×

জাতীয়

রংপুর ঠাকুরপাড়ায় আগের ক্ষতই মুছেনি, নতুন আতঙ্ক

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৯ অক্টোবর ২০২১, ০৮:৪৩ এএম

রংপুর ঠাকুরপাড়ায় আগের ক্ষতই মুছেনি, নতুন আতঙ্ক

২০১৭ সালে রংপুরের গঙ্গাচড়ায় ঠাকুরপাড়ায় আগুন। ফাইল ছবি

ধর্মীয় অবমাননার গুজব রটিয়ে বারবারই হামলা চালানো হয়েছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর। বাংলাদেশে গত এক যুগে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, দুই-এক বছর পরপরই এমন গুজব রটিয়ে হামলা চালানো হচ্ছে। এ রকম জঘন্য ঘটনা শুরু হয় ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর, কক্সবাজারের রামুতে। এরপর ২০১৩ সালের ২ নভেম্বর পাবনার সাঁথিয়া, ২০১৬ সালে ৩০ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, ২০১৭ সালের ১০ নভেম্বর রংপুরের গঙ্গাচড়ায়, ২০১৯ সালে ২০ অক্টোবর ভোলার বোরহানউদ্দিনে ব্যাপক আকারে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি দুর্গোৎসবের সময়ও সাম্প্রদায়িক হামলা ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। আইনে ধর্মীয় অবমাননার সুস্পষ্ট সংজ্ঞা ও শাস্তির বিধানের উল্লেখ থাকলেও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে এই আইনের প্রয়োগ নেই বললেই চলে।

নাসিরনগরে ঘটে যাওয়া তাণ্ডবের আতঙ্ক তখনো কাটেনি। এমনকি বছরও ঘোরেনি। আবার ফেসবুকের মাধ্যমে ইসলাম ও মহানবীকে অবমাননা করা হয়েছে বলে গুজব ছড়ানো হয়। ২০১৭ সালের ১০ নভেম্বর তাণ্ডব চালানো হয় রংপুরের গঙ্গাচড়ার ঠাকুরপাড়ায়। ঘটনা গড়িয়েছিল গুলি ও একজনের মৃত্যু পর্যন্ত। এর আগে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে যত হামলা ও সহিংসতা হয়েছে, তাতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। আগেরবারের ভয়াবহতার দৃশ্য এখনো ভুলতে পারেননি এলাকাবাসী। এরই মধ্যে সম্প্রতি শারদীয় দুর্গোৎসবের সময় ইসলাম ধর্ম অবমাননার অভিযোগে দেশের বিভিন্ন এলাকায় যে সহিংস ঘটনা ঘটে, তা ছড়িয়ে যায় রংপুরের পীরগঞ্জেও। রংপুরে আবারো সাম্প্রদায়িক সহিংস ঘটনায় ঠাকুরপাড়ায় এখন বিরাজ করছে চাপা আতঙ্ক।

[caption id="attachment_314852" align="aligncenter" width="700"] সম্প্রতি কুমিল্লার পূজামণ্ডপের ঘটনার জের ধরে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে পীরগঞ্জে হামলা হয়, জেলেপল্লীতে দেয়া হয় আগুন । ফাইল ছবি[/caption]

যা ঘটেছিল : রংপুরের সদর উপজেলার পাগলাপীর ঠাকুরপাড়া গ্রামের হিন্দু বাড়িতে হামলা, অগ্নিসংযোগের ঘটনাটি ২০১৭ সালের ১০ নভেম্বর ঘটলেও এক সপ্তাহ আগে থেকেই এলাকাবাসীর মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছিল। ঠাকুরপাড়ার মৃত খগেন রায়ের ছেলে টিটু রায় ফেসবুকে ‘ধর্মীয় অবমাননাকর’ ছবিযুক্ত একটি স্ট্যাটাস দেন বলে অভিযোগ ওঠে। এ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ২৯ অক্টোবর ওই এলাকার লালচাঁদপুর গ্রামের মুদি দোকানি আলমগীর হোসেন অভিযুক্ত টিটু রায়ের বিরুদ্ধে মামলা করেন। পরে ওই যুবককে গ্রেপ্তারের দাবিতে গত ৭ নভেম্বর এলাকাবাসী বিক্ষোভও করে। টিটু রায়ের ওই ফেসবুক পোস্ট নিয়ে কয়েক দিন ধরেই এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করছিল। স্থানীয় প্রশাসন এবং পুলিশ আসামিকে ধরা হবে বলে কথা দেয়। এরপর পার্শ্ববর্তী হরিয়ালকুঠি, মোমিনপুর, শলেয়াশাহ ইউনিয়নে তিন দিন ধরে প্রতিবাদ সভা, সমাবেশ ও মাইকিং করে লোক জড়ো করা হয়। সেখান থেকে ১০ নভেম্বর শুক্রবার বেলা সাড়ে ৩টায় বিক্ষোভের ডাক দেয়া হলে পরিস্থিতি মোকাবেলায় ওই এলাকায় দুপুর থেকেই পুলিশ মোতায়েন করা হয়। ঘটনার দিন দুপুর ২টার দিকে খলেয়া ইউনিয়নের শলেয়াশাহ ও বালাবাড়ি গ্রাম এবং পাশের মমিনপুর গ্রামসহ বিভিন্ন মসজিদ-মাদ্রাসা এলাকা থেকে জুমার নামাজের পর দলে দলে তরুণ, যুবক, বয়স্করা লাঠিসোটা নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ৮ থেকে ১০ হাজার লোকের সমাবেশ রংপুর-দিনাজপুর মহাসড়ক অবরোধ করে। এক পর্যায়ে বিক্ষোভকারীরা টিটু রায়ের বাড়ির দিকে যেতে চাইলে পুলিশ তাদের বাধা দেয়। এ সময় উত্তেজিত বিক্ষোভকারীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট ও লাঠি ছুড়তে থাকে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ কয়েক দফায় ছররা গুলি, রাবার বুলেট ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। এ সংঘর্ষ চলাকালেই হামলাকারীদের একটি বড় অংশ ‘নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবার’ স্লোগান দিতে দিতে ঠাকুরপাড়া গ্রামে ঢুকে ধীরেন রায়ের তামাকের গোডাউন ও টিটু রায়ের বাড়িসহ আশপাশের ১৫-১৬টি হিন্দু বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। এ সময় পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গুলি ও টিয়ার শেল ছোড়ে। এতে শলেয়াশাহ এলাকার একরামুল হকের ছেলে হাবিবুর রহমান হাবিব (২৭) নিহত হন। আহত হয়েছেন কমপক্ষে ২০ জন।

হামলার নেতৃত্বে যাদের নাম : রংপুর জেলা পরিষদের উপসহকারী প্রকৌশলী ফজলার রহমান, জাতীয়তাবাদী ওলামা দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও রংপুর জেলা সভাপতি ইনামুল হক মাজেদিসহ অনেকের নাম উঠে আসে। ঘটনার দিন জুমার নামাজের পর মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশে বক্তব্য রাখেন ইনামুল হক মাজেদি, খলেয়া ইউনিয়ন জামায়াতের সেক্রেটারি ও শলেয়াশাহ জামে মসজিদের ইমাম সিরাজুল ইসলাম, জামায়াত নেতা মোস্তাইন বিল্লাহ, ইউনিয়ন বিএনপি নেতা মাসুদ রানাসহ আরো অনেকে।

মামলা ও আসামির সংখ্যা : এ ঘটনায় দুটি মামলা দায়ের করা হয়। দুই মামলায় আসামি করা হয় ৪০০ থেকে ৪৫০ জনকে। এর মধ্যে রংপুরের গঙ্গাচড়া থানায় ২২৬ জন এবং কোতোয়ালি সদর থানায় ২১৯ জন রয়েছে। এসব মামলায় পুলিশ প্রায় দেড়শ জনকে গ্রেপ্তার করে। এর মধ্যে বেশ কয়েকজন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছে।

মামলার বর্তমান অবস্থা : গঙ্গাচড়া মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সুশান্ত কুমার সরকার জানান, মামলার চার্জশিট দেয়ার পর বিচার প্রক্রিয়ার জন্য আদালতে পাঠানো হয়েছে। এ ব্যাপারে জেলা জজ আদালতের পিপি এডভোকেট আব্দুল মালেক বলেন, ঠাকুরপাড়ায় তাণ্ডবের ঘটনায় দায়ের করা মামলার অনেক আসামি এখনো পলাতক রয়েছে। এছাড়া অনেক কাজ এখনো বাকি আছে। মামলায় যাদের সাক্ষী করা হয়েছে, তারাও অনেকে সাক্ষ্য দিতে আসেন না। তবে মামলা চলমান রয়েছে। ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে তা বিচারের প্রক্রিয়াধীন।

এর আগে রংপুর সদর উপজেলার খলেয়া ইউনিয়নের ঠাকুর পাড়ার হিন্দু পল্লীতে হামলা ঘটনার এক বছর নয় মাস পর চার্জশিট দেয় পুলিশ। গঙ্গাচড়া ও কোতোয়ালি সদর থানা সূত্রে জানা গেছে, গঙ্গাচড়া থানার প্রথম তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই মোহাম্মদ আলী, দ্বিতীয় তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই মিজানুর রহমান তদন্ত করার পর বদলি হয়ে যান। পরে তৃতীয় তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই মকবুল হোসেন দীর্ঘ এক বছর ৯ মাস পর তদন্ত শেষে ২০১৯ সালের ৩১ আগস্ট আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। কোতোয়ালি সদর থানার এসআই ফেরদৌস আহম্মেদ, এসআই জাবেদ আলী ও এসআই সাইফুর রহমান তদন্ত শেষে ওই বছরের ৩০ আগস্ট আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। দুটি মামলার সাক্ষী করা হয়েছে ১৫৯ জনকে। এর মধ্যে গঙ্গাচড়া থানায় ৯২ জন ও কোতোয়ালি সদর থানায় ৬৭ জন।

ভুক্তভোগী ও এলাকাবাসীর বক্তব্য : যার ফেসবুকে পোস্ট দেয়া হয়েছে বলে মিথ্যা অভিযোগে তাণ্ডব চালানো হয় সেই টিটু রায় ভোরের কাগজকে বলেন, ওই ঘটনার পর এলাকায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রয়েছে। তবে পীরগঞ্জে হামলা ও সহিংস ঘটনায় গ্রামের মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বেড়েছে। পীরগঞ্জের ঘটনার পর এলাকার চেয়ারম্যান, মেম্বার গ্রামের লোকদের দিয়েই পাহারার ব্যবস্থা করেছেন। স্থানীয়রা পালা করে পাহারা দিচ্ছেন। টিটু রায়ের ভাই বিপুল রায় এবং নিবারণ রায়ের বড় ছেলে সন্তোষ রায়ও জানালেন, পীরগঞ্জের হামলার ঘটনার পর এলাকার মানুষের মাঝে আতঙ্ক ও উদ্বেগ বেড়েছে।

এলাকাবাসী জানায়, সেদিন ফেসবুকের পোস্ট নিয়ে মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে একটি ‘বিশেষ মহল’ ফায়দা হাসিলের জন্য সাধারণ মানুষকে ভুল বুঝিয়ে ক্ষেপিয়ে তোলে। এমন ঘটনা জীবনে কখনো দেখিনি। ওই হামলার ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার আসামি সবাই এখন জামিনে আছে। ঘটনার সুষ্ঠু বিচার পাওয়া নিয়েও সংশয় রয়েছে এলাকাবাসীর। বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বক্তব্য : হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের রংপুর শাখার সাধারণ সম্পাদক সুশান্ত ভৌমিক ভোরের কাগজকে বলেন, ২০১৭ সালের ওই ঘটনার পর এলাকায় এ ধরনের আর কোনো ঘটনা ঘটেনি। সেদিনের সহিংস ঘটনায় যে মামলা হয়েছে, তা চলমান আছে। মামলায় যারা আসামি, তারা সবাই জামিনে আছে। ঠাকুরপাড়া গ্রামে আর কোনো সহিংস ঘটনা না ঘটলেও সম্প্রতি রংপুরের পীরগঞ্জে যে সহিংস ঘটনা ঘটেছে, তাতে এলাকাবাসী আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। তাদের মধ্যে চাপা আতঙ্ক বিরাজ করছে। প্রশাসন ও স্থানীয়দের উদ্যোগে মন্দির পাহারার ব্যবস্থা করা হয়েছে। রাতে রুটিন করে স্থানীয়রা পাহারা দেয়।

স্থানীয় পাগলাপীর জামে মসজিদের পরিচালনা কমিটির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম মাস্টারও জানালেন একই কথা। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, সেদিনের সহিংস ঘটনায় বিক্ষুব্ধ মুসল্লিরা অংশ নিয়েছিল। কিন্তু এখন এলাকায় সম্প্রীতি রয়েছে। তবে পীরগঞ্জের হামলার ঘটনায় হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ কিছুটা আতঙ্কে আছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App