×

জাতীয়

বিএনপি-জামায়াত-যুব ছাত্র অধিকার-ছাত্রলীগ একাকার

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৭ অক্টোবর ২০২১, ০৯:০৩ এএম

** ১১৮ মামলায় আসামি ২৪ হাজার, গ্রেপ্তার ৬৮৩, রাজনৈতিক নেতা ৩২ জন **

দেশের ১৬ জেলার কয়েকটি এলাকায় শারদীয় দুর্গাপূজা চলাকালে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনায় দেশ-বিদেশে ক্ষোভের ঝড় উঠেছে। হামলায় কারা জড়িত, এই অপকর্মের নেপথ্যে কারা- এ নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দারা কাজ করছে। এ পর্যন্ত ১১৮ মামলায় গ্রেপ্তারকৃত ৬৮৩ জনের মধ্যে কমপক্ষে ৩২ জনের রাজনৈতিক পরিচয় নিশ্চিত করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এদের মধ্যে জামায়াত সমর্থিত ৩ জন নির্বাচিত কাউন্সিলরসহ সংগঠনটির ৫ জন নেতাকর্মী রয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ইসলামী ছাত্র শিবিরের ৩ জন নেতাকর্মীকে। ডাকসুর সাবেক ভিপি নূরের সংগঠন যুবছাত্র অধিকার পরিষদের রয়েছে ১০ জন, বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যানসহ কমপক্ষে ১২ জন, স্বেচ্ছাসেবকদলের একজন, যুবদলের দুই জন, ছাত্রদলের একজন ও ছাত্রলীগের পরিচয়ধারী রয়েছে একজন। প্রাপ্ত তথ্য মতে, এরা হামলার পরিকল্পনা, নেতৃত্ব দেয়া ও ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়িয়ে অরাজকতা সৃষ্টিতে অন্যতম হোতা হিসেবে কাজ করেছেন।

এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে সচিবালয়ের গণমাধ্যম কেন্দ্রে বাংলাদেশ সেক্রেটারিয়েট রিপোর্টার্স ফোরাম (বিএসআরএফ) আয়োজিত ‘বিএসআরএফ সংলাপ’ অনুষ্ঠানে বলেছেন, স¤প্রতি দেশের পূজামণ্ডপে সহিংসতায় ইন্ধনদাতাদের নাম শিগগিরই প্রকাশ করা হবে। তিনি বলেছেন, কুমিল্লায় পূজামণ্ডপে পবিত্র কুরআন রাখাকে কেন্দ্র করে সহিংসতায় এ পর্যন্ত ১০টি মামলা হয়েছে। জবানবন্দিতে রংপুর ও নোয়াখালীর ঘটনায় ইন্ধনদাতাদের নাম বলেছে গ্রেপ্তারকৃতরা। তবে আমরা শতভাগ নিশ্চিত হয়ে আপনাদের সামনে নাম প্রকাশ করবো। সেখানে বিএনপি-জামায়াত আছে কিনা- সেটা এখনই বলতে চাচ্ছি না। নিশ্চিত হয়েই জানাতে চাই। তিনি বলেন, নোয়াখালীতে কিন্তু তারা নাম বলে দিয়েছে, এখনই বলছি না। আপনারা এমন এমন নাম শুনবেন যেখানে আপনাদেরও খুব পরিচিত ব্যক্তিদের নাম রয়েছে। রংপুরের যে ঘটনা সেখানেও নাম বলেছে, কাজেই সবই আমরা আপনাদের খুব শিগগিরই জানিয়ে দেব। কুমিল্লায় আরো জিজ্ঞাসাবাদের পর সমস্ত কিছু জানিয়ে দেব।

জানা গেছে, সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় সারাদেশে দায়েরকৃত ১১৮টি মামলায় আসামি করা হয়েছে ২৩ হাজার ৯১১ জনকে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৬৮৩ জনকে। এরমধ্যে চাঁদপুরে বিভিন্ন এলাকায় ১০ মামলায় আসামি করা হয়েছে ৫ হাজার জনকে, গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৩৩ জনকে। নোয়াখালীতে ২৪ মামলায় আসামি করা হয়েছে ৭ হাজার ৯৬১ জনকে, গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১৬২ জনকে। কুমিল্লায় ৯ মামলায় ৭৯২ আসামি, গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৫৬ জনকে। ফেনিতে ৪ মামলায় ৬৫০ আসামি, গ্রেপ্তার ১৮। রংপুর ৪ মামলায় ৪১ আসামি, গ্রেপ্তার ৬৪। সিলেট ২ মামলায় ৭৯২ আসামি, গ্রেপ্তার ২০। চট্টগ্রামে ৭ মামলায় আসামি ৩ হাজার ৮৫০, গ্রেপ্তার ২০১।

কুড়িগ্রামে ৬ মামলায় ১ হাজার আসামি গ্রেপ্তার ৩৯ জন। চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১ মামলায় ১৫০ আাসামি, ১৩ জন গ্রেপ্তার, গাজীপুরে ৩ মামলায় ৬২০ আসামি, গ্রেপ্তার ৪১। কক্সবাজারে ৬ মামলায় ২ হাজার ২৪৩ আসামি, গ্রেপ্তার ১৬। দিনাজপুরে ১ মামলায় ২৮ আসামি, গ্রেপ্তার ৫। মৌলভীবাজারে ৩ মামলায় ১৯ আসামি, গ্রেপ্তার ৬। নাটোরে অজ্ঞাতদের আসামি করে একটি মামলা হলেও গ্রেপ্তার নেই। বান্দরবানে ৩ মামলায় ৬৬২ আসামি, গ্রেপ্তার ৯। বরিশালের গৌরনদী থানায় ১০৪ জনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করা হলেও কোনো গ্রেপ্তার নেই।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কুমিল্লা জেলার বিভিন্ন পূজামণ্ডপে হামলার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় যাদেরকে আসামি করা হয়েছে; তাদের মধ্যে জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ৩ জন কাউন্সিলর রয়েছে। তারা হলেন- নগরীর ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাজী গোলাম কিবরিয়া, ৬ নম্বর ওয়ার্ডের মোশাররফ হোসেন ও ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ইকরাম হোসেন বাবু। বিশেষ ক্ষমতা আইনে তাদের মামলার আসামি করা হয়েছে।

রংপুরের পীরগঞ্জে হিন্দুপাড়ায় সহিংসতার ঘটনায় দুইজন ছাত্র শিবির ও একজন ছাত্রলীগ নেতার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। দুই শিবিরকর্মী হলেন, মো. মামুন ও উমর ফারুক টনেট। হামলায় জড়িত থাকার কথা শিকার করে ইতোমধ্যে জবানবন্দি দেয়া ছাত্রলীগ নেতা হলেন সৈকত মণ্ডল। তিনি রংপুর কারমাইকেল কলেজ দর্শন বিভাগ ছাত্রলীগের সহসভাপতি। পীরগঞ্জে হামলায় অন্যতম হোতা তিনি। এ ঘটনায় র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার রবিউল ইসলাম রামনাথপুর ইউনিয়নের বটেরহাট জামে মসজিদের ইমাম।

কুমিল্লায় পূজামণ্ডপে কুরআন অবমাননার অভিযোগ ওঠার পর চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে সহিংসতার ঘটনা ভয়ংকর রূপ ধারণ করে। হাজীগঞ্জ বাজারে শ্রীশ্রী লক্ষী-নারায়ণ জিউ আখড়া ও পাশের রামকৃষ্ণ মিশনের মন্দিরে হামলা করে একদল যুবক। সাম্প্রদায়িক হামলা নিয়ন্ত্রণে গেলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে হামলাকারীদের। এতে মোট ৫ জন প্রাণ হারায়। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে ১০টি মামলা করেছে। এসব মামলায় অজ্ঞাত প্রায় দুই হাজার ব্যক্তিকে আসামি করা হয়। এরই মধ্যে উপজেলা ছাত্রশিবিরের সভাপতি বর্তমানে জামায়াত নেতা কামালউদ্দিন আব্বাসীসহ ২৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। যাদের অনেকেই শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। জামায়াত নেতা কামালউদ্দিন আব্বাসী মন্দিরে হামলাকারীদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন বলে সিসি ক্যামেরা ফুটেজে দেখা গেছে। একইসঙ্গে এ সহিংসতার পেছনে স্থানীয় আওয়ামী লীগের বিভাজনকে দায়ী করেছেন স্থানীয়রা। সিসি ক্যামেরার ফুটেজে বেশ কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতাকেও দেখা গিয়েছে। কিন্তু তারা হামলা ঠেকাতে সেখানে গিয়েছেন বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন।

চট্টগ্রাম নগরীর আন্দরকিল্লা জেএমসেন হল পূজামণ্ডপে হামলা, ফটকের ব্যানার ছিঁড়ে ফেলা ও মণ্ডপে ঢিল ছোড়ার ঘটনায় ডাকসুর সাবেক ভিপি নূরের সংগঠন যুবছাত্র অধিকার পরিষদের নেতাকর্মীসহ ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা হলেন- যুব অধিকার পরিষদের চট্টগ্রাম মহানগরের আহ্বায়ক মো. নাছির, সদস্য সচিব মিজানুর রহমান, বায়েজিদ বোস্তামী থানার আহ্বায়ক মো. রাসেল, নগর ছাত্র অধিকার আন্দোলনের দপ্তর সম্পাদক মো. ইমন, কর্মী ইয়ার মোহাম্মদ, জিয়া উদ্দিন, ইয়াসিন আরাফাত, হাবিবুল্লাহ, ইমরান হোসেন ও মো. মিজান। পুলিশ জানিয়েছে, পূজা ঘিরে সারা দেশে অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য পরিকল্পিতভাবে এ কাজ করেছে তারা।

নোয়াখালীর বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনাগুলোর মধ্যে চৌমুহনীতে পূজামণ্ডপ ও মন্দিরে হামলা-ভাঙচুরের ঘটনায় জামায়াত ও বিএনপির অঙ্গসংগঠনের ৫ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা হলেন- নোয়াখালী জেলা স্বেচ্ছাসেবকদলের সহসভাপতি ফয়সাল ইনাম কমল, বীজবাগ ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জামায়াত নেতা হারুন অর রশীদ, জেলা যুবদলের সহসাংগঠনিক সম্পাদক মো. রায়হান, পূর্ব চরমটুয়া ইউনিয়ন বিএনপির যুগ্ম-আহ্বায়ক ফয়সাল বারী চৌধুরী, পূর্ব চরমটুয়া ইউনিয়ন ছাত্রদলের সদস্য সচিব বেলায়েত হোসেন।

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে হামলা-ভাঙচুর ও পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় চৌমুহনী পুলিশ ফাঁড়ির উপপরিদর্শক (এসআই) জামাল হোসেন বাদী হয়ে মামলা করেন। ওই মামলায় বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লা বুলুকেও হুকুমের আসামি করা হয়েছে। এই মামলায় ৩ নম্বর আসামি করা হয়েছে জেলা যুবদলের সভাপতি মঞ্জুরুল আজিম ওরফে সুমনসহ দলের ১০-১২ জন নেতাকর্মীকে। মামলার এজাহারে বাদী উল্লেখ করেন, নোয়াখালী-৩ আসনের সাবেক সাংসদ ও বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লা বুলু তার অনুগত স্থানীয় নেতাকর্মী ও সাধারণ জনগণের সঙ্গে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচার করে হামলায় ইন্ধন দেন বলে স্থানীয়ভাবে জনশ্রæতি রয়েছে। এ ছাড়াও কুমিল্লায় কুরআন শরিফ অবমাননার অভিযোগ তুলে পূজা মণ্ডপে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনার দিন উস্কানিমূলক বক্তব্য দেয়ার অভিযোগে আবদুর রহিম বিপ্লবী নামে এক ইসলামী বক্তাকে গ্রেপ্তার করেছে সিআইডি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App