×

সারাদেশ

সাঁথিয়া-হোমনায় সম্প্রীতি ফিরলেও আতঙ্ক কাটেনি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৭ অক্টোবর ২০২১, ০৯:২৩ এএম

ধর্মীয় অবমাননার গুজব রটিয়ে বারবারই হামলা চালানো হয়েছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর। বাংলাদেশে গত এক যুগে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, দুই-এক বছর পরপরই এমন গুজব রটিয়ে হামলা চালানো হচ্ছে। এ রকম জঘন্য ঘটনা শুরু হয় ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর, কক্সবাজারের রামুতে। এরপর ২০১৩ সালের ২ নভেম্বর পাবনার সাঁথিয়া, ২০১৬ সালে ৩০ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, ২০১৭ সালের ১০ নভেম্বর রংপুরের গঙ্গাচড়ায়, ২০১৯ সালে ২০ অক্টোবর ভোলার বোরহানউদ্দিনে ব্যাপক আকারে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি দুর্গোৎসবের সময়ও সাম্প্রদায়িক হামলা ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। আইনে ধর্মীয় অবমাননার সুস্পষ্ট সংজ্ঞা ও শাস্তির বিধানের উল্লেখ থাকলেও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে এই আইনের প্রয়োগ নেই বললেই চলে।

রামুর ঘটনার এক বছর পার হতে না হতেই আবারও ফেসবুকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগে হামলা চালানো হয় পাবনার সাঁথিয়ার বনগ্রামে হিন্দুপল্লীতে। সাঁথিয়ার এ ঘটনার ছয় মাসের মাথায় একই অভিযোগে হামলা চালানো হয় কুমিল্লার হোমনায়। স্থান ও হামলাকারী ব্যক্তি ভিন্ন হলেও নৃশংসতার চিত্র একই।

যা ঘটেছিল সাঁথিয়া ও হোমনায় : সাঁথিয়ার ঘটনাটি ঘটে ২০১৩ সালের ২ নভেম্বর। এই হামলায় দেখা যায় নতুন একটি বৈশিষ্ট্য। এলাকায় চালানো হয় ত্রিমুখী হামলা। একদল বাজারে মিছিল বের করে, একদল পাবনা-নগরবাড়ী সড়কে কাঠের গুঁড়ি ফেলে রাস্তা বন্ধ করে দেয়। অন্য দলটি লাঠিসোটা, ধারালো অস্ত্র নিয়ে হিন্দু বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও মন্দিরগুলোয় হামলা চালায়। ঘটনার দিন উপজেলার বনগ্রাম বাজারে সকাল ১০টায় গুজব ছড়ানো হয়, স্থানীয় ব্যবসায়ী বাবলু সাহার ছেলে রাজীব সাহা (১৫) ফেসবুকে মহানবী (সা.) সম্পর্কে কটূক্তি করেছে। এ খবরে বাজারের কিছু ব্যবসায়ী উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। বেলা ১১টার দিকে ফেসবুকের একটি পাতার ফটোকপি বাজারে ছড়িয়ে দেয়া হয়। সেখানে কথিত ফেসবুক পাতার নামসহ কভার ছবি, প্রোফাইল ছবি ও একটি পোস্ট ছিল। ফেসবুক পাতাটির নাম ছিল আপত্তিকর এবং কভারে ব্যবহার করা হয় আপত্তিকর একটি কার্টুন। ফেসবুক পাতার ফটোকপি ছড়িয়ে পড়ার পর পাড়ামহল্লায় স্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ে উত্তেজনা। বিক্ষুব্ধরা বনগ্রাম বাজারে বাবলু সাহার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে রাজীবকে হাজির করতে বলে। হুমকিধমকি দেন। বাবলু সাহা ছেলেকে হাজির না করায় উত্তেজিত জনতা আরো বিক্ষুব্ধ হয়ে বাজারের মাঝ দিয়ে

যাওয়া ঢাকা-পাবনা মহাসড়কে গাছের গুঁড়ি ফেলে অবরোধ করে বিক্ষোভ করতে থাকে। এতে সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। দুপুর ১২টার দিকে গ্রামের ঘোষপাড়া ও সাহাপাড়ায় ভাঙচুর শুরু করে। এদিকে একটি গ্রুপ প্রথমে সাহাপাড়ায় বাবলু সাহার বাড়িতে হামলা চালিয়ে বাড়িঘর ভাঙচুর করে আগুন লাগিয়ে দেয়। এরপর ঘোষপাড়ায় হিন্দু স¤প্রদায়ের বেশ কয়েকটি বাড়ি ও দুটি মন্দির ভাঙচুর করে। বাজারে বাবলু সাহার দোকানসহ কয়েকটি দোকান ভাঙচুর করে। ওই সময় ৩০-৩৫টি হিন্দু বাড়িতে ভাঙচুর এবং লুটপাট করে দুষ্কৃতিকারীরা।

পরবর্তীতে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় রাজীবের বিরুদ্ধে মামলা করে পুলিশ। কিন্তু অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হয়নি। এমনকি পুলিশের তদন্তেও বেরিয়ে আসে রাজীব এ রকম কোনো পোস্ট দেয়নি। মিথ্যা অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পায় রাজীব। তবে কে বা কারা ওই পোস্ট দিয়েছিল, তা আজো শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ।

উৎসব দাস ও শ্রীনিবাস দাস ফেসবুকে ইসলামের নবীকে (সা.) কটাক্ষ করে পোস্ট দিয়েছে- এমন মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল কুমিল্লা জেলার হোমনা উপজেলার সীমান্তবর্তী বাঘসীতারামপুর হিন্দু প্রধান গ্রামে ২৮টি পরিবারের বাড়িঘরে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। আক্রমণ করা হয় মন্দিরেও, চালানো হয় ভাঙচুর। এ হামলায় মূলত পাশের উপজেলা মুরাদনগরের পাঁচকিপটা গ্রামের কয়েকশ মানুষ অংশ নেয়। ঘটনার দিন পাঁচকিপটা গ্রামের রামপুরা মাদ্রাসার মাইকে প্রচার করা হয় ইসলাম ও মহানবীর (সা.) বিরুদ্ধে ফেসবুকে পোস্ট দেয়া হয়েছে। এরপরই আশপাশের কয়েক গ্রামের বাসিন্দাদের একত্র করে বাঘসীতারামপুরের হিন্দু বাড়িগুলোতে আক্রমণ করা হয়। পুলিশ উৎসব ও শ্রীনিবাসকে আটক করে। তবে পরবর্তীতে প্রমাণিত হয়, ওই ধরনের কোনো পোস্ট তারা দেয়নি।

হামলার নেতৃত্বে যাদের নাম : সাঁথিয়ার হামলার ঘটনায় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ছাড়াও বিএনপি-জামায়াত এবং উচ্ছৃঙ্খল সাধারণ মানুষের সংশ্লিষ্টতা ছিল বলে দাবি করেন এলাকাবাসী। হোমনার সহিংস ঘটনায় এলাকার বাইরের লোকজন অংশ নেয় বলে অনেককেই শনাক্ত করা যায়নি। তবে এই ঘটনায় শফিক, রবি, জামাল, ফারুকসহ অর্ধশত ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা বর্তমানে চলছে।

মামলা ও আসামির সংখ্যা : বাড়িতে হামলা, মন্দির ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার পরের দিন ৩ নভেম্বর বাবুল সাহা বাদী হয়ে সাঁথিয়ার আতাইকুলা থানায় একটি মামলা করেন। আর পুলিশ বাদী হয়ে দুটি মামলা করে। বাবলু সাহার মামলায় আসামি ছিল ২০ জন। এছাড়া অজ্ঞাত আরো আড়াই’শ ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছিল। হোমনার ঘটনায় বাঘসীতারামপুর গ্রামের ডা. রামপদ দাস দেড় হাজারের বেশি ব্যক্তিকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেন।

মামলার বর্তমান অবস্থা : সাঁথিয়ার ঘটনায় আতাইকুলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জালাল উদ্দিন জানান, বাবলু কুমার সাহার মামলাটি সিআইডি তদন্ত করে। অন্য দুটি মামলার একটি ডিবি পুলিশ ও অন্য আরেকটি থানা পুলিশ তদন্ত করে চার্জশিট দিয়েছে। তিনটি মামলাই বিচারাধীন রয়েছে। এলাকায় এখন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিরাজ করছে বলে তিনি দাবি করেন।

হোমনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল কায়েস আকন্দ ভোরের কাগজকে বলেন, বাঘসীতারামপুরে হামলার ঘটনায় যে মামলাটি রয়েছে, তা চলমান। চার্জশিট দেয়া হয়েছে। মামলাটি বিচারাধীন আছে।

ভুক্তভোগী ও এলাকাবাসীর বক্তব্য : বনগ্রামের বাসিন্দা ও বনগ্রাম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক গোপাল চন্দ্র ঘোষ বলেন, আমরা এখন ভালো আছি। তবে অজানা আশঙ্কা এখনো তাড়া করে। দেশের বিভিন্ন হিন্দু পল্লীতে হামলার খবর শুনলেই আট বছর আগের দুঃসহ স্মৃতি মনে করে আঁতকে উঠি। মনে আশঙ্কা হয় আবার কখন যেন হামলার শিকার হই।

বনগ্রামবাসীরা জানান, ওই দিন ছিল কালী পূজা। হামলার ঘটনায় ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের খুব একটা দেখা যায়নি। সেখানে বেশির ভাগ ছিল উচ্ছৃঙ্খল যুবক ও সুযোগসন্ধানী কিছু লোকজন। সন্ত্রাসীরা লুটপাটের একটা বিরাট সুযোগ মনে করে লুটপাট চালায়। যাদের অনেককেই পুলিশ শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে। অভিযুক্তরা অনেকে কিছুদিন কারাবাস করেছে, আবার কেউ বিদেশে চলে গিয়েছিল। আবার সাক্ষ্যপ্রমাণের ভয়ে অনেককেই আইনের আওতায় আনতে পারেনি পুলিশ। তবে ওই হামলার পর জনগণের নিরাপত্তার জন্য এলাকায় একটি অস্থায়ী পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন করা হয়েছে।

বাঘসীতারামপুরের রামপদ দাসের ভাই দুর্গাপদ দাস জানান, তিন বছর আগে রামপদ দাসের মৃত্যু হয়। রামপদ দাস যে মামলাটি করেছিলেন, তাতে অর্ধশত ব্যক্তির বিরুদ্ধে এখনো মামলা চলছে। তবে এলাকায় এখন কোনো সমস্যা নেই। তারা ভালো আছেন। এদিকে নিরাপত্তাহীনতায় হোমনার সহিংস ঘটনায় কেউ সাক্ষ্য দিতে সাহস পায়নি বলে জানান বাঘসীতারামপুরবাসী।

বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বক্তব্য : বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সাঁথিয়া শাখার সাধারণ সম্পাদক সুশীল কুমার দাস ভোরের কাগজকে বলেন, প্রত্যক্ষদর্শীরা সাক্ষ্য দিতে চায় না। এতে মামলা ঝুলে আছে। ওইদিন হামলার ঘটনাটি এমনভাবে ঘটেছে যে একেবারে হ-য-ব-র-ল অবস্থা। বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের হোমনা শাখার সাধারণ সম্পাদক রাজীব চৌধুরী ভোরের কাগজকে জানান, ওই ঘটনার পর এখন পর্যন্ত কোনো সমস্যা হয়নি। তবে সম্প্রতি দুর্গোৎসব চলাকালে যে সংহিস ঘটনা ঘটেছে, তাতে আমরাও আতঙ্কিত। এ ঘটনার পরপরই স্থানীয় চেয়ারম্যানকে প্রধান করে আইনশৃঙ্খলা কমিটি করে দেয়া হয়েছে। একই এলাকার ঐক্য পরিষদের সদস্য রঞ্জিত দাস ভোরের কাগজকে বলেন, আমরা ভালো আছি। তবে মামলাগুলো ঝুলে আছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App