আবেদনে পরীক্ষার ফি বাড়ানো হলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন শিক্ষার্থীরা। প্রথমে ৫০০ টাকা ফি নেয়ার কথা বলা হলেও পরে ১০০ টাকা এবং সর্বশেষ ২১ আগস্ট উপাচার্যদের মিটিংয়ে আরো ৬০০ টাকা বৃদ্ধি করে মোট ১২০০ টাকা করা হয়। অভিভাবকরা তখন ব্যয় হ্রাসের পরীক্ষায় দফায় দফায় ফি বৃদ্ধি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

কেন্দ্রে যাতায়াত সমস্যা কাটেনি

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে পরীক্ষা দিতে যাওয়ার প্রধান সমস্যা নিরসনে যে গুচ্ছ পরীক্ষার সিদ্ধান্ত তাতেও সমস্যার পুরোপুরি সমাধান হয়নি। প্রথমে আয়োজক কমিটি থেকে বলা হয় রংপুরের শিক্ষার্থী রংপুরের ভিতরে বা পাশের বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রে পরীক্ষা দিতে পারবে। কিন্তু কেন্দ্র পছন্দ দেয়ার পরও রংপুর, চট্টগ্রাম, বরিশাল কিংবা সিলেটের শিক্ষার্থীর পরীক্ষা ঢাকায়, ঢাকার শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা বাইরে এমন দেখা যায়। এতে মূল সমস্যা গুচ্ছেও কাটল না বলে অভিযোগ করেন শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা। এছাড়া পরীক্ষা ছুটির দিনে না পড়ে কর্মদিবসে পড়ায় চাকরিজীবী অভিভাবকদের ভোগান্তি ও যাতায়াতে যানজট সমস্যায় পড়তে হয়। যেমন- গুচ্ছের অন্যতম বড় কেন্দ্র জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রে পরীক্ষার দিনগুলোতে তীব্র যানজট দেখা যায়।

বাংলার ফল ইংরেজিতে, ইংরেজির ফল বাংলায়

গত ২৪ অক্টোবর গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের পরীক্ষার ফল ২৬ অক্টোবর বিকাল ৫টায় প্রকাশ করা হয়। কিন্তু ফল নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। তাদের অভিযোগ, তাদের দেয়া উত্তরের সঙ্গে ফলাফলের মিল নেই। তারা যেকটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন ফলাফলে উত্তরের সংখ্যা কারো বেশি কারো কম। এতে কেউ উত্তরের থেকে বেশি নম্বর আবার কেউ কম নম্বর পেয়েছেন। পরে সেদিন রাতেই ওয়েবসাইটে টেকনিক্যাল সমস্যা বলে ফলাফল প্রকাশ বন্ধ রেখে পরে নতুন করে সংশোধিত ফল প্রকাশ করা হয়। ইংরেজির ফল বাংলায় আর বাংলার ফল ইংরেজিতে প্রকাশ হয়েছে বলে জানা যায়। তবে সংশোধিত ফলেও শিক্ষার্থীদের সমস্যা কাটেনি বলে ফল বাতিল চান তারা। কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লাইভে এসে ক্ষোভে পরীক্ষার প্রবেশপত্র পোড়ান।

এমন একজন পরীক্ষার্থী রংপুর লায়ন্স স্কুল এন্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করা মোহাম্মদ নাহিদ। তিনি বাংলায় ৩৪টি প্রশ্নের বৃত্ত ভরাট করলেও ফলে দেখানো হয় ৩৮টি বৃত্ত ভরাট করেছেন। আবার ইংরেজিতে ৩৩টি প্রশ্নের বৃত্ত ভরাট করলেও ২৩টি দেখানো হয়। পরে লাইভে এসে প্রবেশপত্রে আগুন ধরিয়ে এই শিক্ষার্থী বলেন, এ রকম ফলের কোনো মানে হয় না। ওরা আমার ভবিষ্যৎ পুড়িয়েছে। কোনো আস্থা আর বিশ্বাসে আমি আবার দ্বিতীয়বার ফলের জন্য আবেদন করব? ভেবেছিলাম গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা অনেক স্বচ্ছ হবে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে কিছুই হয়নি।

মুন্সীগঞ্জের সরকারি হরগঙ্গা কলেজের সজিব হাসানের ইংরেজির ফলাফল বাংলায় আর বাংলারটা ইংরেজিতে আসে। সংশোধিত ফলাফলে ঠিক হলেও তিনি বলেন, প্রশ্নপত্রে শব্দগুলো একটা আরেকটার সঙ্গে লাগানো। অনেকে ভুল করেছে বুঝতে। এটা টাকা বাঁচানোর বিষয় হতে পারে। আরো সজাগ হওয়ার দরকার ছিল। এছাড়া আরো অনেক শিক্ষার্থী ফল নিয়ে অভিযোগ করে বলেন, আমরা অভিযোগের বিষয়ে জগন্নাথে গেলে তারা বলে শাহজালাল জানে। আবার তাদের কাছে অভিযোগ জানাতে গেলে বলে টেকনিক্যাল বিষয় ডিজিটাল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য বলতে পারবেন। ২০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের কার কাছে যাব তা নির্দিষ্ট নয় গুচ্ছে। হটলাইনে ফোন দিলেও ধরা হয় না। এদিকে গুচ্ছ পরীক্ষার দিন কেন্দ্র পরিদর্শক হিসেবে থাকা শিক্ষকরা আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের পৃথক ভর্তি পরীক্ষার চেয়ে কম সম্মানী পাচ্ছেন বলে তারা অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।

গুচ্ছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের যাওয়া নিয়ে একাডেমিক কাউন্সিলে বিরোধিতা করা বিশ্ববিদ্যালয়টির আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের সংগঠন নীলদলের সভাপতি অধ্যাপক ড. জাকারিয়া মিয়া বলেন, গুচ্ছে যাওয়াটা সেসময় অনেক শিক্ষক মেনে নেয়নি। কারণ অনেক বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছে যায়নি। এবার ফলাফলসহ অনেক অব্যবস্থাপনা দেখা যাচ্ছে। সামনের বছর এ পদ্ধতি থাকবে কিনা এটা পরবর্তী সময় শিক্ষকরা মত দেবেন।

এদিকে সার্বিক বিষয়ে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা আয়োজক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফরিদ উদ্দীন আহমেদ ভোরের কাগজকে বলেন, গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার বিরুদ্ধে একটি চক্র কাজ করছে। ‘বি’ ইউনিটের ফলাফলে সাইবার হ্যাকার সমস্যা করেছিল। তবে রেজাল্ট উলট পালটের যে অভিযোগ ছিল সে সমস্যাটা এখন ঠিক হয়েছে। আমরা শিক্ষার্থীদের জন্য অনেক কাজ করছি। ঠিকভাবে ধরলে ৫০০ জনের মতো শিক্ষার্থীর খাতা বাদ পড়ে যেত। কিন্তু চার-পাঁচ জনের খাতা বাদ পড়েছে। আর দূরের কেন্দ্রে মাত্র দুই শতাংশ শিক্ষার্থী পরীক্ষা দিয়েছে। এটা আমাদের প্রথম গুচ্ছ পরীক্ষা। কিছু ভুল থাকতে পারে। আগামীতে সেগুলো সংশোধন করা হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App