×

সারাদেশ

রামুর ক্ষত এখনো শুকায়নি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৬ অক্টোবর ২০২১, ০৯:০১ এএম

রামুর ক্ষত এখনো শুকায়নি

২০১২ সালে ধর্মীয় সহিংসতার জেরে ঝলসে দিয়েছিল কক্সবাজারের রামু বৌদ্ধ বিহার। ফাইল ছবি

২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর গুজব ছড়ানো হয়- রামুর হাইটুপী গ্রামের উত্তম বড়ুয়া নামের এক বৌদ্ধ তরুণ ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে ইসলাম ধর্ম, কুরআন শরিফ ও নবীকে অবমাননা করে ছবি পোস্ট দিয়েছে। যদিও পরবর্তী সময়ে ফেসবুকে পোস্ট করা ওই ছবিটি ফটোশপের মাধ্যমে তৈরি বলে প্রমাণিত হয়। এই গুজবের সূত্র ধরে উগ্রবাদীরা ২৯ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ১২টার দিকে বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর ওপর বর্বর হামলা চালায়। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছিল রামু উপজেলার বৌদ্ধ পল্লী। আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয় ১২টি বৌদ্ধ বিহার ও ২৬টি বসতঘর। রামুর রেশ ছড়িয়ে পড়ে উখিয়া, টেকনাফসহ চট্টগ্রামের পটিয়া এলাকায়ও। হামলা, লুটপাট ও ভাঙচুর চালানো হয় আরো ৬টি বৌদ্ধবিহার এবং শতাধিক বসতঘরে। পরদিন ৩০ সেপ্টেম্বর বিকালে উখিয়া ও টেকনাফে আরো ৪টি বৌদ্ধবিহারে হামলা হয়। পুড়ে যায় বিহারে থাকা হাজার বছরের প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, প্রশাসনের কাছে সহযোগিতা চেয়েও তারা তখন তা পাননি। তারা বলছেন, মন্দির থেকে আধা কিলোমিটার দূরে রামু থানা। অথচ পুলিশ ঘটনাস্থলে আসে রাত ৩টার পর। মাত্র ৪ কিলোমিটার দূরে আর্মি ক্যাম্প ছিল। প্রশাসন আর্মির কাছেও সহযোগিতা চায়নি।

হামলার নেতৃত্বে যাদের নাম: স্থানীয়দের বক্তব্য ওই দিনের পুরো সহিংসতার ঘটনায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কক্সবাজার জেলা মৎস্যজীবী লীগ নেতা আনছারুল হক ভুট্টো, রামু প্রেস ক্লাব সভাপতি ও ছাত্রলীগের সাবেক নেতা নুরুল ইসলাম সেলিম, ছাত্রলীগ নেতা সাদ্দাম হোসেন, যুবলীগ নেতা সালামত উল্লাহ, ছাত্রলীগ নেতা মো. মোর্শেদ, জাহেদুল ইসলাম জাহেদ, রামু কলেজ ছাত্রলীগ নেতা কাইছার হামিদ ও রিদুয়ান আহমেদ।

এ প্রসঙ্গে রামু বৌদ্ধ ঐক্য কল্যাণ পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, যুবলীগ নেতা ও ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী পলক বড়–য়া আপ্পু ভোরের কাগজকে বলেন, ওই দিন মিছিল ও জ্বালাও-পোড়াওয়ে অংশ নিয়েছিল দুটি গ্রুপ। হামলা ও জ¦ালাও-পোড়াওয়ের আগে খণ্ড খণ্ড মিছিল বের হয়। মিছিলে তৎকালীন সরকার দলীয় ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা ছিলেন। বলা যায়, তাদের ব্যবহার করা হয়। কিন্তু জ¦ালাও-পোড়াওয়ে অংশ নেয় আরেকটি গ্রুপ।

মামলা ও আসামির সংখ্যা: আদালত সূত্রে জানা যায়, বৌদ্ধ পল্লীতে হামলার ঘটনায় দায়ের করা হয় ১৯ মামলা। এর মধ্যে রামু থানায় দায়ের করা একটি মামলার বাদী সুধাংশু বড়–য়া আর বাকি ১৮টি মামলার বাদীই পুলিশ। এসব মামলার এজাহারে নাম-ঠিকানা উল্লিখিত আসামি ছিল ৩৭৫ জন। রামু থানার ৮ মামলার এজাহারে মোট আসামি ৭ হাজার ৮৭৫। এর মধ্যে ১১১ জনের নাম-ঠিকানা থাকলেও পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল ৭৪ জনকে। সন্দেহভাজন হিসেবে আটক ছিল ১৩২ জন। উখিয়া থানার ৭ মামলায় ৫ হাজার ৬২৪ আসামি থাকলেও গ্রেপ্তার হয় ১১৬ জন। টেকনাফ থানার ২টি মামলায় ৬৫৩ আসামির মধ্যে ৬৩ জন, কক্সবাজার সদর মডেল থানায় ২টি মামলায় ১ হাজার ৩০ আসামির মধ্যে ৯৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘ সূত্রতায় জামিন নিয়ে ধাপে ধাপে সবাই কারাগার থেকে বেরিয়ে যায়।

এখনো নিখোঁজ উত্তম: হামলার রাত থেকে এখন পর্যন্ত নিখোঁজ রয়েছেন উত্তম বড়–য়া। তার পরিবারও জানে না তার খোঁজ। ২ ও ৩ অক্টোবর রামু ও উখিয়াতে হামলার সময় পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা চ্যালেঞ্জ করে আলাদাভাবে হাইকোর্টে রিট করেছিলেন ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া ও ইউনুস আলী আকন্দ।

মামলার বর্তমান অবস্থা: রামু বৌদ্ধ পল্লী হামলার রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী কক্সবাজার দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ফরিদ আলমের কাছে মামলাটির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বৌদ্ধ পল্লী হামলায় বিভিন্ন জায়গায় মোট ১৯টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে রামু থানায় সুধাংশু বড়–য়ার করা মামলাটি দুপক্ষের আপস-মীমাংসার ভিত্তিতে খারিজ করে দেন আদালত। বাকি ১৮টি মামলা বর্তমানে বিচারাধীন এবং সব মামলাই সাক্ষ্য নেয়ার পর্যায়ে আছে।

৯ বছরে মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মামলায় যাদের সাক্ষী করা হয়েছে তাদের অনেকেই সাক্ষ্য দিতে আসছে না। করোনা পরিস্থিতি ও পুলিশ বাহিনীতে বদলিজনিত কারণেও মামলার সাক্ষ্য নেয়ায় বিঘœ হয়েছে। তবে মামলার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। মামলার সাক্ষীরা আদালতে উপস্থিত হলে এবং যথাযথ সাক্ষ্য দিলে প্রকৃত দোষীদের শাস্তি দিয়ে বিচারকার্য সম্পন্ন করা যাবে। অপরদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী এডভোকেট নুরুল আমিন জানান, মামলার অনেক আসামি এখনো পলাতক রয়েছে যার কারণে মামলা নিষ্পত্তি বিলম্বিত হচ্ছে।

ভুক্তভোগীদের বক্তব্য: রামুর ওই সাম্প্রদায়িক হামলার শিকার হয়েছিলেন শিক্ষক সুমথ বড়–য়া। তিনি বলেন, ওই দিনের হামলায় আমাদের মনে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে তা কখনো শুকাবার নয়। যতই বলি সম্প্রীতি ফিরে এসেছে, আসলে সেই দিনের স্মৃতি আদৌ কি মন থেকে মুছে ফেলা সম্ভব? ৯টি বছর কেটে গেল- এখনো আসামিদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, রামুর ঘটনায় যারা মিছিলের সামনের সারিতে ছিল, যারা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগে নেতৃত্ব দিয়েছে, তাদের অনেকের নামই পুলিশের অভিযোগপত্রে নেই। উল্টো অনেক নিরাপরাধ ব্যক্তিকে আটক করে এসব মামলা দুর্বল করে ফেলা হয়েছে। অনেক সাক্ষীর নাম-ঠিকানাও লেখা হয় ভুলভাবে। আবার বিচার প্রক্রিয়া বিলম্বের কারণে অনেক সাক্ষী আদালতে গিয়ে সাক্ষ্য দিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। এছাড়া ভয়েও অনেকে সাক্ষ্য দিতে যেতে চান না।

এই হামলায় শত্রুতার জের ধরে আসামি করা হয় কক্সবাজার থেকে প্রকাশিত দৈনিক কক্সবাজার পত্রিকার সাব-এডিটর সোয়েব সাঈদকে। তিনি বলেন, ঘটনার দিন রাতে আমি পত্রিকা অফিসে সংবাদ সম্পাদনা করছিলাম। অগ্নিসংযোগ শুরু হলে পরিচালনা সম্পাদক মুজিবুল ইসলামের নির্দেশে সংবাদ সংগ্রহের জন্য রাত ১২টায় রামুর উদ্দেশে রওনা দেই। রাত ১টার দিকে রামু চৌমুহনী স্টেশনের কাছাকাছি পৌঁছে দূর থেকে অগ্নিসংযোগের দৃশ্য দেখতে পাই। পরে ঘণ্টাখানেক লাল চিং, সাদাচিং বৌদ্ধ বিহার, বড়য়াপাড়া বৌদ্ধ পল্লীতে হামলা-ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের সংবাদ সংগ্রহ করে মেইলে পত্রিকা অফিসে ছবিসহ রিপোর্ট পাঠাই। এ ঘটনার দুই বছর পর ২০১৪ সালে এই ঘটনায় দায়েরকৃত একটি মামলায় উদ্দেশ্যমূলকভাবে আমাকে জড়ানো হয়। আমার পরিবারের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী একটি পরিবারের জমি নিয়ে বিরোধ ও বিজ্ঞ আদালতে মামলা চলমান ছিল, এখনো আছে। ওই বিরোধের জেরে আমার প্রতিপক্ষ রামু থানার তদন্তকারী কর্মকর্তাকে ‘হাত করে’ মামলায় আমার নাম অন্তর্ভুক্ত করে। নিরাপরাধ হয়েও ২০১৪ সাল থেকে ওই মামলায় আমি আদালতে নিয়মিত হাজিরা দিয়ে যাচ্ছি। আমার মতো আরো অনেক নিরাপরাধ ব্যক্তি রামুর বৌদ্ধমন্দির হামলার মামলায় হয়রানির শিকার হচ্ছে।

বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বক্তব্য: আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়–য়া ভোরের কাগজকে বলেন, রামুর ঘটনায় ১৮টি মামলা চলমান আছে। কিছু দিন আগেও এই মামলার পিপির সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তিনি জানিয়েছেন, সাক্ষ্যের অভাবে মামলার বিচারকাজ এগুচ্ছে না। সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে আগ্রহী হচ্ছে না। অনেকে সাহসও পাচ্ছেন না। ফলে এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র ও প্রসিকিউশনের যে তৎপরতা ছিল তা এখন ঝুলে আছে। সাক্ষীরা কেন সাক্ষ্য দিতে আসছে না- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, নিরাপত্তার ইস্যুতো এ ক্ষেত্রে আছেই। তবে সরকার তার দায়িত্ব পালন করেছে। একা সরকারের পক্ষে তা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে সামাজিক ও রাজনৈতিক ঐকমত্য দরকার। উত্তম বড়–য়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তার পরিবারের সঙ্গে আমার যোগাযোগ আছে। এখনো তার কোনো খোঁজ মেলেনি।

পলক বড়ুয়া আপ্পু বলেন, ঘটনার পরপরই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এলাকা পরিদর্শনে যান এবং রামু উপজেলার কিজারী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে এক জনসভায় বক্তব্য রাখেন। হামলার ঘটনায় যারা জড়িত, তাদের কাউকেই রেহাই দেয়া হবে না বলে ঘোষণা দেন তিনি। কিন্তু মামলার কোনো অগ্রগতি নেই। যেসব বৌদ্ধ মন্দিরে হামলা হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এক বছরের মধ্যে সেগুলো পুনর্গঠন করা হয়। নিরপত্তা নিশ্চিত করতে সেনাবাহিনী ও বিডিআর দিয়ে পাহারার ব্যবস্থা করেন।

মুসলিম-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের মহাসচিব সুরেশ বড়ুয়া বাঙালিও জানালেন সাক্ষ্যর অভাবে বিচারিক কাজ এগুচ্ছে না। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, মামলার পিপি আমাদের সশরীরে উপস্থিত হয়ে সাক্ষ্য দেয়ার কথা বলেন। কিন্তু প্রাণনাশের আশঙ্কা থেকে অনেকেই সাক্ষ্য দিতে আগ্রহী হচ্ছে না। আমাদের সংঘরাজ ভিক্ষু বৌদ্ধ ধর্মীয় গুরুপণ্ডিত সত্যপ্রিয় মহাথের আমাদের কোর্টে সাক্ষ্য দিতে নিষেধ করেছেন। আমরা তার সেই নির্দেশ পালন করছি। আমরা তাদের ক্ষমা করে দিয়েছি। তাছাড়া ওই দিন আমরা ঘটনার ভয়াবহতা দেখেছি ফেসবুকে। নিজ চোখে দেখিনি। বিভিন্ন ছবি ও ভিডিও ফুটেজ দেখেও শনাক্ত করে দোষীদের শাস্তির আওতায় আনা যায়। আমরা পিপিকে সেই প্রস্তাবটিও দিয়েছি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App