×

মুক্তচিন্তা

দেশ কি সত্যি সব মানুষের হয়েছে?

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৭ অক্টোবর ২০২১, ০১:২২ এএম

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় রথীন্দ্রনাথ রায়ের গাওয়া স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত একটি গান ভীষণ জনপ্রিয় হয়েছিল। পরেও বহুবার বহু অনুষ্ঠানে রথীনদার কণ্ঠে সরাসরি গানটি শোনার সুযোগ আমার হয়েছে। গানটির সুর, কথা এবং রথীনদার গায়কি প্রতিবারই আমার মনে ভিন্নতর দ্যোতনা তৈরি করেছে। এখনো কান পাতলে যেন এই সুরধ্বনি শুনি। কোথাও কোনো বিভেদ-বিভ্রান্তি-হানাহানির কথা শুনলে ওই গানটির প্রথম চরণ আমার মনে কেন যেন অনুরণন তোলে। গানটি হলো : ছোটদের বড়দের সকলের/গরিবের নিঃস্বের ফকিরের/আমার এ দেশ সব মানুষের, সব মানুষের। নেই ভেদাভেদ হেথা চাষা আর চামারে/নেই ভেদাভেদ হেথা কুলি আর কামারে/হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, দেশ মাতা এক সকলের। লাঙলের সঙ্গে আজ চাকা ঘুরে এক তালে/এক হয়ে মিশে গেছি আমরা সে যে কোন প্রাণে/মসজিদ, মন্দির, গির্জার আবাহনে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই করে কেন বাংলাদেশ নামের একটি আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা জরুরি হয়ে পড়েছিল? শোষণ-বঞ্চনা-বৈষম্যই ছিল তার প্রধান কারণ। মানুষ বাঁচতে চায় অধিকার নিয়ে, সম্মান নিয়ে। অর্থনৈতিক বৈষম্য, ধর্ম নিয়ে বৈষম্য- এগুলো মানুষের মানবিক ও নাগরিক অধিকার পরিপন্থি। সব ধরনের বৈষম্য থেকে বাংলাদেশ মুক্ত থাকবে সেটাই ছিল মুক্তিকামী মানুষের আশা। যিনি বাঙালির মনে এই আশা জাগিয়ে তুলেছিলেন, যিনি ভেতো বাঙালি বলে উপহাসের শিকার বাঙালি জাতির মনে অসম সাহস জুগিয়েছিলেন- সেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও চেয়েছিলেন ন্যায্যতাভিত্তিক একটি দেশ। ধনী-গরিবের বৈষম্য নয়, হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানে বৈষম্য নয়। বাংলাদেশ হবে সব মানুষের বাসযোগ্য নিরাপদ একটি রাষ্ট্র। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত দেশের সংবিধানে তাই সমতার তথা বৈষম্যহীনতার নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল। স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে আমরা দেখছি, যা পেয়েছি তার সবটা প্রত্যাশার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। অনেক ভালো কিছু অর্জন যেমন আছে, তেমনি কিছু কিছু অর্জিত জিনিস যে আমাদের হাত ছাড়া হয়ে গেছে, তা-ও তো মিথ্যা নয়। স্বাধীনতার সাড়ে ৩ বছরের মাথায় জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে দেশের যে উল্টোযাত্রা শুরু হয়েছিল পরবর্তী সময়ে অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়েও তা আর পুরো মাত্রায় সঠিক ধারায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। এখন টানা তিন মেয়াদে দেশের শাসন ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল, বঙ্গবন্ধুর দল। সরকারপ্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। দেশের একদিকে উন্নয়ন হচ্ছে, অন্যদিকে মানবিক মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতায় অধোগতি গোপন করা যাচ্ছে না। দেশে কোটিপতির সংখ্যা বাড়ছে আবার গরিব মানুষের সংখ্যাও কি খুব কমছে? আয় বাড়ছে কিন্তু সব মানুষের জন্য সমানতালে নয়। বরং উৎকট ধনবৈষম্যের চিত্রই প্রকট হচ্ছে। সহিষ্ণুতা কমছে, হিংসা বাড়ছে। শিক্ষার হার বাড়ছে আবার মানুষের মধ্যে অন্ধত্ব বাড়ছে। অসাম্প্রদায়িক এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বপ্ন এখনো অধরা। ছুঁতানাতায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিবেশ নষ্ট করা হচ্ছে। ভয়ের সংস্কৃতির বিস্তার ঘটছে।

দুই. এবার দুর্গাপূজার সময় কয়েক দিন যেসব কাণ্ড ঘটল তাকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। কুমিল্লা, নোয়াখালী, চৌমুহনী, চট্টগ্রাম, রংপুরসহ কয়েকটি জেলায় হিন্দু সম্প্রদায়কে যে নির্যাতন ভোগ করতে হলো, তা খুব সুন্দর ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিচ্ছে না। এক দশক ধরে মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা অব্যাহতভাবে চলছে। এর আগের প্রতিটি ঘটনা একটি নির্দিষ্ট জায়গায় সীমিত থেকেছে। এবার ছড়িয়েছে এক জায়গা থেকে বহু জায়গায়। আগে এসব ঘটনার পেছনে উসকানি ও ইন্ধনদাতা হিসেবে বিএনপি-জামায়াতসহ ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে দায়ী করা হতো। এবার দেখা গেল আওয়ামী লীগও পিছিয়ে নেই। এমনিতে দেশের রাজনীতিতে ঐক্যের দারুণ অভাব। দলগুলো একমতে একপথে চলতে চায় না। এবার হিন্দুদের ওপর হামলায় দেখা গেল দেশে বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জামায়াতের এই অভূতপূর্ব ঐক্য দেশের জন্য কোনো ভালো বার্তা দিচ্ছে না। আওয়ামী লীগ দলটির মধ্যে যে নীতি-আদর্শের চর্চা কমেছে, সে কথা আগে কেউ বলেননি তা নয়। কিন্তু এবার তার প্রমাণ হাতেনাতে পাওয়া গেছে। রংপুরের পীরগঞ্জে হিন্দু পল্লীতে রাতের অন্ধকারে আক্রমণের প্রধান হোতা ছাত্রলীগ করেন। বিভিন্ন মামলায় যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগের পরিচয়ধারীরাও আছেন। হয়তো বলা হবে, যারা এসব করেছে তারা আসলে অনুপ্রবেশকারী, উচ্ছিষ্টভোগী। কাউয়া, হাইব্রিড ইত্যাদি। হতে পারে না তা নয়। এবার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে জামায়াত-শিবির-বিএনপি থেকে আসা কিংবা ওইসব পরিবারের সদস্য আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন কীভাবে? দেশে এখন বঙ্গবন্ধুর সৈনিকের অভাব নেই। এমন মেকি সৈনিক ১৯৭৫ সালেও অনেক ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর তারা আগে পালিয়েছিল। সুসময়ের বন্ধু অনেকেই হয় হতে চায়। দুর্দিনে তাদের খুঁজে পাওয়া যায় না। আওয়ামী লীগ যদি এখনই শত্রæ-মিত্র বাছাইয়ের কাজটিতে মনোযোগ না দেয় তাহলে শুধু কথায় কথায় বিএনপি-জামায়াতের দিকে কামান দেগে লাভ হবে না। ঘর শত্রæ বিভীষণের সংখ্যা আওয়ামী লীগে বেড়েছে বলে মনে করার কারণ রয়েছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে হবে। প্রতিটি এলাকায় আমাদের নেতাকর্মীদের নজরদারি বাড়াতে হবে এবং শান্তি সম্মিলন, শান্তি মিছিল, শান্তি সভা করতে হবে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে কোনো রকম সংঘাত তৈরি না হয়। দল ও সরকারের প্রধান হিসেবে তিনি সঠিক নির্দেশনাই দিয়েছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, আওয়ামী লীগের সব স্তরের নেতাকর্মীর মনমানসিকতা কি সম্প্রীতির অনুকূলে আছে? আওয়ামী লীগের মধ্যে কেউ কেউ পচন এবং পতন লক্ষ করছেন। সেটা হয়তো পুরোটা ভ্রান্ত নয়। নীতি ও আদর্শ থেকে আওয়ামী লীগের অনেকেরই যে বিচ্যুতি ঘটেছে তা অস্বীকার করা যাবে না। আওয়ামী লীগকে রোগমুক্ত করতে হলে উপযুক্ত চিকিৎসার প্রয়োজন।

তিন. সাংবাদিক হাসান মামুন তার ফেসবুকে লিখেছেন, দেশ মানে ঊর্ধ্বমুখী দালানকোঠা আর নদীর বুকে দাঁড় করানো সেতু নয়। দেশ মানে মানুষ, তার নিরাপত্তা, সম্মান ও স্বস্তি। এসব ছাড়া দেশ নিয়ে আমরা কী করব? কানাডা প্রবাসী সাংবাদিক শওগত আলী সাগর লিখেছেন, বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ এই আপ্তবাক্যে ফাটল ধরেছে অনেক আগেই। সেই ফাটল দিয়ে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ঢুকছেই কেবল- এ সত্য অস্বীকার করে সমস্যার সমাধান করা যাবে না। সমস্যা সমাধান করতে হলে সমস্যা যে আছে সেটা স্বীকার করে তারপর সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে। সাংবাদিক জ ই মামুন মনে করেন না যে বাংলাদেশ আবার কখনো পুরোপুরি অসাম্প্রদায়িক দেশ হবে। কারণ আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থা, সংবিধান, সরকার, রাজনীতি, সমাজ, পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান- কোনো কিছুই আর মনেপ্রাণে অসাম্প্রদায়িক নেই। বাংলাদেশে সমাজ মানসে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। মানুষ এখন আর মানুষের বিপদে গিয়ে পাশে দাঁড়ায় না। এখানে হিন্দুদের ওপর হামলাকে যৌক্তিক প্রতিপন্ন করা হয় ভারতে মুসলমানদের ওপর হামলার উদাহরণ টেনে। অন্যের অপকর্মের উদাহরণ টেনে নিজের অপকর্মের সাফাই গাওয়া যে অপরাধীদেরই সাজে- সেটা বোঝার মতো মানসিক স্থিতিও এখন অনেকের নেই। তাই ‘কেউ ছাড় পাবে না’ এই ভাঙা রেকর্ড বাজিয়ে এখন আর কাজ হবে না। প্রকৃত শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চার ব্যবস্থা না করে শুধু মসজিদ-মাদ্রাসা বাড়িয়ে সম্প্রীতির ধারায় ফেরা যাবে না। ইসলাম যে শান্তির ধর্ম এই শিক্ষা বা প্রচার কে করছেন? যারা ধর্ম শিক্ষা দিচ্ছেন তাদের বেশির ভাগ অন্য ধর্মের গীবত করাকেই প্রধান কাজ ভাবছেন। ফলে বিদ্বেষ বাড়ছে, অসহিষ্ণুতা বাড়ছে। ধর্ম চর্চার নামে পরধর্মের বিষোদ্গার বন্ধ না করতে পারলে ‘শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস’। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, নিজের ধর্ম পালনের অধিকার যেমন সবার আছে, তেমনি অন্যের ধর্মকে কেউ হেয় করতে পারে না। এটা ইসলাম শিক্ষা দেয় না। তাহলে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা কী- তা প্রচারের ব্যবস্থা কি আছে? যারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ধর্ম শিক্ষা দিচ্ছেন তারা আসলে কী পড়াচ্ছেন, কী শেখাচ্ছেন সেসবের তদারকির কোনো ব্যবস্থা কি সরকারের আছে? এ অঞ্চলে ইসলাম এসেছিল সুফি দরবেশদের মাধ্যমে। তারা শিখিয়েছেন সহিষ্ণুতা, উদারতা আর বার্তা দিয়েছেন সম্প্রীতির। অথচ তিন-চার দশকে এ অঞ্চলে ইসলাম রূপান্তরিত হয়ে ওয়াহাবী ইসলামের প্রাধান্য তৈরি হয়েছে। একশ্রেণির আলেম ওয়াজের নামে আসলে হিংসার প্রচার করেন। ‘বিধর্মীদের’ হত্যার প্ররোচনা দেন। মধ্যপ্রাচ্যে শিয়া-সুন্নি হানাহানি, পাকিস্তানে কাদিয়ানী নিধন, আফগানিস্তানে তালেবানি উত্থান- এসব বিবেচনায় নিয়েই বাংলাদেশে সম্প্রীতির পথ তৈরি করতে হবে। কাজটি সহজ নয় বরং খুবই কঠিন। তাই আমাদের সবারই প্রতিজ্ঞা হোক : ‘কঠিনেরে ভালোবাসিলাম, সে কখনো করে না বঞ্চনা’। বিভুরঞ্জন সরকার : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App