×

মুক্তচিন্তা

রক্তাক্ত বাংলাদেশের জজ মিয়ারা

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৯ অক্টোবর ২০২১, ১২:৪২ এএম

সম্প্রতি বাংলাদেশে ঘটে গেছে নারকীয় সাম্প্রদায়িক হামলা। পবিত্র কুরআন শরিফকে দেবতার উরুর ওপর রাখার এক বেফাঁস দায় ফেলে দেয়া হয়েছে বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর। এবং এই দায় বহন করতে হয়েছে নিরপরাধ সাধারণ হিন্দু জনগোষ্ঠীদের। বাংলাদেশের প্রত্যেকটি বিরোধী দল এর তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে সরকারের কাছে এই মানুষগুলোর নিরাপত্তা চেয়েছে। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তা-ই চায়। বাংলাদেশ সরকারও এ ব্যাপারটাকে অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গেই নিয়েছে এবং দাঙ্গা-হাঙ্গামা প্রতিরোধ করতে কাজ করছে বলেই বিশ্বাস করা যায়। ইতোমধ্যে দাঙ্গায় ইন্দনদাতাদেরও কয়েকজন হতাহত হয়েছেন। হতাহতদের মাঝে সাধারণ মানুষও আছেন। বাংলাদেশের বাইরে বিশেষত বাংলাদেশি অভিবাসী কিংবা প্রবাসীরা এ নিয়ে সোচ্চার, তীব্র প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে পৃথিবীর দেশে দেশে। দেশে সংখ্যালঘু মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা যে আছে তা-ও আমরা দেখছি। চট্টগ্রামে বিশাল সমাবেশ করেছে হিন্দু সম্প্রদায়। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যারা ধ্বংস করছে, তারা সরকারের আশকারা পাচ্ছে বলে সভা-সমাবেশে উল্লেখ করছে। তারা দাবি করছেন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে বরাবরের মতোই এসব ঘটনায় দায়ীদের চিহ্নিত করে কঠোর শাস্তির আশ্বাস দেয়া হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সংখ্যালঘু নির্যাতনের কোনো একটি ঘটনায় শাস্তি হয়েছে এমন নজির নেই। উল্টো রামু ও নাসিরনগরে বীভৎস সাম্প্রদায়িক সহিংসতাকারীরা রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় পাচ্ছে।’ অর্থাৎ এ হামলায় তারা সরকারকে প্রকাশ্যেই কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে। হামলায় বিধ্বস্ত মানুষগুলো অসহায় হয়েই বিরোধী দলগুলোর মতোই উচ্চারণ করছেন। এদিকে সাম্প্রদায়িক হামলা মোকাবিলার জন্য প্রধানমন্ত্রী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন, যে নির্দেশনা বাংলাদেশের মানুষেরই চাওয়া। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব হয়তো পালন করছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে অসাম্প্রদায়িক। দেশটার জনগণ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতেই বিশ্বাস করে, আস্থা রাখে। যা আমরা দেখেছি সময়ে সময়ে। পূজা অর্চনায় হিন্দু জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সৌহার্দতার মধ্য দিয়ে তাদের আতিথেয়তা মুগ্ধ করত, আজো সে সম্প্রীতি আছে আমাদের এলাকায়। বাংলাদেশের কিছু এলাকায় এ সম্প্রীতিতে ছেদ পড়েছে। ঘটছে অপ্রীতিকর দুঃখজনক নারকীয় পাশবিকতা। এ পাশবিকতা কি ঘটাচ্ছে শুধুই ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলো। শুধুই কি তাদের উগ্রতার আগুনে জ্বলছে এসব অঞ্চল? এ প্রশ্নগুলো ঘুরে-ফিরেই আসে আমাদের মাঝে। এই ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোকে যদি আমরা বারবার আমাদের আন্দোলনের ইস্যু বানাই, তাহলে দুটি জিনিস আমাদের সামনে আসে, তার মাঝে একটা হলো এতে শুধু ‘ধর্ম ধর্ম’ বলে ধর্মের বুলি আউড়িয়ে দাঙ্গা সৃষ্টিকারীদেরই শুধু জনসম্মুখে নিয়ে আসা হচ্ছে, আসল উসকানিদাতা কিংবা ষড়যন্ত্রকারীরা পর্দার মূলত পেছনেই থেকে যাচ্ছে। ধর্মের উন্মাদনা প্রচারণার আড়ালে মূল ষড়যন্ত্রকারী গোষ্ঠী অধরাই থেকে যায়। অন্যদিকে এর মধ্য দিয়ে দেশকে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি করিয়ে দেয়া হচ্ছে, যাতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অহেতুক প্রশ্নবোধক করে তোলা হচ্ছে বাংলাদেশকে। প্রসঙ্গক্রমে নাসিরনগর, রামু কিংবা অন্যান্য এলাকায় ধর্মীয় উসকানিতে সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা সৃষ্টির পেছনের কারিগরদের দিকে যদি আমরা একটু ফিরে তাকাই, তাহলে কী দেখি। কাদের দায়ী করা হয়েছিল তখন, কারা চিহ্নিত হয়েছিল সে সময়। যারা চিহ্নিত হয়েছিল তাদেরই চারজন ক্ষমতাসীন দলের হয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচনে প্রতিদ্ব›িদ্বতার জন্য মনোনীত হয়েছিলেন মাত্র কদিন আগে। পরে দলের অভ্যন্তর থেকে প্রতিবাদ ওঠায় এদের মনোনয়ন প্রত্যাহার করা হয়েছে। মনোনয়ন প্রত্যাহার করা হলেও ওই মনোনয়নের মধ্য দিয়ে পুরনো ক্ষত আবারো দগ্ধভূত হলো, আমাদের চোখের সামনেই নতুন বীভৎসতার স্মৃতি জাগিয়ে দেয়া হলো। সঙ্গে সঙ্গে জানান দিল, ওই সহিংসতা কোনো ধর্মীয় সহিংসতা ছিল না। ধর্মের আবরণ দিয়ে রাজনীতির মানুষগুলোই তাদের বৈষয়িক কিংবা রাজনীতির দাও মেরেছে সহিংসতা ঘটিয়েই। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে সন্ত্রাস-সহিংসতা ঘটিয়েও ক্ষমতার রাজনীতি থেকে এদের সরে যেতে হয়নি। এরা টিকে আছে। আর সেজন্যই হিন্দু সম্প্রদায়ের কিংবা বিরোধী দলগুলোর অভিযোগকে অবজ্ঞা করার অবকাশ এখানে নেই। আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশ একটা অবস্থানে আছে বলেই আমরা বিশ্বাস করি। নারীর ক্ষমতায়ন, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের চাকরি ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা প্রভৃতি বাংলাদেশের সুনাম বৃদ্ধি করছে। এ নিয়ে রাষ্ট্রের একটা শ্লাঘাও আছে। পার্শ্ববর্তী কোনো একক দেশের ওপর নির্ভরতা কাটিয়ে ভারত, চীন এমনকি মিয়ানমারের সঙ্গেও বাংলাদেশের আছে নানামুখী সম্পর্ক, যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় একটা ইতিবাচক দিক। এই অগ্রযাত্রায় বহু প্রশ্ন আছে যদিও, তবুও দেশের বাইরে বাংলাদেশ এখন ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ নয়। বিশ্বে বাংলাদেশ একটা ঊর্ধ্বগামী-উদীয়মান (ইমার্জিং) রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত। আর এই ‘ইমার্জিং’ হওয়াটা দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের জন্য মাথাব্যথারও কারণ। এটাও আমাদের ধারণায় রাখতে হবে। বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবাদে লন্ডন দূতাবাসের সামনে অবস্থান নেন লন্ডনের প্রবাসী বাংলাদেশিরা। পাঁচ দফা দাবিতে অনশন শুরু করেন সেক্যুলার মুভমেন্টের সদস্যরা। এ সময় তাদের হাতে লিফলেট, প্ল্যাকার্ড, পোস্টার ছিল। পাঁচ দফা দাবি হলো- হিন্দুদের বছরের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব উদযাপনের সময় হিন্দুদের রক্ষা না করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে অনতিবিলম্বে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে; সমস্ত হিন্দু উৎসব, জীবন ও সম্পদের সুরক্ষার জন্য পুলিশ এবং প্রশাসনের কাছ থেকে জবাবদিহিতা ও ত্বরিত পদক্ষেপ নিতে হবে; গত সপ্তাহে সংঘটিত নৃশংসতার শিকার মানুষদের সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত এবং উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ, সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রয়োগ এবং সব অপরাধীর বিচার, তাদের অপরাধকে এক ধরনের উগ্রবাদী সন্ত্রাস হিসেবে বিবেচনা করা এবং সহিংসতায় নিহতদের প্রতি দুঃখ প্রকাশ ও সংহতি প্রকাশের জন্য হাইকমিশন প্রাঙ্গণে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখতে হবে। একজন অভিবাসী হিসেবে তাদের এই আন্দোলনের প্রতি আমার মতো অসংখ্য মানুষের সমর্থন আছে। বাংলাদেশ হাইকমিশনের সামনে ব্রিটেনের হিন্দু জনগোষ্ঠীর কিছু মানুষের আন্দোলন ছাড়াও আমরা দেখছি শত শত অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জনসমাবেশ করেছেন আলতাব আলী পার্কে। চারদিক থেকেই বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া বর্বরতার বিরুদ্ধে ব্রিটেনের অভিবাসীরা সোচ্চার হয়েছেন। কিন্তু এর জন্য কি অনশনেই যেতে হবে। তারা বলছেন এর দায়ভার সরকারের। বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলোও একই কথা বলছে। অর্থাৎ তারা যেটা বলছেন, সে কথাগুলো তো উচ্চারিত হচ্ছে পূর্ব থেকেই। সরকার স্বীকার করুক কিংবা না করুক, এ দায় সরকারের। আর সেজন্যই বারবার এসব নৃশংসতা ঘটার কারণ বের করাটা সরকারের দায়িত্ব। আর সেজন্যই আমরা এটাকে রাজনৈতিক ব্যর্থতা হিসেবেই বিবেচনা করি। অন্যদিকে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশের প্রত্যেকটা নাগরিকই এর জন্য লজ্জা পাওয়া উচিত। এ লজ্জা আমাদের সবার। নাগরিক হিসেবে আমাদের সবার দায় এ ব্যর্থতা। কিন্তু এটাকে ‘উগ্রবাদী সন্ত্রাস’ আখ্যা দিয়ে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উগ্রবাদীদের জায়গা হিসেবে চিহ্নিত করার কি কোনো অর্থ আছে? হতাহতের দায় রাষ্ট্রের। তা প্রতিরোধে রাষ্ট্র ব্যর্থ হলেও সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছে। এ অবস্থায় সবার সম্মিলিত সহাবস্থানটাই প্রধান। জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখার আহ্বান করাটা এখানে খুব জরুরি নয়। ইকবালকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, আরো হয়তো আটক হবেন। একজন ইকবালই কি এর নায়ক? নেপথ্যের খলনায়ক কারা? বিভিন্ন রিপোর্ট থেকে দেখা যাচ্ছে মাদকাসক্ত এই ইকবালই এখন লাইম লাইটে। একসময় জজ মিয়াও লাইম লাইটে এসেছিলেন, জজ মিয়া দিয়ে তখন আড়াল হয়ে গিয়েছিল আসল ষড়যন্ত্রকারীরা। আর তাই বারবার কলঙ্কিত হয়েছে দেশ, রক্তাক্ত হয়েছে লাল-সবুজের বাংলাদেশ। আর তাই ইকবালদের দিয়ে কিংবা ধর্মীয় উগ্রবাদ বারবার সামনে এনে জজ মিয়াদের নাটক যেন না হয়। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে জজ মিয়াদের নাটক হলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ফিরে আসবে না কখনো।

ফারুক যোশী : কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App