×

মুক্তচিন্তা

অশুভশক্তিকে ঐক্যবদ্ধভাবে রুখতে হবে : দায় সবার

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৯ অক্টোবর ২০২১, ১২:৪৩ এএম

সাম্প্রদায়িক সহিংসতার প্রেক্ষাপটে সেই ধারাবাহিকতায় ১৯৪৭- আগস্টে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান, আপসে ক্ষমতার হস্তান্তর ও রক্তাক্ত ভারত ভাগ-বঙ্গভাগের সময় কারো কারো ভুয়া ধারণা তৈরি হয় যে এবার সাম্প্রদায়িকতার অবসান হবে। ভুল ভাবা হয়েছিল। কারণ দূষিত সমাজের চরিত্র বদল তো ঘটেনি, মানচিত্র বদল ও ক্ষমতার হাতবদলই শুধু ঘটেছিল। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও শ্রেণিস্বার্থের সূচকগুলো দ্বিখণ্ডিত ভুবনে একই ছিল। ছিল দ্বিধাবিভক্তির পরও। সাম্প্রদায়িকতার কালো বিড়াল মারাব প্রক্রিয়া প্রথম রাতেই শুরু করা দরকার ছিল। দরকার ছিল সবার স্বার্থে প্রচলিত লোকগীতির ধারায় ছড়ার গান রচনা করে সমাজের সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিদের হাতে তুলে দেয়া, যাতে এর সক্রিয় প্রভাব তৃণমূল পর্যন্ত, গ্রামগ্রামান্তরে পৌঁছে যায়। গানের তাৎপর্য সাধারণ মানুষের হৃদয় স্পর্শ করে। তারা সাম্প্রদায়িক শক্তির সফল মোকাবিলা করতে পারে। কিন্তু তেমন কিছু ব্যবস্থা নেয়া দূরে থাক, পাকিস্তান নামক অস্বাভাবিক রাজনৈতিক রাষ্ট্রের প্রাপ্তি সত্ত্বেও এবং স্বাধীন ভারত প্রাপ্তি সত্ত্বেও সাম্প্রদায়িক সহিংসতার সামাজিক সূত্র ঠিকই সক্রিয় রইল। অসহায় মানুষের রক্তে মাটি সিক্ত হলো। এমনকি যুদ্ধোত্তর স্বাধীন বাংলাদেশে একটি সেক্যুলার সংবিধান সত্ত্বেও দুই জেনারেলের হাতে তা খণ্ডিত হলো, সাম্প্রদায়িকতার অবকাশ ঠিকই বজায় রইল। সামাজিক পরিবেশ দূষিত হলো রাজনৈতিক স্বার্থবাহী সম্প্রদায়বাদের হাতে। জনমনে মানসিক রক্ষণশীলতার যে কালো ছায়া মুছে ফেলা যায়নি, বিভিন্ন ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় তা চড়ারঙে দেখা দিয়েছে। যেমন সুস্পষ্টভাবে অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ আক্রান্ত হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় ঢাকা থেকে ভোলা এবং একাধিক স্থানে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার প্রকাশ ঘটে। সমাজের দুর্বল শুভশক্তি তা রোধ করতে পারেনি। কোনো কোনো সূত্র মতে, এরশাদের স্বৈরশাসনামলে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা প্রকাশ পেয়েছে- বিশেষ করে পূজামণ্ডপে হামলা বা প্রতিমা ভাঙচুরের মতো সহিংসতা প্রায়ই ঘটেছে। এসবের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ সামাজিক শুভশক্তির প্রতিবাদ-প্রতিরোধ বিরল সংখ্যায় ঘটেছে, যেমন ১৯৬৪ সালে ছাত্র-পেশাজীবী ও সচেতন বুদ্ধিজীবীদের সম্মিলিত প্রতিরোধের পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও- এ আহ্বানে সাড়া মিলেছিল বেশ ভালো। অশুভশক্তি পিছু ঘটে। তেমন ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ কমই দেখা গেছে। দুই. ওই যে বলেছি বিদেশি শাসনমুক্ত পরিবেশে অসাম্প্রদায়িক সামাজিক শুভশক্তির ঐক্যবদ্ধ বিকাশ ঘটানোর চেষ্টা আমাদের মধ্যে বড় একটা দেখা যায়নি। যেমন রাজনৈতিক ক্ষেত্রে, তেমনি সংস্কৃতির পরিমণ্ডলে। সাহিত্য, সংগীত ও নাট্যাভিনয়ের চর্চা করেই আমরা সাংস্কৃতিক-সামাজিক দায়বদ্ধতার জবাব দিতে চেয়েছি। সংখ্যালঘু নির্যাতন ও নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদের বিষয়টি অধরা থেকে গেছে, যেমন রাজনৈতিক কর্মীদের সচেতনতায়, তেমনি সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের সদস্যদের তৎপরতায়। বিষয়টি অদ্ভুতই বটে, যা আমাদের রাজনৈতিক চেতনার নেতিবাচক প্রবণতারই উদাহরণ হয়ে থাকে। তাই বিচারহীনতা যেমন অপরাধমূলক ঘটনার সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটায়, তেমনি ব্যবস্থা গ্রহণের অভাব বা সে সম্পর্কে অসচেতনতা সাম্প্রদায়িক সহিংসতার প্রবণতা বাড়ায়। আর সে কারণে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নাসিরনগর, গোবিন্দগঞ্জ, অভয়নগর প্রভৃতি স্থানে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটে। তাতে নিরাপত্তারক্ষক সদস্য, জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক কর্মীদের উদাসীনতা বা আপত্তিকর সংশ্লিষ্টতা দেখা যায়। দক্ষিণ চট্টগ্রামের রামু, উখিয়া প্রভৃতি এলাকায় বৌদ্ধপল্লী এবং অংশত হিন্দু মহল্লায় উদ্দেশ্যমূলক ব্যাপক হামলা, ধ্বংসযজ্ঞ ও ভাঙচুরের বহু উল্লিখিত ঘটনার তদন্ত হলেও সুবিচার কতটা হয়েছে বলা কঠিন। রাজনৈতিক চেতনা জনগণে কতটা যে পশ্চাদমুখী বহু উদ্ভট ঘটনায় তার প্রমাণ মেলে। এসব ক্ষেত্রে ঘটনায় আমাদের সাংস্কৃতিক সচেতনতার দুর্বল দিকটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। শিক্ষা আমাদের চিত্তের প্রসার সামান্যই ঘটাতে পেরেছে- এমন ভাবনা অন্যায় নয়। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেও আমাদের শাসনব্যবস্থা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা কোনো স্থায়ী ইতিবাচক কর্মসূচি গ্রহণ করেনি, যে কারণে সামাজিক প্রতিরোধ শক্তি দুর্বল থেকে গেছে। উদ্ভট, অবিশ্বাস্য গুজবে হামলার উন্মাদনা সৃষ্টি হয়েছে। এমন ঘটনা একাধিকবার ঘটেছে এবং দুর্বৃত্ত দল বা রাজনৈতিক স্বার্থবাহী গ্রুপ সে সুযোগে গুজবে জনতাকে ক্ষেপিয়ে তুলেছে। ঘটেছে বীভৎস অনাচার। তিন. রাজনৈতিক চেতনার ঘাটতি ও কাক্সিক্ষত সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণের অভাবে সৃষ্ট সামাজিক দুর্বলতা এবারো বিশেষ কোনো পক্ষকে ষড়যন্ত্রমূলক পরিকল্পনা সাজাতে সাহায্য করেছে। গোয়েন্দা বিভাগ এ ক্ষেত্রে পূর্ব হুঁশিয়ারি দিতে ব্যর্থ হয়েছে বা সংশ্লিষ্ট বিভাগ সক্রিয় ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে ষড়যন্ত্র সফল, জনউন্মাদনা সৃষ্টির কাজটিও সহজে করা গেছে, যেমনটি আমরা দেখেছি দাঙ্গার অনুপুঙ্খ ইতিহাস বিশ্লেষণে। এবার ঘটনা শারদীয় দুর্গাপূজার উৎসব উপলক্ষে। ছকটা একেবারেই নতুন কিছু নয়। ঘটনার সূত্রপাত কুমিল্লা শহরের নানুয়াদীঘি এলাকার পূজামণ্ডপে। পুলিশের ভাষ্যমতে ইকবাল হোসেন নামে এক ব্যক্তি পূজামণ্ডপে কুরআন শরিফ রেখে যায়, ষড়যন্ত্রকারীদের উদ্যোগে এক ব্যক্তি এ ঘটনা প্রচারও করে। তারপর শুরু হয়ে যায় একাধিক স্থানে পূজামণ্ডপে, মন্দিরে ও হিন্দু বাড়িতে হামলা। ভেবে দেখা হয়নি কারা অপরাধী। প্রথম সংঘটিত হামলা পূর্বোক্ত পূজামণ্ডপে ১৩.১০.২০২১ তারিখে। এর পরদিন হাজীগঞ্জসহ একাধিক এলাকায় মন্দিরে হামলা চলে। এর বিস্তার দেশব্যাপী- গাজীপুর থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, এমনকি বাদ যায়নি উত্তরাঞ্চলের রাজশাহী-রংপুর এলাকা। অর্থাৎ স্ফুলিঙ্গ থেকে দাবানলের সৃষ্টি। এমনকি সহিংসতার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণে প্রধানমন্ত্রীর হুঁশিয়ারি অগ্রাহ্য করে চলেছে দেশজুড়ে দুর্বৃত্তদের দাপাদাপি। এটা কীভাবে সম্ভব? ইতোমধ্যে পুলিশ ও র‌্যাবের সঙ্গে দুর্বৃত্তদের ও উন্মত্ত জনতার একের পর এক সংঘর্ষ, কয়েকটি মৃত্যু। তবু সহিংসতা অব্যাহত থাকে- এর বীভৎস প্রকাশ ঘটে রংপুরের পীরগঞ্জে হিন্দু বাড়িতে হামলায়। এ সম্বন্ধে একটি দৈনিকের শিরোনাম : ‘৩০ মিনিটের তাণ্ডবে তারা নিঃস্ব’ (১৯.১০.২০২১)। আরো বলা হয়েছে : ‘রংপুরের পীরগঞ্জে হিন্দুদের ঘরে আগুন, ভাঙচুর, লুটপাট। সারা রাত ধানক্ষেতে ছিলেন নারী-পুরুষ ও শিশুরা’। ভাবা যায় না এমন নৃশংসতার কথা উদ্দেশ্যমূলক একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে। কোথায় কুমিল্লায় ঘটনা- তার জের রাজশাহী, রংপুরে- চেনামুখ মানুষ অচেনা হয়ে যায়। দীর্ঘদিন শান্ত এলাকা হঠাৎ অশান্ত হয়ে উঠল, চরম অমানবিকতার প্রকাশ ঘটাল। কারা এর মূল হোতা, নেপথ্যে কাদের ইন্ধন, এগুলো খুঁজে বের করার দায়িত্ব গোয়েন্দা বিভাগের। বিচার ও শাস্তি দেয়ার ভার যদিও অন্যের হাতে। চার. অশুভশক্তির এই ষড়যন্ত্র ও সাময়িক জয় কীভাবে নেবে প্রশাসন, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান উপেক্ষা, কীভাবে নেবে দেশের সুধী সমাজ তথা শুভশক্তি? আমাদের বিবেচনায় এ ক্ষেত্রে সমঝোতা বা আপস করার কোনো সুযোগ নেই। শক্ত হাতে দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে এবং উন্মাদ জনতাকে আইনসম্মত শাস্তি। কিন্তু প্রশ্ন থাকে, কয়েক দিন ধরে যে ধ্বংসাত্মক ঘটনা তা কি আরো আগে বন্ধ করা যেত না দ্রুত পুলিশি অভিযানে, র‌্যাবের দক্ষ তৎপরতায়? এর তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো, বড় কষ্টের কথা, যখন চৌদ্দপুরুষের বাস্তুভিটা থেকে কাউকে উৎখাত করতে তাদের ‘চেনা মুখগুলো আগুন ধরিয়ে দিল তাদের বাড়িতে। ওরা কীভাবে পরদিন ওদের মুখ দেখাবে?’ নিরাপত্তা রক্ষক প্রশাসনকে তাই দুধারী হাতিয়ার হতে হবে। একদিকে নির্ধারিত কঠিন শাস্তি, অন্যদিকে সমাজকে মানবিক চরিত্রে সমৃদ্ধ করার শ্রমসাধ্য, সময়সাধ্য কাজের দায়িত্ব নিশ্চিত করা। শেষেরটাই বড় কঠিন, যা শুরু করা দরকার ছিল বহু আগে। তা হয়নি বলে স্বার্থের হাতছানি বড় হয়ে উঠেছে। সে কেবল সুযোগের সন্ধানে থাকে। অশুভশক্তিকে ব্যবহার করে, নিজে অশুভ হওয়ার তাগিদে। রাজনীতি কখনো তাতে সমর্থন জোগায়। গোটা ঘটনার ভয়াবহতা ও বিধ্বংসী রূপ এবং এর গতিও দ্রুততা আমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে, বিশেষ করে সংবাদভাষ্যে ‘সরকার যখন হার্ডলাইনে’ এবং প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান যখন কঠোর। সে ক্ষেত্রে একটি খবরকে মেলাই কীভাবে- যেখানে সমকালে সংবাদ শিরোনাম বলছে, ‘হিন্দুপল্লীতে হামলার দুই আসামি পেলেন আ.লীগের মনোনয়ন’ ইউপি চেয়ারম্যান পদে। রহস্যটা কী? প্রধানমন্ত্রী কি দেখবেন বিষয়টি, তার দলের ভাবমূর্তি রক্ষার বিবেচনায়? বিশেষ করে যখন চলছে হামলার বিরুদ্ধে অভিযান ও ব্যাপক হারে গ্রেপ্তার। এ স্ববিরোধিতার জবাব পাওয়া কঠিন। শাহবাগ থেকে বিভিন্ন প্রতিবাদের মঞ্চের একটি কথা হলো ‘বিচার হয় না বলে বারবার হামলা’- কথাটা কি ঠিক? জবাব সরকারকে দিতে হবে। ভোরের কাগজও বলছে, ‘বিচারহীনতায় বারবার সাম্প্রদায়িক হামলা’ (১৯.১০.২০২১)। ঘটনার নানামুখী চরিত্রে মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামালের মতো আমরা দুঃখিত, লজ্জিত ও হতভম্বই নই, বরং হিন্দু সমাজের অসহায়তার কথা ভেবে বিচলিত, এ কারণে যে এ দেশে সংখ্যালঘু নাগরিকের জনসংখ্যা ২৩.১ থেকে কমে ৯.৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে (২০১১)। সুধী সমাজ একটু ভেবে দেখবেন, সীমান্ত পেরিয়ে মোদির হাতে হাতিয়ার তুলে দেবেন কিনা?

আহমদ রফিক : লেখক, গবেষক ও ভাষাসংগ্রামী।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App