×

জাতীয়

বিদেশি বিনিয়োগে ১১ বাধা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৬ অক্টোবর ২০২১, ০৮:৪২ এএম

বিদেশি বিনিয়োগে ১১ বাধা

প্রতীকী ছবি

বিদ্যমান আইন-বিধি আরও সংস্কারের মাধ্যমে সহজ ও বিনিয়োগবান্ধব করার তাগিদ

গত বছর করোনা মহামারি শুরু হলে চীনসহ বেশকিছু দেশ থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার শুরু করে জাপান। এসব বিনিয়োগ টানতে চেষ্টা করেছে বাংলাদেশ। গত বছরের শেষ ভাগে চীন থেকে সরিয়ে নিয়ে আসা জাপানি দুটি কারখানার গন্তব্যস্থল হয় বাংলাদেশ। কিন্তু বেশির ভাগ বিনিয়োগ চলে যায় ভিয়েতনাম, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, মেক্সিকো ও ভারতে। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মোটা দাগে ১১টি বাধা শনাক্ত করেছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। নতুন করে বিদেশি বিনিয়োগ আনার আগেই এসব বাধা দূর করার পরামর্শ তাদের। এজন্য বিদ্যমান আইন-বিধি আরো সংস্কার ও সহজ করার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। অন্য দেশগুলো কী ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে, সেদিকেও খেয়াল রাখার পরামর্শ তাদের।

সবশেষ গত ২২ জুন প্রকাশিত জাতিসংঘের শিল্প ও বাণিজ্য উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাডের প্রতিবেদনের তথ্য মতে, ২০২০ সালে দেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট বা এফডিআই) কমেছে ৩১ কোটি মার্কিন ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় ২ হাজার ৬৩৫ কোটি টাকা); যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ১১ শতাংশ কম। অর্থাৎ ২০২০ সালে দেশে এফডিআই এসেছে ২৫৮ কোটি ডলার, ২০১৯ সালে ছিল ২৮৯ কোটি ডলার; এর বেশির ভাগই পুনর্বিনিয়োগ এবং একটি উল্লেখযোগ্য অংশ চীনের। চলতি বছর শেষে আরো কমার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে চলমান করোনা মহামারির মধ্যেও প্রতিবেশী দেশ চীন, মিয়ানমার ও ভারতে এফডিআই বেড়েছে।

এদিকে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে সব ধরনের আইনি জটিলতা দূর করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। পাশাপাশি বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা), বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন অথরিটি (বেজা), অর্থ বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থাগুলো একত্রে কাজ করছে। এসব সংস্থা, মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে সমন্বয় সাধনে কাজ করছে বিডা। এছাড়া ১১টি সংস্থার ৪১ ধরনের পরিষেবা দেয়ার ক্ষেত্রে এসব সংস্থার সার্বিক কার্যক্রমে গতি আনার নির্দেশনা দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। পাশাপাশি বৈশ্বিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের অধিকতর অংশ নেয়া ও বিনিয়োগ আকর্ষণের লক্ষ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) যৌথভাবে আজ মঙ্গলবার থেকে সপ্তাহব্যাপী (২৬ অক্টোবর-০১ নভেম্বর) ‘বাংলাদেশ ট্রেড এন্ড ইনভেস্টমেন্ট সামিট ২০২১’ শীর্ষক ভার্চুয়াল আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্মেলনের আয়োজন করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সম্মেলনের উদ্বোধন করবেন। বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৩৮টি দেশের সর্বমোট ৫৫২টি কোম্পানি সপ্তাহব্যাপী ৪৫০টি বিটুবিতে অংশ নেবে। এছাড়া আগামী ২৮ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হবে বিডা আয়োজিত দুই দিনব্যাপী বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সম্মেলন-২০২১। এতে দেশের অন্তত এক হাজার বিনিয়োগকারী ও ১০টি দেশ অংশ নেয়ার কথা রয়েছে।

বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সম্প্রতি এ উপলক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বাংলাদেশ বিদ্যুৎসহ অন্যান্য অবকাঠামো খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে, যার সুবিধা নিয়ে আমাদের দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে আরো কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। এ বাণিজ্য সম্মেলন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তাদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনে সক্ষম হবে, যা আমাদের অর্থনীতিকে আরো শক্তিশালী করবে। টিপু মুনশি বলেন, আমাদের রপ্তানি খাত বেশিমাত্রায় তৈরি পোশাকনির্ভর, এখন সময় এসেছে অন্য খাতগুলোকে নিয়ে কাজ করার। বাণিজ্য সম্মেলনে সম্ভাবনাময় ৯টি খাতের ওপর আলোকপাত করা হবে।

অবশ্য দেশজুড়ে ১০০টি ইকোনমিক জোন প্রতিষ্ঠার যে কার্যক্রম হাতে নিয়েছে সরকার, সেগুলো বাস্তবায়ন করা গেলে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে বলে আশা করছে বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন অথরিটি (বেজা)। চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে প্রায় দুই ডজন বিদেশি কোম্পানি বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়েছে। ভারতের আদানি, জাপানের ফুজি, মিতসুবিশি, ম্যাকডোনাল্ডসহ আরো অনেক বিদেশি কোম্পানি ইতোমধ্যে সেখানে কারখানাও স্থাপন শুরু করেছে। এ শিল্পনগরের কাজ শেষ হলে দেশের বিনিয়োগের চিত্র পাল্টে যাবে বলে আশা করছেন সদ্যবিদায়ী বেজা চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী।

বিনিয়োগে ১১ বাধা: জানা গেছে, বর্তমানে বিদেশি বিনিয়োগে চিহ্নিত ১১ বাধার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে- করোনা মহামারির প্রেক্ষাপটে স্থানান্তরিত বিনিয়োগ ধরতে দেশে কোনো ইনসেনটিভ বা প্রণোদনার ব্যবস্থা না থাকা। এছাড়া আছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে ভেটিং না করে প্রকল্পের বা অন্য এজেন্সির সঙ্গে বিনিয়োগ সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষর, দেশি এবং বিদেশি কোম্পানির মধ্যে কর্পোরেট করবৈষম্য, দেশি ও বিদেশি কোম্পানির জন্য ভিন্ন বিনিয়োগ নীতি, দেশের বিনিয়োগ পরিবেশ সম্পর্কে বহির্বিশ্বে ইতিবাচক ভাবমূর্তি ও ঘাটতি, পিপিপিতে বিনিয়োগ সংক্রান্ত কর ও ভ্যাট জটিলতা, এনআরবি অ্যাকাউন্টধারী বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ ও মূলধন নিয়ে যাওয়া নিয়ে সমস্যা, ব্যাংকিং পদ্ধতিতে জটিলতা, নন-রেসিডেন্সিয়ালদের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে উচ্চ করহার, বিদ্যমান পলিসি বাস্তবায়নে জটিলতা এবং অনলাইনে ব্যাংক হিসাব খোলার সীমাবদ্ধতা।

অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, দেশি বিনিয়োগ না বাড়লে বিদেশি বিনিয়োগও বাড়বে না। গত কয়েক বছর ধরে আমাদের বিনিয়োগ একই জায়গায় আটকে আছে; জিডিপির ৩১ থেকে ৩২ শতাংশের মধ্যে। করোনার কারণে তা আরো কমে গেছে। তিনি বলেন, করোনায় বিশ্ব বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়ায় পুঁজির চলাচল একেবারে স্থবির ছিল। ফলে বিশ্বব্যাপী নতুন পুঁজি বিনিয়োগ কম হয়েছে। এর মধ্যেও যে গত অর্থবছরে বাংলাদেশে এফডিআইয়ে ৮ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে, এটাকে আমি ভালোই বলব।

বিনিয়োগ বাড়াতে ওয়ান স্টপ সেবা: বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতেই বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (বেপজা), বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা), বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) পৃথকভাবে সেবা দিচ্ছে। এর মধ্যে ওয়ান স্টপ সার্ভিসের অংশ হিসেবে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক সেবা দিচ্ছে বিডা। ওয়ান স্টপ সার্ভিসের মাধ্যমে একজন বিনিয়োগকারী পৃথিবীর যে কোনো প্রান্ত থেকে অনলাইনে আবেদন করতে পারছেন। দিন-রাত যে কোনো সময় অনলাইনে আবেদন করছেন বিনিয়োগকারীরা। ব্যবসার ধরন অনুযায়ী, উদ্যোক্তার কী কী সেবা দরকার তা চলে যাচ্ছে সংশ্লিষ্ট সেবাদানকারী সংস্থায়। নির্দিষ্ট দিনের মধ্যেই সংস্থাকে ওই সেবা দিতে হবে এমন বাধ্যবাধকতা রয়েছে বিডার। জানতে চাইলে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, কোভিড-১৯ সহ নানাবিধ চ্যালেঞ্জের মধ্যেই আমরা বিনিয়োগকারীদের জন্য লক্ষ্যমাত্রার ৭০ শতাংশ সেবা অনলাইনে নিয়ে আসতে পেরেছি। চলতি বছরের মধ্যেই ৩৫টি প্রতিষ্ঠানের ১৫০টি সেবা দেয়ার লক্ষ্যে বিডা কাজ করে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ওএসএস চালু হওয়ার পর থেকে বিনিয়োগকারীদের প্রায় ২৫ হাজার সেবা অনলাইনের মাধ্যমে দেয়া সম্ভব হয়েছে। তিনি আরো বলেন, আমাদের বিনিয়োগকারীদের দ্রুত সহজে ঝামেলাবিহীনভাবে আমরা নিয়মিত ওএসএস মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করেছি, যাতে বিনিয়োগকারী সহজেই সব ধরনের সেবা পেতে পারেন।

নভেম্বরে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সম্মেলন: আগামী ২৮ নভেম্বর ঢাকায় শুরু হতে যাচ্ছে দুই দিনব্যাপী বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সম্মেলন-২০২১। এতে দেশের অন্তত এক হাজার বিনিয়োগকারী ও ১০টি দেশ অংশ নেয়ার কথা রয়েছে। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বলেন, এ সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য দুটি। একটি হলো বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিংয়ে ভালো অবদান রাখা। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা। প্রধানমন্ত্রীর এ উপদেষ্টা বলেন, আমরা বিদেশি বিনিয়োগের পাশাপাশি প্রবাসী বাংলাদেশি এবং দেশীয় তিন উৎস থেকেই বিনিয়োগ চাই। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণে বাংলাদেশের যে চ্যালেঞ্জ, তা মোকাবিলার জন্যও এ বিনিয়োগ খুব জরুরি। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বিনিয়োগের যে অনুকূল পরিবেশ বাংলাদেশে সৃষ্টি হয়েছে, আমরা তার পূর্ণ সুবিধা নিতে পারিনি। দেশের মোট জিডিপিতে বিনিয়োগের অবদান এখনো অনেক নিচে। তাই আশা করছি, যে দুই উদ্দেশ্যে এ সম্মেলনের আয়োজন করা হচ্ছে তা সফল হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App